মতামত

ছাত্র ইউনিয়নঃ মানুষ গড়ার এক অনন্য পাঠশালা

– রবীন গুহ

আমার ছাত্র ইউনিয়নের জীবন খুব দীর্ঘ নয়।  আমি মোটামুটি একটা হিসেব করে দেখেছি সেটা দেড় হাজার দিনের কাছাকাছি। চার বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি, কিন্তু সাড়ে চার বছরেরও কম। আমার অর্ধশত বছরের জীবন পরিক্রমাতে অনেক বেশি সময় বলা চলেনা। তবে দিনের সংখ্যার বিচারে কম সময় হলেও, লড়াই সংগ্রামের তীব্রতা আর  রাজনৈতিক  ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বর্ণাঢ্য ঘটনার পরিমাপে সময়গুলো খুবই তাৎপর্য্যপূর্ণ। ইতিহাসে কখনো কখনো দেখা যায়, স্বল্প সময়ে অনেক কিছু ঘটে যায়, যা হয়তোবা অনেক লম্বা সময়েও ঘটেনা। চট্টগ্রামের দুটো স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজ আর দেশে-বিদেশে মিলিয়ে পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন কাটানোর সুযোগ হয়। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাঠশালা কোনটি, কোন কিছু না ভেবেই উত্তরে বলবো- ছাত্র ইউনিয়ন। হ্যা, ছাত্র ইউনিয়নই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাঠশালা। এখানে নিছকই ডিগ্রী বিতরনের শিক্ষা দেয়া হয়না। এখানে দেশপ্রেমের পাঠ দেয়া হয়, দর্শণ, মানব সভ্যতার ইতিহাস আর রাজনীতির পাঠ দেয়া হয়। সেই পনের বছর বয়সে এখানে এসেই প্রথম জানতে পারলাম, ঈশ্বর মানুষকে ধনী-দরিদ্র করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছে ব্যাপারটা তা নয়। এই যে বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা,তার জন্য দায়ী তাদের ভাগ্য নয়, দায়ী হচ্ছে বিদ্যমান সমাজব্যবস্হা। দায়ী হচ্ছে শ্রেণী শোষণ। মানুষের চাপিয়ে দেয়া শোষণ-নিপীড়ণ বন্ধ করে সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে মুক্ত মানুষের পৃথিবী গড়ে তোলা যায়না। এই ছাত্র ইউনিয়নেই শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইতে সামিল হওয়ার প্রথম দীক্ষা পাই। ছাত্র ইউনিয়ন নামক প্রতিষ্ঠানেই তরুণ বয়সেই একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচার বিরোধী যুগপৎ লড়াইয়ের সৈনিক হিসেবে নিজেকে নিবেদিত করার শপথ নেই।

তখন ‘৮৮ এর চব্বিশে জানুয়ারী। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে স্বৈরাচার এরশাদ শাহীর নির্দেশে পাখির মত গুলি করে মারা হয় ২৪ জন নিরীহ মানুষকে। এ বর্বরতা যেন পরাধীন ভারতে বৃটিশ বেনিয়াদের জালিওয়ালাবাদ হত্যাকান্ডকেও হার মানায়। ঘটনার বীভৎসতা দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্হায় মনে ভীষণ দাগ কাটে! এমন অন্যায় নিপীড়ন দেখে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মন বিক্ষুব্দ হয়। স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়ে দেখি সাম্প্রদায়িক শক্তির দৌরাত্ম-আস্ফালন। বছর তিনেক আগে এই কলেজেরই হোস্টেলে ছাত্র ইউনিয়নের সহযোদ্ধা শাহাদাতকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করা হয়। স্বৈরাচার আর সাম্প্রদায়িক শক্তির নিষ্ঠুর অত্যাচার নিপীড়ণে চারিদিকে একরকম ভয়ের রাজত্বই চলছে বলা যায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা, রগকাটা, হাত কাটা,পা-কাটা যেন নিত্যনৈমিত্তিক একটা ব্যাপার। এমন একটা সময়েই চট্টগ্রাম কলেজ ও জামালখান ওয়ার্ডে ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করি। সহপাঠী বন্ধুরা পদার্থবিদ্যা, গণিত, রসায়নসহ একেকটা বিষয়ে সিলেবাস শেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল, আমরা তখন কলেজিয়েট স্কুলের ক্লাসরুমে, সেন্টমেরিস স্কুলের ছাদে, সেন্টমেরিস স্কুল প্রাঙ্গন, ডিসি হিলের পাদদেশ, নিউমার্কেটের দোস্ত বিল্ডিং, দারুল ফজল মার্কেটে নগর অফিসসহ নানা জায়গায় বসে সন্মেলন, মিটিং করে সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টায় ব্যস্ত। আপাততঃ ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে নিয়োজিত থাকলেও মনে মনে কিন্তু বিপ্লবের আকাঙ্খা। পুরোনো সমাজ ভেঙে নতুন সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বুকে নিয়েই কাটে আস্ত সময়টা।

শহরের চট্টগ্রাম কলেজ, কমার্স কলেজ, চকবাজার সহ বিভিন্ন এলাকায় তখন জামায়াত শিবিরের দৌরাত্ম। ছাত্র ইউনিয়নেপ অসংখ্য নেতাকর্মীদের উপর নৃশংস হামলা চালিয়ে আহত করা হয়। অনেকের গলায় শিবিরের গুন্ডাদের চালানো কিরিচের দাগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও সেই একই অবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে আরো বেশি ভয়াবহ। এমন অবস্থায় ৮৯’র চাকসু নির্বাচনে বারো ছাত্র সংগঠনের প্যানেল যৌথভাবে শিবিরকে পরাজিত করে। শহর থেকে আমরা তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হয়েও নিয়মিত শিবির বিরোধী মিছিল মিটিংয়ে অংশ নিতাম। কখনো বা চুয়েটের নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল জিতিয়ে আনার জন্য সেখানে নানা কর্মসূচিতে অংশ নিতাম।

৯০ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। গঠিত হয় স্বৈরাচার বিরোধী সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য। চট্টগ্রামে বড় কিছু কর্মসূচির কথা বাদ দিলে নিয়মিত কর্মসূচিগুলো সফল করার জন্য অন্য যে কোন সংগঠনের তুলনায় ছাত্র ইউনিয়নের জমায়েতই ছিল বেশি। আন্দোলন সফল করতে আমাদের নেতা-কর্মীদের  ত্যাগ ও আন্তরিকতার কথা স্বীকার করতে কেউই দ্বিধা করতোনা। চট্টগ্রামে ফারুখ-ই-আজম বীরপ্রতিকের নেতৃত্বে যে প্রথম বিজয় মেলা আয়োজিত হয় সেখানেও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা অগ্রগামী ভুমিকা রাখে। দারুল ফজল মার্কেটের ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে  সংগঠনের কোন কাজ না থাকলে আমরা দৌড়ে যেতাম কাজীর দেউড়ির বিজয়মেলায়।

৯০ এর ডিসেম্বরে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিজয়ের পর চারিদিকে যখন ছাত্র-গণ আন্দালনের জয়জয়কার তখনই গোটা দুনিয়ার বিপ্লব-প্রত্যাশী মানুষের মত এদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মীদেরও হৃদয় ভেঙ্গে যায়। ৯১ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হতাশার জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সকলেকে, এতদিনের বিশ্বাসে বড় রকমের চিড় ধরে। অনেক সহযোদ্ধারাই যেন কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকে। তবে থেমে থাকেনা লড়াই। ৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে শুরু হয় ঘাতক দালাল নির্মূলের আন্দোলন। শুরুর দিকে খুব বেশি লোক সক্রিয় ছিল তা বলা যায়না। চট্টগ্রাম শহীদ মিনারে শহীদ জননী যখন আন্দোলনের শপথ করালেন অল্প সংখ্যক লোক বাদ দিলে শ’তিনেক লোকের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের। নানা ঝুঁকি মাথায় নিয়েই আন্দোলনের নানা কর্মসূচিতে আমাদের লোকজন স্ফতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহন করে। পরে ৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার এক প্রতিকী গণআদালতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গো-আজমের ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন। সেদিন আন্দোলনের যে বীজ বোনা হয়, কালের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে সারাদেশে গণ-জাগরণ সংঘঠিত হয়। এক পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ও কার্যকর করা হয়।

১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা বিশেববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস বিরোধী মিছিল চলাকালে সন্ত্রাসীরা গুলি করলে মিছিলের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মঈন হোসেন রাজু নিহত হন। সেদিনের সেই হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে রাজপথ কাপানো এক মিছিলে আমাদের কয়েকজন নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়। পরে যদিও ব্যাপক আন্দোলনের মুখে তাদের ছেড়েও দেয়া হয়। চট্টগ্রামের সেই সংবাদ পরের দিন চট্টগ্রামসহ দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় কয়েকটি ছবিসহ ছাপানো হয়।  রাজুসহ সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের সকল শহীদের স্মরণে নির্মিত হয় রাজু ভাস্কর্য। ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ. কে. আজাদ চৌধুরী এর উদ্বোধন করেন। এই ভাস্কর্য নিমার্ণে জড়িত শিল্পীরা ছিলেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী ও সহযোগী গোপাল পাল।

৯২ সালের ২৬ এপ্রিল। গৌরবের ৪০ বছর পালিত হয়। সারাদেশ ব্যাপী ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বর্তমান ও প্রাক্তনদের অংশগ্রহনে সাড়ম্বতার সাথেই উদযাপন করা হয়। সে বছরের এক অনুষ্ঠানে এক প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়ন নেতার কথা আমার মনে খুব দাগ কেটেছে। তিনি তখন আওয়ামী লীগের একজন নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য।

তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি তো একসময় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। আদর্শিক রাজনীতির যে শিক্ষা পেয়েছেন আওয়ামী লীগে যাওয়াতে সেটা কাজে লাগাতে পেরেছেন কি?

প্রতিউত্তরে তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগ থেকে সরে এসে আওয়ামীলীগের রাজনীতি করেন। উনি যে মাটির উপর দাড়িয়ে দেশ স্বাধীন করেন  সেই মাটিটা মূলতঃ আমরাই মানে ছাত্র ইউনিয়নের লোকেরা তৈরি করি। আমরা যারা সেসময়  ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আওয়ামী লীগে আসি  অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করি। আওয়ামী লীগের ভিতরে ও বাইরে ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের সবাই অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশের জন্য অবিরাম কাজ করছে।

ছাত্র ইউনিয়ন করতে এসে সব চাইতে বড় পাওয়া হলো এদেশের অসংখ্য মেধাবী, দেশপ্রেমিক  ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী সাংস্কৃতিক কর্মীদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাদের অনেকেরই বিখ্যাত হয়ে ওঠার পেছনে ছাত্র ইউনিয়নের যে অবদান, তা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি।

উচ্চ শিক্ষার উদ্যেশ্যে দেশের বাইরে চলে যাওয়াতে অনেকটা সময়ের আগেই আমার ছাত্র ইউনিয়ন জীবনের ইতি টানতে হয়। তবুও তিন দশক পরেও বলতে পারি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহন না করলেও ছাত্র ইউনিয়নের যে পাঠ নিয়েছিলাম  তার অনেকটুকু এখনো অন্তরে বয়ে বেড়াই। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার যে কোন লড়াইয় একাত্মতা পোষণ করি। সর্বোপরি এই লড়াইয়ে যারা নিজেদের নিবেদিত করেছেন, উৎসর্গ করেছেন তাদের অন্তরের অন্তঃস্হল থেকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। পরিশেষে বলবো, ছাত্র ইউনিয়ন মানুষ গড়ার এক অনন্য পাঠশালা। ছাত্র ইউনিয়ন পরিবারের( সাবেক বা বর্তমান) সবাইকে সংগঠনের ৭০ বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রক্তিম শুভেচ্ছা জানাই।