মতামত

সারাদেশের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিঃ কারণ ও করণীয়

– রবিন গুহ

বাংলাদেশের উত্তর পূর্বে সিলেট সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। স্মরণকালের সবচাইতে ভয়াবহ এই বন্যায় সিলেট ও হবিগন্জের অধিকাংশ জায়গাই তলিয়ে গেছে। এই দুই জেলায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রশাসনের হিসাবে বলা হচ্ছে। বিমান ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে সুনামগঞ্জ ও সিলেট অনেকটাই পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোঃ এনামুর রহমান এমপির বক্তব্য অনুযায়ী, বন্যার পানি বিগত ১২২ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়াও জামালপুর, সিরাজগন্জসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলাগুলোতেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় ৭০টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, নিয়েজিত হয়েছে সরকারী-বেসরকারী বাহিনী। বন্যার কারণে সারা দেশে ১৯শে জুন থেকে শুরু হওয়া স্কুল সার্টিফিকেট বা এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। সিলেটের সাথে বিমান ও রেল যোগাযোগও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। এবারের এইরকম আকস্মিক বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু কারণও রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাদের মতে, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানে অতিবৃষ্টির কারণে এবারের ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, গত তিনদিন চেরাপুঞ্জিতে ২৪৮৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। এরকম ধারাবাহিক বৃষ্টি হয়েছে ১৯৯৫ সালে একবার, তিনদিনে ২৭৯৮ মিলিমিটার আর ১৯৭৪ সালে ২৭৬০ মিলিমিটার। তিনি বলছেন, এরকম খুব কম দেখা গেছে। সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত থেকেই ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকার শুরু হয়েছে। ফলে সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে এসে মিশে যাওয়ার পর ভৈরব বা মেঘনা নদী হয়ে সাগরে চলে যায়। কিন্তু অতীতের বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষাপট আর এখনকার নদীগুলোর অবস্থার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে বলে নদী গবেষকরা মনে করছেন। এবার হঠাৎ বন্যার পেছনে চেরাপুঞ্জির প্রবল বৃষ্টিপাতকে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া-জলবায়ু বা বৃষ্টির ধরন বদলে যাওয়ায় এখন বৃষ্টি হলেই অনেক বেশি ভারী বৃষ্টি হয়। তিনি আশঙ্কা করছেন, চেরাপুঞ্জিতে আরও দুই তিনদিন বৃষ্টিপাত হলে বন্যার ধকল সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে।
অতিবৃষ্টির কারণে ভারতের আসামেও বন্যা এবং ভূমিধ্বসের সৃষ্টি হয়েছে। আসামে বরাক ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গুয়াহাটিসহ অনেক এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। আসাম, মেঘালয় মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে জানা যায়, আসামের বন্যায় অন্তত ১১ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নদী গবেষক মুমিনুল হক সরকার সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রতি বছর উজান থেকে পানির সাথে পলি আর পাথর নেমে আসে। সেটা এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি পানি আসলে সেটা উপচে আশেপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে।নদীর নাব্যতা নষ্টের জন্য ভারত অংশে অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনকে দায়ী করছেন গবেষকরা।
বন্যা ও পানি গবেষক অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, বিশেষ করে ভারতের উজানে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে। ফলে নদীর তলদেশ ভরে যায়। সেখানে নাব্যতা সংকট তৈরি হচ্ছে। সেখানে গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে।এর পাশাপাশি নদীগুলো ঠিকমতো ড্রেজিং না হওয়া, ময়লা-আবর্জনায় নদীর তলদেশ ভরে যাওয়া, ঘরবাড়ি বা নগরায়নের ফলে জলাভূমি ভরাট হয়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন এই গবেষক। এই কারণে মেঘালয় বা আসামে বেশি বৃষ্টিপাত হলেই সিলেট বা কুড়িগ্রাম এলাকায় বন্যার তৈরি হচ্ছে বলে গবেষকরা মনে করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতামত থেকে জানা যায়, এবারের হঠাৎ বন্যার পেছনে মানুষের নিজেদের তৈরি কতগুলো কারণ রয়েছে। সিলেট বা সুনামগঞ্জ এলাকায় খালি জায়গা এবং জলাভূমির পরিমান ও নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায়  এবং নতুন নতুন রাস্তাঘাট ও  স্থাপনা তৈরি হওয়ায় এখন বন্যার পানি নেমে যেতেও সময় লাগে। আগে হয়তো জলাভূমি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার পানি থেকে যেতে পারতো। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না।
হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট রোড করে ফেলা হয়েছে। ফলে পানি প্রবাহে বাধার তৈরি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর নিচের দিকে সরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা বেশি অনুভত হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা তৈরির কারণেও পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া বন্যার অন্যতম কারণ। ‘আমাদের দেশে উজান থেকে পানি নামে উত্তর থেকে দক্ষিণে। এই রাস্তাটিও কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণে তৈরি। ফলে এটা হয়তো হাওরের পানি প্রবাহের কিছুটা বাধার তৈরি করছে, কিন্তু বন্যার এটাই একমাত্র কারণ নয়”। হাওরে যেসব সড়ক বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে, তা পরিকল্পিতভাবে হয়নি বলে উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক সাইফুর ইসলাম। সেটা না হওয়ার কারণেই বন্যা এরকম তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।
নদী গবেষক মমিনুল হক সরকার বলছেন, ”হাওরে যেসব রাস্তা পূর্ব-পশ্চিমে তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোই হাওরের পানি চলাচলে মূল বাধার তৈরি করছে। এরকম অনেক রাস্তা কোনরকম পরিকল্পনা ছাড়া তৈরি করা হয়েছে”।সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ বা নেত্রকোনা হাওর এলাকায় বেশিরভাগ জনপদে শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোন কারণে হাওরে বা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলে তার খুব দ্রুত শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে।
বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, ”হাওরে এসব এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়নি। সেটা করা না হলে বাড়িঘর উঁচু করে তৈরি করতে হবে, আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। সেটাও করা হয়নি। ফলে যখন এভাবে আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে, সেটার ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হচ্ছে।”
বন্যার পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেনাবাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাগুলো উদ্ধারকার্য, ত্রান বিতরণসহ নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেকেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রাকৃতিক দু্র্যোগ মোকাবিলায় আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই এক্ষেত্রে কাজে লাগানো যাবে। তবে বন্যা পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। আমাদের নদ-নদীগুলো খনন করতে হবে। যেনতেন প্রকারে খননে তেমন কোন ফল পাওয়া যাবেনা। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে কোন দিক দিয়ে কীভাবে খনন করলে পাড় ভাঙবে না, খেত-খামার নষ্ট হবে না, ব্যাপারগুলো দেখতে হবে। আবার দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে খননের সময় বালু নদীর পাড়েই রেখে দেয়, এভাবে লাভ হয় না।
নদী গবেষক মুশতাক আহমদের মতে সিলেটের বিশাল এলাকার পানি যায় শুধু একটা চ্যানেল দিয়ে, কালনী নদী দিয়ে। সুরমা ও কুশিয়ারা একসঙ্গে হয়ে কালনী নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পানি এগোয়। বিশাল এলাকার পানি যাওয়ার জন্য এ জায়গা যথেষ্ট নয়। এ পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন করা দরকার। জায়গাটাকে দরকার হলে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে আরও বাড়ানো ও গভীর করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ ও সিলেটের পানি বের হয়ে যাওয়ার পথও তো অনেক কমে গেছে, পানি জমা থাকার জায়গাগুলোও কমে গেছে। হাওরের পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। অন্যদিকে, পাহাড়-টিলাও কিন্তু পানি শোষণ করে রাখে। অথচ নির্বিচারে সিলেটে পাহাড়-টিলা কাটা চলছে, পুকুর ভরাট চলছে। এসব থামানো উচিত। সিলেটের নদ-নদীগুলো দীর্ঘদিন ধরে খনন না হওয়ায় ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরো বলেন মোটকথা হচ্ছে, নদী খনন করতে হবে এবং পুরো এলাকার পানি বের হওয়ার জন্য যে একটামাত্র পথ আছে—অর্থাৎ কালনী নদী—সেটাকে ইম্প্রুভ করলেই দ্রুত বন্যার পানি সরে যেতে পারবে। প্রয়োজনে কিছু সংযোগ খাল যদি তৈরি করা যায়, তাহলেও পানি দ্রুত বের হবে।
ভবিষ্যতে বন্যা সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য পানি ও নদী বিশেষজ্ঞ, প্রকৃতি ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের পরিকল্পনাবিদ ও প্রযুক্তিবিদ এবং সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন পর্যায়ের সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সমন্বিত  উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নচেৎ এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রান তো পাওয়া যাবেই না, উপরন্তু ভবিষ্যতে গোটা দেশেই বন্যা পরিস্থিতি আরো জটিল রূপ নেবে, আরো বেশি জান-মালের ক্ষতিসাধন হবে। ( তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো)