চলমান সংবাদ

ঠেকানো যাচ্ছে না পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস প্রতিবছরই পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটছে

 

চট্টগ্রামে ১৪ বছরের বেশি সময়ের চেষ্টায়ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতিমুক্ত করা যায়নি পাহাড়গুলো। পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরতদের সরাতে সারাবছর প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ থাকে না। বর্ষা মৌসুম এলেই শুরু হয় উচ্ছেদে তোড়জোড়।

পাহাড় ধসে প্রাণহানি বন্ধে এবং ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধে বিভিন্ন সময় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি নানা সুপারিশ করলেও এসবের কিছুই বাস্তবায়ন হয়না। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ হয় না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ না থাকায় প্রতিবছর পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।

গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামে টানা বর্ষণ হচ্ছে। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অফিসের পক্ষ থেকে পাহাড় ধসের শঙ্কার কথা বলা হলেও এ নিয়ে আগে থেকে কোনো উদ্যোগ ছিল না জেলা প্রশাসনের। শুক্রবার (১৭ জুন) বিকেলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে শুক্রবার (১৭ জুন) দিবাগত রাতে নগরের আকবরশাহ থানা এলাকায় পৃথক পাহাড়ধসে ৪ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১১জন। নগরের আকবর শাহ থানার বরিশাল ঘোনা ও ফয়’স লেকের বিজয় নগর এলাকায় পাহাড় ধসের এই ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, নগরে ৬৫ পাহাড়ের মধ্যে ৩৪ পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। এর মধ্যে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১টি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪টি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে কিংবা পাহাড় কেটে বসতি গড়ে উঠেছে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস।

দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসনের এ বিষয়ে তেমন নজর নেই। নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ে প্রতিদিনই গড়ে উঠছে ঝুঁপড়ি থেকে শুরু করে চার-পাঁচ তলার দালান। পাহাড়ে বসবাস করা বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। সেখানে বসবাসের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে।

তাদের অভিযোগ, পাহাড়ের পাদদেশে ঘর নির্মাণের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তারাই পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করে নি¤œ আয়ের লোকজনকে কম ভাড়ার কথা বলে বসবাসের প্ররোচনা দেন। প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। শুধু বর্ষা মৌসুম এলেই বসতি উচ্ছেদ করে। কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় ততই পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরানোর উদ্যোগে স্থবিরতা চলে আসে। নজরদারি থাকে না আর। এই সুযোগে উচ্ছেদকৃত পরিবারগুলো আবারো ফিরে আসে পাহাড়ের পাদদেশে। যার কারণে ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনা।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান বলেন, আমরা প্রতি বছর উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি। পাহাড়গুলো যাদের মালিকানাধীন, তারা যদি উচ্ছেদের পরে নিজেদের দখলে না রাখতে পারে এবং সেখান থেকে যদি অবৈধ বসবাসকারীদের সরিয়ে না দেয়, তাহলে জেলা প্রশাসনের একার পক্ষে কোনদিনই অবৈধ বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা সম্ভব না। ফলে হতাহতের ঘটনা চলতেই থাকবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার পরিবার বসবাস করছে। প্রতি বছরই তাদের উচ্ছেদ করা হয়।

উচ্ছেদ করার পর দেখা যায়, শুকনো মৌসুমে তারা আবার একই জায়গায় ফিরে আসে। পাহাড়ে অবৈধ বসতিগুলোতে অবৈধ বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের লাইনসহ রাস্তাঘাট করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পাহাড় মালিকদের সবাইকে অনুরোধ, ঝুঁকিপূর্ণ যারা রয়েছেন তাদের যেন সরানোর ব্যবস্থা করেন। আর সরানোর জন্য যত ধরনের প্রশাসনিক সহযোগিতা লাগে, সব করা হবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

এদিকে শনিবার (১৮ জুন) আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে আরো দুইদিন মাঝারি থেকে ভারী বর্ষনের সম্ভাবনা রয়েছে। কোথাও কোথাও অতি ভারী বৃষ্টিও হতে পারে। এতে পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে।

নগর বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনের ব্যর্থতাযয় দিন দিন বাড়ছে পাহাড়ে বসতি। মদদ দিচ্ছে প্রভাবশালীরা। দফায় দফায় বৈঠক, তালিকা প্রণয়ন ও সুপারিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ অবৈধ বসতি সরানোর কাজ। নগর পরিকল্পনাবিদ ও সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করা যাচ্ছে না তার কারণ হচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহলের লোভাতুর তৎপরতা, সেই তৎপরতা থামানোর জন্য কার্যকর কোন উদ্যোগ না নেয়া হয় না। তিনি বলেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এরপর কিছু উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। ভারি বৃষ্টি হলে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে রাখেন তারা। বর্ষা চলে গেলে আর কোনও খবর থাকে না।

তিনি আরও বলেন, পাহাড় ধসে প্রাণহানি রোধে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করতে হবে। পাহাড়ের পাদদেশে সববাসকারীদের সেখানে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী। আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

গত ১৪ বছরে পাহাড়ধসে আড়াই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন টানা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে মারা যান ৩০ জন।

২০০৭ সালে পাহাড়ধসে ব্যাপক প্রাণহানির পর টেকনিক্যাল কমিটি যে ৩৭ দফা সুপারিশ করেছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। বরং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ নতুন করে ১৬টি পাহাড় কেটে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড নির্মাণ করে। সেখানকার আটটি পাহাড়ে নতুন করে অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে।

# ১৮.০৬.২০২২ চট্টগ্রাম #