মতামত

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ ও তার ফলাফল

– শাহীন আকতার হামিদ

মারিয়াপোল দখলের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের যুদ্ধ মোড় নিয়েছে নুতন পথে, গন্তব্য অজানা। তবে অনেকের মতে এটা ভিয়েতনাম অথবা আফগানিস্তান এর মত হতে পারে, যা একেবারেই কাম্য নয়। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ চলবে আরও কিছুকাল, যুদ্ধের শুরুতে যেমনটা ভেবেছিলাম এক সপ্তাহে ইউক্রেন চলে যাবে রাশিয়ার হাতে তা কিছুটা পালটে গেল। বর্তমানে রাশিয়া যদি ইউক্রেনকে দখল করে নিত ইউক্রেনের শতকরা ৮০ভাগ মানুষ এ ঘটনার প্রথমে বিচলিত হয়ে যেত কিন্তু কিছুকাল পরে হয়ত তারা একটি স্বাধীনতার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ত ও নিজেদের স্বাধীন করে নিত। পৃথিবীর বহুদেশ এভাবেই স্বাধীন হয়েছে।

ইউক্রেনে-রাশানদের আক্রমণের সম্ভাব্য কারণগুলো কি কি হতে পারেঃ

১। ন্যাটো ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ইউক্রেনের যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা

২। রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলের কারণে ২০০৮ থেকে ইউক্রেনে বসবাসরত রুশভাষী ও ইউক্রেনিয়ানভাষীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের ফলাফল

৩।ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করার ইচ্ছা

৪। রাশিয়া থেকে ক্রিমিয়ায় যাওয়ার পথ তৈরি করা।

কারণ যাই হোক না কেন মারা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ, অসহায় উদ্বাস্তু মেয়েদের বানানো হচ্ছে যৌনদাসি, চলছে উদ্বাস্তু বাচ্চাদের অংগ বিক্রির প্রতিযোগিতা। ইন্টারনেটের এই যুগে এমন যুদ্ধ কি কারো কাম্য?

ইউক্রেনের বর্তমান নেতা ভ. জেলেনস্কির একটি উক্তি “ইউক্রেনের সুতা পরিমাণ ভূমিও ছাড়ব না” না ঠিককথা নয় এটি। ক্রিমিয়াতে যাওয়ার জন্য রাশিয়ার করিডোর দরকার এটাই প্রধান কথা, আর সেটা না হলে রাশিয়া হয়ে পড়বে একঘরে, তাই কৃষ্ণসাগর তার চাই-ই। এটা দিতেই হবে, আর না দিলে আজ নয় কাল হউক ইউক্রেন হবে হিরোশিমা, নাগাসাকি।

ক্রিমিয়া রাশিয়া ও ইউক্রেনের জন্য এমনই একটা জায়গা যেটা দখলে না থাকলে কৃষ্ণ সাগরের উপর থেকে অধিকার চলে যায় আর সে অধিকার হারালে পৃথিবীর উপর নজরদারী জারি  রাখা কঠিন হয়ে যায়। সে অনুযায়ী সেখানকার রুশ ভাবধারার সরকার বুঝে হোক  আর না বুঝে বেলোরুশিয়ার রাজধানী মিন্সকে একটা চুক্তি করেছিল দনবাসকে স্বাধীন এলাকা ঘোষণা করার। কারণ একটাই- রাশিয়ার জন্য ক্রিমিয়াতে যাওয়ার করিডোর দেয়া।

রাশিয়া তার পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে। এ পরিকল্পনা আজকের নয়। ইউক্রেন এ পরিকল্পনা জানেনা তা আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা। এ প্রসঙ্গে অন্য আর একটি দেশের কথা মনে পড়ে গেল, মালয়শিয়াতে চাকরির কারনে আমি ৫ বছর অবস্থান করেছি, ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত। ওখানে তিন জাতির সহবস্থান ছিল ওই সময়ে, এখনকার কথা জানিনা। আমার উঠা-বসা ছিল মালশিয়ান চাইনিজদের সাথে। তাদের প্রায় ফ্যামিলিতে তিন থেকে ৬টি করে বাচ্চা। তারা বলেছিল জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা যখন মালেদের থেকে বেশি হব, হাঁ/ না ভোটে আমরা এ দেশের মালিক হব। সুতরাং ইউক্রেন ও জানে যে ক্রিমিয়া একদিন রাশিয়ার হাতে চলে যাবে আর স্থলপথে ক্রিমিয়াতে ঢোকার জন্য রাশিয়াকে জায়গা দিতে হবে। মাঝখানে মারিয়াপোল হল ‘শাঁখের করাত’, ধারেও কাটে ভারেও কাটে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালীন সময়ে ক্রুশ্চেভ যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তিনি ক্রিমিয়াকে নিয়ন্ত্রনের ভার দেন ইউক্রেনের উপর। এরপর সোভিয়েত ভেঙ্গে ক্রিমিয়া থেকে যায় ইউক্রেনের অংশ হিসাবে। কিন্তু রাশিয়ার হাত থেকে কৃষ্ণসাগরের  নিয়ন্ত্রন রাখার জন্য পুতিনের স্বপ্ন ক্রিমিয়াকে ফিরিয়ে এনে সেখানকার নিয়ন্ত্রন  নেয়া। সে উদ্দেশ্য সফল করার জন্য রুশভাষা প্রধান এলাকায় তিনি রুশদের বসবাসের জন্য পাঠিয়ে দেন। এটা সম্ভব হয়েছিল যখন রাশানপন্থি ইউক্রেনিয়ান সরকার ক্ষমতায় ছিল।

ক্রিমিয়াতে যখন রুশ ভাষীদের সংখ্যা বেশি হয় তখন রুশপন্থী ইউক্রেনিয়ান সরকার একটা হ্যা না ভোটের ব্যবস্থা করেও ক্রিমিয়া চলে যায় রাশিয়ার হাতে। কিন্তু এটা নিলেই হবেনা তাদের সেখানে যেতে হবে, করিডোর দরকার। দনবাস এলাকা দিয়ে ঢুকলে এটা সহজ হয়। তাই সেখানে একটা অস্থির অবস্থা তৈরি করা হল। শুরু হয়ে গেল  দুই ভাষার মানুষদের মধ্যে সংঘর্ষ।

অন্যদিকে সোভিয়েত যখন ভেঙ্গে যায়, ইউক্রেনের প্রায় আশিভাগ মানুষ পশ্চিমা ভাবধারার দিকে ঝুকে পরে। তৈরি হয় পশ্চিমা ব্লক, তারা কিছুতেই আর ফিরবেনা সোভিয়েত ধারায়। এই যে ইউক্রেনে বসবাসরত রুশ ধারার রাশান ও পশ্চিমা ধারার ইউক্রেনিয়ান তারা লাগিয়ে দেয় রায়ট, মারা যায় পনের হাজারের উপর মানুষ, এরা দুপক্ষের ই লোক।

ইতিমধ্যে পতন ঘটে রুশ ধারার সরকারের, ক্ষমতায় আসে পশ্চিমা ধারার সরকার। কোন ধারার মানুষ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন অন্য পক্ষের মানুষদের অবস্থা খারাপ হয় তা বলা বাহুল্য। ইতিমধ্যে পশ্চিমা ধারার সরকার ন্যাটোসহ পশ্চিমের সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেয়ার জন্য সোভিয়েত ভাঙ্গার পর পর ইউক্রেন দরখাস্ত জমা দিয়ে রাখে। পশ্চিমের নানা সংস্থা সেখানে কাজ করতে শুরু করে, টনক নড়ে যায় রাশান সরকারেরও।

রাশিয়া বা ভ.ভ. পুতিন ভাবলেন যদি আরও দেরি করে ফেলেন তখন  কৃষ্ণসাগরে  যাওয়ার পথ নাও পেতে পারেন। সেটা হলে বিশ্বের উপর নজর রাখা কঠিন হয়ে যাবে রাশিয়ার। ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিলে ন্যাটো তার সামরিক ঘাটি বানাবে ইউক্রেন ও রাশিয়ার সীমান্তে। এটা এখনকার রাশিয়া বা পুতিনের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন। যদিও এর আগে ন্যাটো যখন পোল্যান্ড, এস্তোনিয়াতে মিলিটারি বেস বানিয়েছে তখন কিছু বলেনি বা অর্থনৈতিকভাবে অতটা সমৃদ্ধশালী ছিলনা। ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিলে রাশিয়ার সব দরজা বন্ধ হবে তাতে কোন ভুল নেই, সে কথা চিন্তা করেও কৃষ্ণসাগরে করিডর নেয়া খুব দরকার হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের রাশিয়াপন্থি(বামধারা), ভারতপন্থি(বাম ধারা), চীনপন্থী(বামধারা), আরবপন্থি(ডান ধারা) ও পাকিস্থানপন্থি(ডান ধারা) মানুষ সবাই একযোগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন করছেন। এটা এশিয়া ও ভারত উপমহাদেশের জন্য একটি সুখবর। দীর্ঘদিন ধরে ভারত, চীন ও পাকিস্থানের মধ্যে যে রাজনৈতিক কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে তার একটা সমাধান হতে পারে। আমেরিকান-ইউরোপ-ইউকে পন্থিদের তেমন অস্তিত্ব আছে মনে হয়না।

নব্বই দশকে আমরা যারা ১৯৯১ এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ও ১৯৯১ এ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরে নুতন দেশগুলো থেকে পড়ালেখা শেষ করে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলাম তাদের ডিগ্রীকে পি এইচ ডি ডিগ্রী হিসাবে কেন গ্রহণ করা হবে এই মর্মে মামলা করা হয়েছিল। মামলাটি করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানপন্থি শিক্ষকগণ। আমার যে শিক্ষক বাদী হয়ে এ মামলাটি করেছিলেন তার সাথে পরীক্ষায় কাজ করতে করতে জানতে চাইলাম স্যার আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন কেন, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন তোমাদের ডিগ্রী কোন ডিগ্রী না, শুধু আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য থেকে ডিগ্রী করে আসলেই তা গ্রহণ করা হবে।

এ ধরণের আরও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম। তখন সব হেসেই উড়িয়ে দিতাম। কিছুটা খটকা লাগলেও আজ যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দুদলের শিক্ষকগণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বলেন আমরা সবাই রাশানপন্থি কিছুটা খটকা লাগলেও শুনে খুব ভাল লাগছে। রাজনীতি ও মতামতের শেষ বলতে কিছু নেই, এটা তাই ই প্রমাণ করে।

একটা বিষয় আমার কাছে পরিস্কার যে বিশ্বের অনেকেই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধকে বর্তমান রাশিয়া ও বর্তমান আমেরিকা-ইউরোপে-ইউকে র যুদ্ধ হিসাবে দেখছে। অনেককেই বলতে শুনছি যুদ্ধ হলে কিছু মানুষ মারা যাবে এটাই স্বাভাবিক। আমি বলি, যার যায় তার যায়!

ন্যাটো ও রাশিয়ার ঠান্ডা লড়াইয়ে ইউক্রেন ভুগছে, জীবন যাচ্ছে সাধারণের ।’ যদি ইউক্রেন ন্যাটো ব্লকে যায় তখন ন্যাটো তার মিলিটারি বেস তৈরি করবে ইউক্রেনের পূর্ব সিমানায় আর ইউক্রেন যদি রাশিয়ান ব্লকে যায় তখন রাশিয়া তার মিলিটারি বেস তৈরি করবে পশ্চিম সিমানায়। ইউক্রেন হারাল তার স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমিত্ব।পৃথিবীর প্রতিটা স্বল্পউন্নত দেশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ন্যাটো/রাশান ব্লকের কোন একটিতে অবস্থান করছে কিন্তু ইউক্রেনের মত এমন অবস্থা আর কোন দেশের নেই বা হবেনা বা হচ্ছেনা।

আমি ভাবছি তাদের কথা যারা মাথা উঁচু করে বলতে চেয়েছিল আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক, শুধুই সুন্দর করে জীবন বাঁচাতে চায়, ব্লক নিয়ে যাদের কোন ভাবনা নেই, রাশিয়া/আমেরিকা/ন্যাটো নিয়ে মাথাব্যাথা নেই তারাই হয়ে গেল ‘বলির পাঠা/শাখের করাত’ হউক সে রাশান বা ইউক্রেনিয়ান ভাষাভাষী।

আমার সব চিন্তা, ভালবাসা ও সহানুভূতি থাকল ইউক্রেনসহ বর্তমান বিশ্বের এ দুই ব্লকের যুদ্ধের কারণে যারা কষ্ট পাচ্ছেন সে সব সাধারণ মানুষ ও উদ্বাস্তুদের জন্য যারা শীতে, গরমে ও নানাভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আশা করছি সব যুদ্ধের অবসান ঘটবেই শীঘ্রই।

( শাহীন আকতার হামিদ, লেখক, গবেষক ও  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক )