বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৪০)

-বিজন সাহা     

২০১৪ সাল। ইন্ডিয়া গেছি দেড় মাসের ট্রিপে। কাজ বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে নিজের গবেষণার উপর সেমিনারে বক্তব্য রাখা আর একই সাথে আমার কর্মস্থল জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ সম্পর্কে স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের জানানো। যদিও এর আগে পাঁচ বার এদেশে এসেছি, তবে এবারই কাজের পাশাপাশি নিজের ইচ্ছেমত বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছি। ছোটবেলায় ইতিহাসের বইয়ে পড়া আগ্রা, দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই – এসব জায়গা দেখা হচ্ছে। কোলকাতা তো আছেই। যাহোক, সেই ট্রিপের এক পর্যায়ে গেলাম পুনা, বিখ্যাত ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি আর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে, ১০ দিনের জন্য। এখানে আমি অবশ্য আগেও এসেছি ১৯৯৭ সালে আপেক্ষিক তত্ত্বের উপর আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিতে। ভারতে সব জায়গায়ই খাবার দাবারে ভেজ আর ননভেজ সিস্টেম। রাশিয়াতে অবশ্য সেরকম কিছু নেই। আমার বন্ধুদের কেউ কেউ ভেজ, তবে সাধারণ ক্যাফে রেস্টুরেন্টে এসবের বালাই নেই। ইদানীং অবশ্য অনেক মাংসেই হালাল লেখা থাকে। যাহোক, যেহেতু গেছি বিভিন্ন রিসার্চ সেন্টারে, থাকি ওদের গেস্ট হাউজে। সেখানেই খাবার ব্যবস্থা। এসব সেন্টারগুলো শহর থেকে দূরে অথবা কমবেশি রেস্ট্রিক্টেড এলাকায়। তাই এখানে খেয়ে নেয়াই ভাল। এর আগে কোলকাতা, ভুবনেশ্বর আর চেন্নাই হয়ে পুনা এসেছি, পুনা থেকে গেছি মুম্বাই, এলাহাবাদ, দিল্লি। চেন্নাই আর মুম্বাইয়ে খাওয়া দাওয়া ক্যান্টিনে – তাই সব আগে থেকেই রেডি। ইচ্ছে মত নিয়ে নিলেই হল। অন্যান্য জায়গায় মেসে খেতে হয় বিধায় আগের দিন বলে দিতে হয় কে কি খাবে, মানে ভেজ না ননভেজ। কিন্তু পুনায় সপ্তাহে মাত্র দুদিন ননভেজ, সেটাও আবার আগের দিন দুপুরে অর্ডার দিলে। ইউরোপে যেমন ননভেজ স্বাভাবিক খাবার, ভেজের জন্য স্পেশালি বলতে হয়, ইন্ডিয়ায় তার উল্টো। যাহোক, সব জেনে আমি যথারীতি ননভেজ অর্ডার দিলাম। পরের দিন খেতে গিয়ে দেখি মাংস নেই। মহামুস্কিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমি ছাড়া কেউ আর ননভেজ অর্ডার দেয়নি, তাই ওরা আমার একার জন্য মাংস করেনি। এরপর অবশ্য আমি আগে থেকেই জনা দুয়েক ছাত্রকে বলতাম ননভেজ অর্ডার দিতে আর আমি ওদের মাংসটা নিজেই খেয়ে নিতাম। আসলে আমি যে মাংস ছাড়া চলতে পারি না সেটা কিন্তু নয়, বরং সুযোগ থাকলে ধুমছে সবজি খাই। তবে রাশিয়ায় শুধু সবজি খেয়ে টিকে থাকা কষ্ট। শুধু কষ্টই নয়, ব্যয়বহুলও। সত্যি কথা বলতে কি, প্রথম দিন মাংসের অর্ডার দিয়েও যখন সেটা পেলাম না তাতে বেশ আপসেট হলাম। কিন্তু নিজেই প্রথমে বুঝতে পারিনি এর কারণ। প্রথমত মাংস না খেয়েও দিব্যি দশটা দিন কাটিয়ে দেয়া যায়। দ্বিতীয়ত চাইলেই একটু দূরে বাইরে দিয়ে রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসা যায়। এই মাংস না থাকাটা তো ফাটাল কিছু নয় যে এ নিয়ে ভেঙ্গে পড়তে হবে। তাহলে? পড়ে বুঝলাম, এটা আসলে স্বাধীনতার অভাব। মানে আমার স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। মাংস থাকলেই যে আমি খেতাম বা খেতে হত তার কোন মানে ছিল না, কিন্তু খেতে চেয়েও সেটা না পাওয়া – এ কারণেই এমন আপসেট হওয়া। ছোটবেলায় বাড়িতে প্রচুর জমিজমা ছিল, রমরমা ব্যবসা ছিল। খাবার দাবারের কোনই অভাব ছিল না, তবে খেতে ইচ্ছে করত না। মাছ বলতে গেলে খেতাম না, মুড়ি মুড়কি এসব খেয়েই পেট ভরিয়ে ফেলতাম, ভাত খেতে চাইতাম না। মা বলতেন, “ঘরে ধান, দুয়ারে ধান, অন্ন বিনে যায় প্রাণ।” তখন পাড়ার অনেকেই ঠিকমত খেতে পেত না। আজ বুঝি আমার না খাওয়া ছিল শখের আর ওদের নিরুপায় হয়ে। আজকাল অবশ্য কয়েকদিন ভাত না খেলে মনে হয় কি যেন খাওয়া হয়নি, নুডলস, গ্রেচকা বা অন্যান্য যাই খাই না কেন, দু তিন দিন পেটে ভাত না পড়লে মনে হয় সেখানে আগুন লেগেছে।
২০১৬ সালে দেশে ফেরার সময় দুবাই এয়ারপোর্টে আলাপ হল একদল বাংলাদেশি ছেলে সাথে। জানলাম ওরা কাতারে কাজ করে। সেখানে ফুটবলের বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম তৈরির কাজে নিযুক্ত। অনেকে মিলে একসাথে থাকে। আছে পাকিস্তানি, ভারতীয় আর বাংলাদেশি। ওদের খেতে দেয় রুটি, ছোলার ডাল এসব। সেই নিয়ে সমস্যা। ভাত ছাড়া এরা পারে না। অথচ পাকিস্তানি আর ভারতীয়রা দিব্যি এসব খেয়ে যাচ্ছে। সে থেকে কথা কাটাকাটি, মারামারি আর সবশেষে ডিপোরটেশন। আমার ধারণা ওদের মারামারির পেছনেও এই একটিই কারণ – চয়েজের অনুপস্থতি। আসলে জীবনে অনেক কিছুই আছে যা না করে দিব্যি বেঁচে থাকা যায়। একদল লোক উপাসনা করে, আরেকদল করে না। তাতে কেউই কিন্তু খারাপ নেই। নিজের নিজের মত করে সবাই ভাল আছে। একদল মানুষ ভাত খায়, অন্য দল রুটি। তাতে কি এসে যায়? সমস্যা তখনই যখন যারা ভাত খায় তাদের আপনি রুটি খেতে বাধ্য করেন আর যারা রুটি খায় তাদের ভাত খেতে দেন। সমস্যা তখনই যখন কারও সামনে কোন পথ খোলা রাখেন না। সমস্যা তখনই যখন আপনার ভাল লাগা, মন্দ লাগা, আপনার ভালমন্দের সংজ্ঞা অন্যের উপর চাপিয়ে দেন। রুশরা একটা কথা বলে – স্বাদ আর রং  নিয়ে তর্ক করতে নেই, কেননা একেক জনের রুচি একেক রকম।
ঐ টিপটাও তাই। টিপ না পরলে হয় না? হয়। শত শত বছর ধরে আমাদের দেশে খুব কম মানুষই হিজাব পরেছে, তাতে কি কারও কোন ক্ষতি হয়েছিল? এরকম প্রচুর কাজ দেখবেন যেটা না করে আপনি ঠিকই বেঁচে থাকবেন। এমনকি এমন অনেক কিছুই আছে যা আপনি কখনই করেন না। তারপরেও এসবের উপর যদি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় আপনার খারাপ লাগবে। কারণ এতদিন আপনার স্বাধীনতা ছিল এসব করার, এখন সেই স্বাধীনতা নেই। মানব সভ্যতার ইতিহাস – স্বাধীন হবার ইতিহাস। হ্যাঁ, স্বাধীন হবার ইতিহাস। সে সব সময় প্রকৃতিকে জানতে চেয়েছে, বুঝতে চেয়েছে একটা কারণেই – প্রকৃতির খামখেয়ালি থেকে মুক্তি পেয়ে নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার জন্য। এই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাই তাকে পাহাড়, নদী, সমুদ্র জয় করতে সাহায্য করেছে, সাহায্য করেছে শুধু আকাশ নয়, এমনকি মহাকাশ জয় করতে। আজ আমরা এই যে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির  জগতে বিশাল বিশাল পদক্ষেপে এগিয়ে চলছি – সেটাও সেই স্বাধীনতা লাভের জন্যই। এমনকি বিভিন্ন ধর্মও কিন্তু মুক্তির কথা বলে, হ্যাঁ জীবনের দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি, মৃত্যু থেকে মুক্তি। যেখানে মানুষ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে, মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে, অসুখ বিসুখের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে সেখানে কীভাবে আমরা মানুষকে বন্দী করে রাখতে চাই পর্দার আড়ালে, হরণ করতে চাই মানুষের টিপ পরার স্বাধীনতা?  আচ্ছা অতীতে তো অনেক কিছুই ছিল না। রেডিও ছিল না, টিভি ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না – তাহলে কি আমরা আজ সেটা ব্যবহার করব না? আরব দেশে বাংলা ভাষা ছিল না, সেখানে ভাত ছিল না, এমনকি গরুও ছিল না। তাহলে কি আমরা বাংলায় কথা বলব না, ভাত খাব না? কথায় বলে এক দেশের বুলি অন্য দেশের গালি। আমরা চাই আর না চাই, বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যই বিভিন্ন রককম পোশাক আশাক পরতে হয়, বিভিন্ন রকম খাবার খেতে হয়। তাই আমরা যদি সেই হাজার বছর আগে কে কি পরল আর কে কি খেল আর কি খেল না এটা দিয়ে বর্তমানের জীবনযাত্রার ভাল মন্দ নির্ধারণ করতে চাই তাহলে তো বর্তমানের সব কিছুই আমাদের বর্জন করতে হবে। তাই যারা ভাবছেন বা বলছেন সামান্য টিপই তো, এটা পরলে বা না পরলে কি আসে যায়, তাদের বলি এটা আসলে আইসবার্গের উপরেরটুকু, এখন প্রতিবাদ না করলে শুধু টিপ নয়, ভাষা, সংস্কৃতি এসবও হারিয়ে বসতে হতে পারে একদিন।
অনেক দিন দেশের বাইরে আছি। অন্য সব দেশে কেমন জানি না, তবে রাশিয়ায় যেটা ভালো লাগে তা হল কেউ কারও ব্যাপারে সাধারণত নাক গলায় না। কল্পনা করতে পারবেন না তাতে কত সময় এদের বেঁচে যায়। যে সময়টা অন্যেরা কি পরলো, কে খেলো সেটা ভেবে কাটান, সেই সময়টা যদি অন্য কোন কাজে, এমনকি যদি প্রার্থনা করেও কাটান দেখবেন মনের শান্তি কতটা বেড়ে গেছে। যেদিন থেকে অন্যের পায়ে তেল না মেখে অন্যের ছিদ্র অন্বেষণ না করে নিজের চরকায় তেল দিতে শুরু করবেন দেখবেন অনুভূতি এতটা তীব্র থাকবে না, জীবন এমনিতেই অনেক সুন্দর আর শান্তিপূর্ণ হবে।

তার চেয়েও বড় কথা এই টিপ বিতর্কে কিন্তু আমাদের নিজেদের পরিচয় নিয়েই তো বিপদে পড়তে হবে। কেন? অনেকেই বলছেন টিপ ছিল পতিতার প্রতীক। আচ্ছা এই ভারত উপমহাদেশে যেখানে বিবাহিতা তো বটেই, মহিলা মাত্রেই টিপ পরতেন আর ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষ আমরা প্রায় সবাই এই মাটিরই সন্তান, সেই সব টিপ পরা মহিলাদের উত্তরসূরি – এভাবে কি নিজেদের জন্মকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছি না? নাকি নিজেদের পতিতার উত্তরসূরি বলে স্বীকার করি বলেই এরকম উদ্ভট যুক্তি তুলে দেশ ও জাতিকে বিভ্রান্ত করি?

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া