মতামত

মহান মে দিবস

রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির সাথে শ্রমজীবী জনগণের সংহতি চেতনা জরুরি

– সুভাষ দে

পয়লা মে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের উৎসব, সংহতি চেতনার দিন। ১৮৮৬ সালের ১মে শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিক-জনতা ৮ ঘণ্টা কাজ, ন্যায্য মজুরি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আত্মদানের যে গৌরবগাথা রচনা করেছিলেন, তার মহিমা  ম্লান হয়নি বরং বিশ্বের খেটে খাওয়া মানুষ এই দিনটির মর্মবাণী থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে নিজেদের অধিকার চেতনা শানিত করে।
সভ্যতার নির্মাতা শ্রমজীবী মানুষ। মানুষের সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ, ভোগের সামগ্রী, বিপুল নির্মাণযজ্ঞ- এসব তাদের মেধা, শ্রম থেকে উৎসারিত, এককথায় সভ্যতার সচল রথের সারথি তারা। উন্নত দেশে শ্রমজীবী মানুষের সুযোগ-সুবিধা থাকলেও বিশ্বের অধিকাংশ দেশে তাদের জীবনযাপনের পাঁচালি খুবই করুণ। সুকান্তের কবিতার ভাষায়, তারা যেন সেই বাতিওয়ালা, সভ্যতার আলো জ্বালায় সবখানে অথচ তাদের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।
যে বিপুল শ্রমজীবী মানুষ গ্রামে ও শহরে দেশের উৎপাদন, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের চাকা সচল রাখছে, তাদের অধিকার, মর্যাদা ও জীবনমানের উন্নতির প্রশ্নে এখনো অনেক বিষয় অমিমাংসিত রয়ে গেছে।
গার্মেন্টস, স্বাস্থ্যসেবা, নির্মাণ, পরিবহন, হোটেল-বেকারি, চা, বস্ত্র এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের মজুরি এতই কম যে তাতে জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে পড়ে। জাহাজভাঙা শিল্প, রি- রোলিং, অবকাঠামো নির্মাণ, পরিবহন খাতে শ্রমিকদের অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়। শ্রমিক নির্যাতন, শ্রমিক ছাঁটাই ব্যাপক। করোনার সময় অনেক শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অনেকের বেতন কমে গেছে। গ্রামের কৃষি শ্রমিকরাও দুর্দিনে পড়েছেন। এক কথায় জীবনে সীমাহীন কষ্ট নেমে এসেছে।
পাশ্চাত্যের অনেক দেশে শ্রমিক ও পেশাজীবী মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন, আবাসন অর্থাৎ মৌলিক অধিকারের সুযোগ সম্প্রসারিত হয়েছে, সেখানে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন থেকে পার্লামেন্ট পর্যন্ত শ্রমিক মধ্যবিত্তসহ পেশাজীবী মানুষের ব্যাপক প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এর ফলে রাজনীতি ও সমাজে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহাল থাকতে পারছে।
পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে কিংবা স্বাধীনতার পরও কিছু সময় মে দিবসের উদযাপনে শ্রমজীবীদের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, লেখক-শিল্পীগণ অংশ নিতেন। শ্রমিক অঞ্চলে নানা অনুষ্ঠান থাকতো, বর্তমানে সে সব অনুপস্থিত। এখন মে দিবসের মিছিলে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও কর্পোরেট অফিসের লোকজন অংশ নেন। শ্রমিক আর সংগঠনের মিছিলে উপস্থিতি কমই থাকে।
ট্রেড ইউনিয়ন করার কথা বললে মালিক ও মালিকের ভাড়াটিয়া লোক, প্রশাসনের লোকজন নাখোশ হয়, নানা কায়দায় শ্রমিক নেতাদের ছাঁটাই করে। এলাকা থেকে বের করে দেয়। জীবন ধারণের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই শ্রমিকদের। শ্রমিকরা সাপ্তাহিক ঠিকমতো মজুরি পায় না। অবসরে যাওয়া শ্রমিকদের পাওনা বছরের পর বছর দেয়া হয় না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে, কারখানায় শ্রমিক কর্মচারীদের জীবন আরো দুঃসহ, অবর্ণনীয় কষ্টের। শ্রমিক নেতারা বিভিন্ন রাজনীতির ধারায় বিভক্ত। গণমাধ্যম এক সময় জনদরদি ভূমিকা পালন করলেও তারা শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ নিয়ে উচ্চকিত নয়। তারা শ্রমিক নির্যাতনের খবর চেপে যায়। সরকার, প্রশাসন, কর্পোরেট পুঁজি, মালিক রাজনৈতিক সংগঠন এখন সমস্বার্থের পাহারাদার। মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলছে মালিকরা। ধনস্ফীতিতে ইউরোপের দেশগুলিকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ এমন পরিসংখ্যান বিদেশি গবেষণা সংস্থার। অথচ যাদের শ্রমে, ঘামে, অর্থনীতি ঘুরছে, উৎপাদনের চাকা সচল থাকছে তা শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে। অথচ তারাই পড়েছে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার একেবারে তলানিতে। যে শক্তি-সুবিধা, পুষ্টি প্রয়োজন তার ছিটেফোঁটা তাদের ভাগ্যে জোটে না। দেশের সকল সম্পদ শতকরা ১০ ভাগের হাতে। পার্লামেন্টে শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি নেই। জাতীয় সংসদ, জেলা-উপজেলা, পৌর এমন কি ইউনিয়ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধির আসন দখল করে আছে ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিরা। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে শ্রমজীবী-পেশাজীবী মানুষের সমবেত হওয়া, সাংগঠনিক তৎপরতা চালানো, ট্রেড ইউনিয়ন করা, এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সংবিধানে যে সব মৌলিক ও মানবিক অধিকার পাওয়ার কথা জনগণের তা তারা পাচ্ছেন না। এমন কি যে সব মৌলিক সেবা দেওয়ার কথা রাষ্ট্রের সে সব পেতে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্ট, বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মান প্রাপ্তি এসব শ্রমজীবী মানুষের জন্য অলিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৩৬ বছর আগে শিকাগোর রাজপথে জীবনের যে মৌলিক দাবি উচ্চারণ করেছিল শ্রমজীবী মানুষ, সেই সব জীবনের দাবি যেমন কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, বিশ্রাম, বিনোদন, ন্যায্য মজুরি, মানুষের মতো মর্যাদা নিয়ে জীবনযাপন- আমাদের দেশে শ্রমজীবী মানুষকে সে সবের জন্য অনবরত সংগ্রাম করতে হচ্ছে আজো। কর্মক্ষেত্রের অনিরাপদ পরিবেশের কারণে প্রতিনিয়তই শ্রমজীবী মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীদের বেশ অবদান রয়েছে। তাদের শ্রমের মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন, নারী ও পুরুষের মজুরির ক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়েছে। অনেক শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত, গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন ভয়াবহ, এদের অধিকাংশই শিশু। প্রবাসী শ্রমিকদের বিরূপ পরিবেশে, কম মজুরিতে চাকরি করতে হয়। এসব দেশে আইএলও শ্রমনীতি যাতে অনুসরণ করা হয় সেজন্য আইএলওকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এটি এখন পরিষ্কার হয়েছে যে, শ্রমজীবী মানুষের বাঁচা-মরা, তাদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে, অধিকার নিয়ে উঠে দাঁড়াবার সংগ্রামে বৃহত্তর সমাজের অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ না হলে তাদের বঞ্চনাপূর্ণ জীবনের অবসান হবে না। এজন্য শ্রমিক, কৃষক, ক্ষুদ্র-প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতি-সামাজিক শক্তির জাগরণ প্রয়োজন। শ্রমিক আন্দোলনে মালিক ও কর্পোরেট গোষ্ঠী তথা ধনিক গোষ্ঠীর অনুগতদের প্রভাবমুক্ত করে তাদের স্বার্থের মিত্র তরুণ রাজনৈতিক কর্মী ও শ্রমিক স্বার্থে নিবেদিত শ্রমিক-কর্মচারীদের খুঁজে বের করতে হবে। সেই সাথে ন্যায্য মজুরি, জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে এবং মালিক, প্রতিষ্ঠানের অন্যায়, নির্যাতন ও ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন আইনি ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
অন্যদিকে শ্রমজীবী মানুষকে তাদের স্বার্থরক্ষার সংগ্রামের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং জাতীয় রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন, জীবনযাপনের সংকট-সমস্যাবলি-এসব বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষকে।
সভ্যতার যে আলোকবর্তিকা তাদের হাতে অর্পিত হয়েছে সে আলোর শিখা অনির্বাণ রাখতে শ্রমজীবী মানুষকে দায়িত্ববান ও শিক্ষিত সচেতন হয়ে উঠতে হবে। এ জন্য শ্রমিক, শ্রমজীবীদের সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির সম্পর্ক ও ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এই সব শক্তির সমন্বয় জাতীয় রাজনীতির গতিধারা নিয়ন্ত্রণ করবে। সরকার ও সরকারের বাইরে ধনীদের একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করে, সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করবে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা যাতে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় শ্রম আইন, বিধিবিধান মেনে চলে সে ব্যাপারে সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, কর্মঘণ্টা ও বাজার মূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে মজুরি নির্ধারণ, ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ, কর্মক্ষেত্রে বাসস্থান, যাতায়াত ও চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দেশের সকল নাগরিকদের জন্য সংবিধান অনুসারে সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদান, সুলভে সেবা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে তার ভূমিকা পালন করতে হবে।
রাষ্ট্র ও সমাজে গণতান্ত্রিক ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি ও আর্থিক বৈষম্য রোধ, মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ, কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের ভূমিকাই মুখ্য। এই ভূমিকা পালনে রাষ্ট্র ও সরকারকে বাধ্য করতে গণতন্ত্র ও সমাজপ্রগতির সংগ্রামে শ্রমজীবী, পেশাজীবী মধ্যবিত্ত সমাজসহ ছাত্র যুবশক্তি ও কৃষক সমাজের দৃঢ় মৈত্রী আবশ্যক।
লেখক : সাংবাদিক