মতামত

আইএলও কনভেনশন ১৩৮ এবং শিশু শ্রম

-ফজলুল কবির মিন্টু

কর্মক্ষেত্রের মৌলিক নীতিমালা এবং অধিকার সমূহকে বিবেচনায় নিয়ে আইএলও তার এ পর্যন্ত গৃহীত কনভেনশনগুলো হতে ৮টি কনভেনশেনকে মৌলিক কনভেনশন হিসাবে চিহ্নিত করেছে। উক্ত ৮টি মৌলিক কনভেনশনের নীতিমালা সমূহ হচ্ছে স্বাধীনভাবে সংগঠন করার অধিকার, যৌথ দর কষাকষির অধিকার, সকল প্রকার বাধ্য শ্রম নির্মূল করা, শিশু শ্রমের বিলুপ্তি এবং কর্ম সংস্থান ও পেশার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি। উপরোক্ত নীতিমালা সমূহ ১৯৯৮ সালের আইএলও’র মৌলিক নীতি এবং কাজের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ক ঘোষণাকেও সমর্থন করে। বাংলাদেশ আইএলও ঘোষিত ৮টি মৌলিক কনভেনশনের মধ্যে ৭টি কনভেনশন ইতিমধ্যে অনুসমর্থন করেছিল। শুধুমাত্র নিম্নতম বয়স সংক্রান্ত কনভেনশন ১৩৮ অনুসমর্থন করা থেকে বিরত ছিল। বিগত ২২ মার্চ সেটি অনুসমর্থন করে সবগুলি মৌলিক কনভেনশন অনুসমর্থন করার মাইলফলক অতিক্রম করেছে। তবে কিছু কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও জাতীয় দৈনিকে বাংলাদেশ আইএলও’র সবগুলো কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে বলে উল্লেখ করা হলেও বিষয়টা আদৌ সত্য নয়। বাস্তবে আইএলও’র মোট কনভেনশন সংখ্যা ১৯০টির মধ্যে বাংলাদেশ নিম্নতম বয়স সংক্রান্ত ১৩৮ নম্বর কনভেনশন সহ মোট ৩৪টি কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে মাত্র। সুতরাং সবগুলো কনভেনশন অনুসমর্থন থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে অবস্থান করছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, উক্ত ৮টি কনভেনশনকে আইএলও’র সদস্য রাষ্ট্র সমূহ কর্তৃক শ্রমিকদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় তথা মৌলিক অধিকার হিসাবে  স্বীকৃতি দিয়েই মৌলিক কনভেনশন হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। যেহেতু নিম্নতম বয়স সংক্রান্ত কনভেনশন ১৩৮, উক্ত ৮টি মৌলিক কনভেশনের অন্যতম সেহেতু উক্ত কনভেনশনটি অনুসমর্থন করা আর না করার মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য নাই। কেননা মৌলিক কনভেশন ঘোষণার মধ্য দিয়েই উক্ত কনভেশন সমূহ পালন করা আইএলও’র প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের জন্য এক ধরণের নৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে। ফলে ইতিমধ্যে ১৭৪টি সদস্য রাষ্ট্র আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুসমর্থন করেছে। অবশ্য এখনও ১৩টি দেশ কনভেনশনটি অনুসমর্থন করা থেকে বিরত রয়েছে। অনুসমর্থন না করা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মার্কিন যক্তরাষ্ট্রের নামও রয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে মার্কিন যক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশী সোচ্চার। মার্কিন যক্তরাষ্ট্রের চাপের কারনেই বাংলাদেশে গার্মেন্টস সেক্টরে শিশু শ্রম শতভাগ নিরসন হয়েছে বলে দাবী করা যায়।

বাংলাদেশ কনভেশন ১৩৮ অনুস্বাক্ষর করার পূর্বেই ২০০৬ সালে প্রণীত শ্রম আইনে শিশু ও কিশোর শ্রমিকের সংজ্ঞা, তাদের কাজের সময়  ইত্যাদি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। শ্রম আইন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশে ১৪ বছরের কম বয়সীদের শিশু  এবং ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের কিশোর বলা হয়। অন্যদিকে আইএলও কনভেনশন ১৮২ অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সী সকল মানুষ শিশু।

বাংলাদশের শ্রম আইনে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও শর্ত স্বাপেক্ষে কিশোর শ্রমিকদের সীমিত পরিসরে কাজের সুযোগ রাখা হয়েছে। কিশোর শ্রমিকদের কাজে নিযুক্ত করার অন্যতম শর্ত হচ্ছে –রেজিস্টার্ড চিকিৎসক হতে শারীরিক সক্ষমতার প্রত্যয়নপত্র ছাড়া কোন কিশোর শ্রমিককে কাজে  নিয়োজিত করা যাবেনা। কিশোর শ্রমিকদের কর্ম ঘন্টা কারখানা বা খনিতে দৈনিক ৫ ঘন্টা করে সাপ্তাহিক ৩০ ঘন্টা এবং প্রতিষ্ঠানে দৈনিক ৬ ঘন্টা করে সাপ্তাহিক ৪২ ঘন্টার বেশী কাজ করানো যাবেনা। এছাড়া কিশোর শ্রমিকদের সন্ধ্যা ৭ ঘটিকা হতে সকাল ৭ ঘটিকা পর্যন্ত করানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে – কিশোর শ্রমিকদের স্বাস্থের জন্য হানিকর ও ঝঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেয়া যাবেনা। বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০২৫ সালের সকল ধরণের শিশুশ্রম শতভাগ বিলোপ সাধনের লক্ষে একটি রোড ম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কারণে রোড ম্যাপ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ হোঁচট খেয়েছে। ফলে শিশু শ্রমিক নিরসনতো দূরের কথা বরং আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

আইএলও’র তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩২ লক্ষ শিশু শ্রমিক আছে যার মধ্যে ১৩ লক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে। মোট শিশু শ্রমিকদের ৫৬.৪ শতাংশ কৃষি খাতে, ২৫.৯ শতাংশ সেবা খাতে, ১৭.৭ শতাংশ শিল্প খাতে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। গৃহস্থালি খাতে শিশু শ্রমিক থাকলেও সঠিক গবেষণার অভাবে সুনির্দিষ্ট তথ্য নির্ণয় করা দুস্কর।

একটি দেশ বা সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে শিশু শ্রমের একটা যোগসূত্র রয়েছে। যে দেশ বা সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা যত বেশী অনুন্নত সে দেশ বা সমাজে শ্রম খাতে  শিশু শ্রমিকের যোগান সন্দেহাতীতভাবে বৃদ্ধি পাবে। ফলে আইএলও কানভেনশন বা কিংবা শিশু শ্রম বিলোপ সাধনের রোড ম্যাপ কোন কিছুই ফলপ্রসূ হবেনা যদি না দেশের সকল মানুষের ন্যুনতম জীবন ধারন উপযোগী আয় নিশ্চিত না হয় এবং একই সাথে দেশের ধনী-দরিদ্রের আয় বৈষম্য যদি কমানো না যায়।

শিশুরা বাগানের চারাগাছের মত। একটি বাগানের চারাগাছ গুলোকে যদি যথাযথ পরিচর্যা করা না হয়, তাহলে বাগান যেমন বিকশিত হয়না তেমনি দেশেরও বিকাশ সাধন হয়না যদি সে দেশের শিশুদের যথযথ পরিচর্যা করা না হয়। শিশু পরিচর্যার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে – শিশুদেরকে পেশাগত শ্রম থেকে দূরে রাখা। শিশুদেরকে পেশাগত শ্রমে যুক্ত করা মানেই হচ্ছে তার কাছ থেকে শৈশব কেড়ে নেয়া। শিশুর শৈশব মানেতো দূরন্তপনা, পুকুরে সাতার কাটা, মাঠে খেলাধূলা করা এবং এর পাশাপাশি লেখাপড়া করে নিজেকে আগামী দিনের দেশ পরিচালনার জন্য যোগ্য হিসাবে গড়ে তোলা। তাই দেশ-জাতি ও সমাজের স্বার্থে শিশু শ্রম নিরসন হওয়া খুবই জরুরী।

আইএলও কনভেনশন ১৩৮ এ শিশু শ্রম নিরসনের পাশাপাশি সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার উপর জোর দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করন করে সকল শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কেননা শিক্ষার স্রোত থেকে ঝরে পড়া শিশুরা পরবর্তীতে শিশু শ্রমে যুক্ত হয়ে পড়ে। যার কিছু চিত্র আমরা বিগত করোনা অতিমারির সময় বিশেষ করে ২০২০ এবং ২০২১ সালে আমরা দেখতে পেয়েছি।

শিশু শ্রম শুধু বাংলাদেশের সংকট নয়। এ সংকট বিশ্বব্যাপী। ফলে ১৭৪ টি দেশ আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুসমর্থন করা সত্ত্বেও এখনো বিশ্বে ২১ কোটি ৮০ লক্ষ শিশু শ্রমিক বিদ্যমান। সুতরাং শুধু কনভেনশন বা রোডম্যাপ করে শিশু শ্রম শতভাগ নিরসন অসম্ভব। শিশু শ্রম নিরসন করতে হলে ব্যাপক কর্ম সংস্থান, জীবন ধারন উপযোগী মজুরি এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে।

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি