মতামত

ন্যায্য মজুরী নিশ্চিত না করে ৮ ঘণ্টা কর্ম দিসব অসম্ভব

– ফজলুল কবির মিন্টু

১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ১৮৮৬ সালের মে মাসে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের হে মার্কেট চত্বরে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে শ্রমিকরা সমাবেশ করে। সমাবেশ চলাকালে পুলিশের গুলিতে ১১ জন প্রাণ হারায়।

উক্ত ঘটনাকে স্মরণ করে ১৮৯০ সাল থেকে ১লা মে বিশ্বব্যাপী অন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। মূলত তখন থেকে বিশ্বব্যাপী ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবস স্বীকৃতি পায়। এর আগ পর্যন্ত শ্রমিকের কর্ম ঘন্টার ব্যাপারে কোন নীতিমালা ছিলনা। দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের কাজ করতে হতো। কাজ আহার আর নিদ্রা- এই ছিল শ্রমিকের প্রাত্যাহিক জীবন।  মে দিবসের প্রভাবে পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। শ্রমিকের প্রতি মালিক ও রাষ্টযন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন শুরু হয়। শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি কিংবা তাদের সঙ্কট নিরসনের উদ্দেশ্য ১৯১৯ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও)। আই এল ও’র ১ম কনভেনশনে শ্রমিকের সর্বোচ্চ কর্মঘন্টা দৈনিক ৮ ঘন্টার কথা উল্লেখ আছে। অবশ্য বর্তমানে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে দৈনিক কর্মঘন্টা ৬ ঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে শ্রম আইন অনুযায়ী ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবস হলেও বাস্তবে আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখতে পায়। এখানে সকল সেক্টরেই শ্রমিকদেরকে নিয়মিত ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা কাজ করতে হয়।

সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ১৯৪৮ এর  ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদ,  অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ৭ম অনুচ্ছেদ এবং আই এল ও’র কনভেনশন ১৩১ এ একজন শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করে যাতে সে আত্ম সম্মান নিয়ে জীবন যাপন করতে পারে ও তার সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, এমন মজুরী নির্ধারন করার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের শ্রম আইনে ন্যূনতম মজুরী সংক্রান্ত ধারা  ১৪১ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি মোট ১১ টি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে মজুরী বোর্ড ন্যূনতম মজুরী সুপারিশ করে। যা অত্যন্ত জটিল এবং অবাস্তব বলে আমি মনে করি।  ফলে শ্র্মিক শ্রেণী বরাবরই ন্যায্য মজুরী পাওয়া থেকে বঞ্চিত রয়ে যায়। শ্রম আইনের এই ধারাটি সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা  এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির মূল চেতনাকে ধারন করেনা। ফলে শ্রম আইনের ধারা ১৪১ পরিবর্তন বাঞ্চনীয়। কেননা এ ধারাটি বিবেচনায় নিয়ে বাঙ্গালদেশের শ্রমিকদের জীবন ধারনের উপযোগী ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব।  অথচ ৮ ঘন্টা কর্মদিবস বাস্তবায়নে শ্রমিকেরন জীবন ধারণ উপযোগী ন্যায্য মজুরি বাস্তবায়ন খুবই জরুরী।

যতদিন শ্রমিক শ্রেণির ন্যায্য মজুরী নিশ্চিত হবেনা ততদিন পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীর ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস অলীক স্বপ্নই থেকে যাবে।

আমরা লক্ষ্য করি, আমাদের দেশে মালিক পক্ষ যেমন শ্রমিকদেরকে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য করে তেমনি বাঁচার মত মজুরি নিশ্চিত করার জন্য শ্রমিকরাও অনেক সময় কোন কারখানায় অতিরিক্ত কর্মঘন্টা না থাকলে ঐ কারখানাতে কাজ করতে আগ্রহী হয়না। আবার মালিক পক্ষও অনেক সময় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে তাদের অপছন্দের শ্রমিককে অতিরিক্ত কর্ম ঘণ্টা কাজ দেয়না। এই বিপরীত চিত্রের মূলে রয়েছে কম মজুরী। একজন শ্রমিক শুধুমাত্র দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করে যে মজুরী পায় , তা দিয়ে তার জীবন নির্বাহ করা অসম্ভব ব্যাপার অর্থাৎ ন্যায্য মজুরী নিশ্চিত না করে কেবল মাত্র আইন প্রণয়ন করে ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবস কখনোই প্রতিষ্ঠা করা যাবেনা।  তাই ৮ ঘন্টা কর্মদিবস প্রতিষ্ঠায় সবার আগে প্রয়োজন শ্রমিকের জীবন ধারনের মত ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা।

লেখকঃ সংগঠক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র