চলমান সংবাদ

বিজ্ঞান ভাবনা (৪৭)

– বিজন সাহা

গত সপ্তাহে কথা হচ্ছিল যাচাই না করেই সব কিছু বিশ্বাস করা নিয়ে। এক্ষেত্রে রাশিয়া বা পুতিনের দানবীয় রূপ দানের কথা বলেছিলাম। অথচ ২০০১ সালে ৯/১১ এ নিউ ইয়র্কে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পর বিদেশী নেতাদের মধ্যে পুতিনই প্রথম প্রেসিডেন্ট বুশকে টেলিফোন করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের সময় ন্যাটোর জন্য তিনি রাশিয়ার আকাশ খুলে দেন। করোনার সময় আমেরিকা বা অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো যখন সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেয় তখন তিনিই ইটালিকে মাস্ক, ডাক্তার দিয়ে সাহায্য করেন। গত ডিসেম্বরে যখন ইউরোপে গ্যাস সংকট শুরু হয় তিনিই অতিরিক্ত গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। ইউক্রেনের হাতে বন্দী রুশ সেনাদের যখন পায়ে গুলি করে অত্যাচার করা হয় তখন তিনিই আদেশ দেন যুদ্ধবন্দীদের সাথে ভাল ব্যবহার করার জন্য। তখন আর কেউ আবু গ্রেইব বা গুয়ান্টামার কথা মনে রাখে না। আজ যখন আমেরিকা ইউক্রেনের স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে চিৎকার করে তখন সে ভুলে যায় স্বাধীন ইউক্রেনকে সেই পরাধীন করেছে, ইউক্রেনের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে নিজেদেরই স্বার্থে। এমনকি হেনরি কিসিঞ্জার পর্যন্ত বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে ইউক্রেনের মুক্তির একমাত্র পথ নিরপেক্ষ স্ট্যাটাস। আচ্ছা আমাদের এসব বাঙালি কি মনে রাখে একাত্তর সালে আমেরিকার ভূমিকার কথা? আমেরিকা কি বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে সেদিন দাঁড়িয়েছিল? আমেরিকার হাতেও কি শেখ মুজিবের রক্ত লেগে নেই? আচ্ছা পঁচাত্তরে পট পরিবর্তন করে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ফিরিয়ে আনার জন্য আমেরিকা কি মোটেই দায়ী নয়? মাত্র কয়েক বছর আগে এই আমেরিকাই কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যাতে না হয় সে জন্যে আদাজল খেয়ে লাগেনি? তাহলে আজ কোন যুক্তিতে আমরা বিশ্বাস করব যে এদের কাছে ইউক্রেনের মানুষের জীবনের কোন মূল্য আছে? যে দেশ নিজ দেশের মানুষের জীবনের মূল্য দিতে জানে না, যে দেশে এ কারণে বিএলএম আন্দোলন গড়ে ওঠে (যদিও সেটাও ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী কৌশল) সেখানে কেন তারা ৪০ বিলিয়ন ডলার খরচ করবে? আর যদি করেই আগে কেন করল না, আগে কেন সেখানে এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলল না যখন সাধারণ মানুষ নিজেরাই সেই ব্যবস্থাকে সমর্থন করত, সে জন্যে কোন ময়দানের, বিশেষ করে উগ্র জাতীয়তাবাদী আর ফ্যাসিবাদী শক্তি গড়ে তুলতে হত না? বাহান্নতে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি না দিয়ে পাকিস্তান তার রায় লিখেছিল, ইউক্রেন কি সে পথেই যায়নি? ফেসবুকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিভিন্ন মিথ্যা রটনা দেখি, তেমন দেখি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সম্পর্ক নিয়ে। অনেকেই এসব শেয়ার করেন মূলত এসব বানোয়াট গল্পের প্রতিবাদ করতে। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়া নিয়ে অনেক মিথ্যাই এরা পাশ কাটিয়ে চলে যান। বিভিন্ন দেশ থেকে যারা ইউরোপ বা আমেরিকায় পড়াশুনা করতে যায় তাদের খুব কম সংখ্যকই যায় আদর্শের জন্য, অধিকাংশই যায় নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে। আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে এসেছিলাম তাদের বেশিরভাগ এসেছিলাম আদর্শের কারণে। আর সে আদর্শ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়েও বড়। এসবের একটা ছিল শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ানো, ফ্যাসিবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ তো পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে। হয়তো তখনও আমাদের দেশে অনেকেই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, কিন্তু যারা শুধু পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধি হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করেছে তাদেরই আমরা রাজাকার বলি। আজ যারা গণতন্ত্রের নামে ইউক্রেনের আজভ, আইদার, রাইট সেক্টর এদের সাহায্য করছেন তারা কি এই অর্থে রাজাকার নন?

ইউক্রেনে রুশপন্থী নিয়ে অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা আছে। অনেকেই মনে করেন যে রুশপন্থী মানে জাতিগত ভাবে রুশ। কথাটা ঠিক নয়। এই যেমন আমাদের দেশে মার্কিনপন্থী, চীনপন্থী, ভারতপন্থী, পাকিস্তানপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা মানুষ আছে – তারা কিন্তু কেউই জাতিগত ভাবে ঐসব দেশের মানুষ নয়। তবে তারা চায় দেশের সরকার যেন তার রাষ্ট্র নীতিতে নিজ নিজ পন্থার দেশকে সুবিধা দেয়, সেই দেশের সাথে সব ক্ষেত্রেই ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলে। হয়তো পাকিস্তানপন্থীদের কেউ কেউ দেশ আবার পাকিস্তানের সাথে কোন না কোন ফর্মে একত্রিত হোক সেটা চায় তবে মার্কিন, চীন বা ভারতপন্থীরা চায় বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্র নীতি এমনভাবে গড়ে তুলুক যাতে আমেরিকা, চীন বা ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। একই ঘটনা ছিল ইউক্রেনে। রুশপন্থীরা চাইত রাশিয়ার সাথে ভাল সম্পর্ক আর সেটা তারা চাইত নিজেদের অতীত ঐতিহ্য ও শতাব্দীর পর শতাব্দী একসাথে পথ চলার ফলে যে একক সাহিত্য ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তার উপর ভিত্তি করে। সেখানে যেমন জাতিগত ভাবে রুশরা ছিল, তেমনি ছিল ইউক্রেন বা অন্যান্য জাতির মানুষ। একইভাবে ইউরোপপন্থীদের মধ্যেও আছে প্রচুর রুশ, ইউক্রেন ও অন্যান্য জাতির লোক। এখন যুদ্ধবন্দীদের রুশ ভাষায় কথা বলতে শুনি বুঝতে অসুবিধা হয়না যে এরা বেশিরভাগ জাতিগত ভাবে রুশ। কেন দক্ষিণ পূর্ব ইউক্রেনের মানুষ রুশপন্থী? কারণ এই অঞ্চল বরাবরই রুশ অধ্যুষিত ছিল। শত শত বছর ধরে এখানে গড়ে উঠেছে শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যার ফল ভোগ করেছে সবাই। আর এ কারণেই এই অঞ্চলের সাথে রাশিয়ার ছিল এক বিশেষ সম্পর্ক, কি রাষ্ট্রীয় ভাবে, কী পাবলিক ডিপ্লম্যাসিতে। কেন উত্তর পশ্চিম ইউক্রেনে এটা হয়নি? কারণ এসব এলাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা ইউক্রেনে যুক্ত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে।

যদিও বিভিন্ন জায়গায় ইউক্রেন সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে, কিন্তু যুদ্ধ থামার কোন নাম গন্ধ নেই। আজভ স্টীলে আজভ বাহিনীসহ অনেক প্রফেশনাল আর্মি আত্মসমর্পণ করলেও অন্যান্য জায়গায় যারা আত্মসমর্পণ করছে তাদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ যারা মিনিমাম ট্রেনিং পর্যন্ত পায়নি। তাহলে কি ইউক্রেন সাধারণ মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে যুদ্ধে, ঠেকাতে বলছে রুশ আর্মিকে যাতে এই সুযোগে কয়েক হাজার সৈন্য ইউরোপ থেকে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে নামতে পারে? অন্যদিকে চলছে শস্য রাজনীতি। ইউক্রেনে এবার শস্য হবে কিনা সেটাই প্রশ্ন সাপেক্ষ, অথচ সেদেশ থেকে শস্য বের করে নেবার পায়তারা করছে ইউরোপ, আমেরিকা। অনেকেই বলছে এটা অস্ত্রের বিনিময়ে খাদ্য। এই খাবার কি তৃতীয় বিশ্বের দেশে পৌঁছুবে? মনে হয় না। তাহলে? ইউক্রেনকে খাদ্য শূন্য করে সেখানে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে পরে রাশিয়াকে দায়ী করার জন্য। মনে পড়ে ১৯৪৩ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কথা। কথায় আছে কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। শোষক ও উপনিবেশবাদীরা মুখে যতই মানবতার কথা বলুক না কেন, মনে মনে সব সময় আগের মতই থেকে যায়।

আমরা প্রায়ই ইউরোপকে আধুনিক সভ্যতার সূতিকাগার বলি। কথায় কথায় গ্রীক, রোমান সভ্যতার কথা বলি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই নিজেদের ঐতিহ্যের কথা। ভুলে যাই চীন, ভারত, মিশর, ইরাক, সিরিয়া – এসব দেশ  প্রাচীন সভ্যতার জন্মস্থান। ভুলে যাই এসব প্রাচীন ঐতিহ্য কিভাবে পশ্চিমা বিশ্ব দ্বারা হয় লুণ্ঠিত, নয়তো ধ্বংস হয়েছে। আমরা মোসার্ট, বিঠোফেন, বাখ, দা ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, গেটে, দান্তে, শেক্সপিয়ার, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন – এদের প্রশংসা করতে গিয়ে পশ্চিমা সভ্যতার কাছে নতজানু হই, কিন্তু ভুলে যাই মার্ক্সবাদের পাশাপাশি এখানেই জন্ম নিয়েছিল নাজিবাদ ও ফ্যাসিবাদ। এই মানুষগুলোই এক সময় আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের নির্মম ভাবে নিশ্চিহ্ন করেছিল, লাখ লাখ মানুষকে পশুর মত বিক্রি করেছিল ক্রীতদাস হিসেবে। এই যে আজ সামরিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক – প্রতিটি ক্ষেত্রে এরা বিভিন্ন দেশের উপর যে চাপ সৃষ্টি করছে সেটা কি সেই পুরনো উপনিবেশবাদের নব্য রূপ নয়?

বর্তমান যুদ্ধ আমাদের অনেককেই স্পর্শ করে গেছে। আমাদের অনেকেরই অনেক বন্ধুবান্ধব সেখানে আছে। আমার নিজের কয়েকজন ক্লাসমেট ইউক্রেনের। তাদের অনেকের খবর জানি না। অনেকের পরিচিত জন মারা গেছে। আমার নিজের পরিচিত একজন মারা গেছে কয়েক বছর আগে উগ্রদের হাতে ডিএসসি ডিফেন্ড করার কিছুদিন পরে। অবশ্যই আমাদের এসব দেখে কষ্ট লাগে, সেটা বলতে চাই, বলি। কিন্তু এই আমরাই কিন্তু বিগত আট বছর ধরে দনবাসে যা ঘটেছিল তা নিয়ে কথা বলিনি। বলতে পারেন ওদের তো আমরা চিনি না, জানি না। কিন্তু অপরিচিত প্যালেস্টাইন শিশুর জন্য কিন্তু আপনার সহানুভূতির অভাব হয় না। আপনি অবশ্যই প্যালেস্টাইনের মানুষের জন্য বলবেন, কিন্তু একই সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এধরনের অসহায় মানুষের পক্ষে কথা বললেই না বুঝব যে আপনার মানবিক মন পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট নয়। যদি একটু মন দিয়ে ১৯৯১ পরবর্তী রাশিয়া ও ইউরোপের সম্পর্কের দিকে খেয়াল করেন, দেখবেন সেখানে শুধুই ছিল পরস্পরকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি, শুধুই বিজনেস। কিন্তু মাংসের কারবারিদের সেটা সইবে কেন? অস্ত্র বিক্রি করতে না পারলে তাদের মোড়লগিরি কোথায় যাবে? আর তাই দরকার শত্রু। শক্তিশালী শত্রু। প্রথমে তারা চেষ্টা করেছিল আল কায়েদা, তালেবান, ইসলামিক স্টেট এদের শত্রু হিসেবে দাড় করাতে। এমনকি ইরান বা উত্তর কোরিয়াও সবাইকে এক করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। আর তাই তো ছলে বলে কৌশলে রাশিয়াকে মাঠে নামাতে হল। একটা দেশ যদি ইউরোপের উপর আক্রমণ করতে চাইবে সে কেন নর্থ স্ট্রীম-২ এর মত এত ব্যয়বহুল প্রোজেক্টে ইনভেস্ট করবে? সেটা সবাই বোঝে। কিন্তু ইউরোপের দেশে দেশে এখন মার্কিন তাঁবেদার সরকার। তাই তারা সব কিছুতেই দেখবে ষড়যন্ত্র। আর ইউরোপের মানুষ আমেরিকার মনিবদের মন রাখতে প্রাণ বিসর্জন দেবে, বিসর্জন দেবে শান্তি আর নিরাপত্তা। মনে রাখা দরকার বিগত প্রায় অর্ধ শতাব্দী দীর্ঘ ইউরোপের উন্নয়ন আর আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাত্রার রেলগাড়ি চলেছে রাশিয়ার অপেক্ষাকৃত স্বল্প মূল্যের তেল গ্যাস আর কাঁচামালের উপর নির্ভর করে। আর এখন যুদ্ধ লাগিয়ে আমেরিকা শুধু ইউরোপের চোখের ঘুম কেঁড়ে নেয়নি, ধ্বংস করছে অর্থনীতি আর অস্ত্র বিক্রি করে লাল হচ্ছে সে দেশের ব্যবসায়ীরা। প্রশ্ন করুন। দেখবেন আপনারা কোন দৈত্যকে দুধকলা দিয়ে পুষছেন।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া