মতামত

‘নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’

– সুভাষ দে

ধরিত্রীর এক গভীর অসুখের মধ্যদিয়ে আমরা বিগত বছর পার করে এসেছি। করোনা ভাইরাস নামের মহামারি বিশ্বে ৬০ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। করোনার সময় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি সহমর্মিতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার যে দৃষ্টান্ত রেখেছে তাতে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার কথা চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছে মানুষ। করোনা ভাইরাস কেবল রাষ্ট্রীয় নীতি বা একদেশীয় সামর্থের কোন ব্যাপার নয় বরং এটি এখন বিশ্বায়নের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। করোনার সময় আমরা উপলব্ধি করেছি প্রতিটি মানুষের সুস্থতাই সামষ্টিক সুস্থতা। বিশ্বের ধনী ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি গরিব ও অনুন্নত দেশগুলির সম্পদ লুণ্ঠনে বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ উত্তেজনা, সংঘাত, ভ্রাতৃঘাতি হানাহানির মধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নিক্ষেপ করেছে তাদের সমর কূটনীতি দিয়ে, তারা নিজেরাই করোনার সামনে অসহায় বোধ করেছে।
করোনা এখনো সম্পূর্ণ নির্মূল না হলেও মহামারি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। টিকা গ্রহণ ও কিছু ওষুধ করোনার প্রতিষেধক হিসেবে সুফল দিয়েছে। বলা যেতে পারে আমরা বিপন্ন সময় অতিক্রম করে এসেছি। এখন বিশ্বের মানুষ করোনা উত্তর একটি মানবিক ও সহিষ্ণু সমাজের আকাক্সক্ষা করছে। প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান তৈরির বিষয়টি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় জরুরি হয়েছে। নববর্ষে আমাদের দেশ ও সমাজে এই প্রত্যাশার আলো ফুটুক -বাংলাদেশের মানুষ তা একান্তভাবেই কামনা করে।
বাঙালির মিলিত প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। এটি এখন বিশ্ববাঙালির আনন্দ সম্মিলনের রূপ নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাঙালি সমাজ পহেলা বৈশাখে নববর্ষকে স্বাগত জানাবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালি কি ঘরের আঙ্গিনায়, মেঠো পথে, মেলায়, সাংস্কৃতিক উৎসবে সকলকে আহ্বান জানাবে উদার চিত্তে, প্রাণের আবেগে। গ্রামীণ জীবনে স্বজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, গ্রামবাসী মিলে যে সম্প্রীতির আবহ তৈরি হয় তা আমাদের সমাজকে মানবিক বন্ধনে জড়িয়ে রাখে। নাগরিক জীবনেও নানা উৎসব, বর্ণিল সমাবেশ, পারস্পরিক প্রীতি সম্ভাষণ সকলকে যুক্ত করে নব উদ্দীপনায়। আমাদের দেশের পার্বত্যাঞ্চলের আদিবাসী জনজাতি তাদের লোকায়ত ছন্দ, আনন্দ নিয়ে ‘বৈসাবি’ উৎসব উদযাপন করছে, দেশের অন্যান্য স্থানের আদিবাসীদের নানা লোকাচার ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অনুষঙ্গ হিসেবে পহেলা বৈশাখের বরণ উৎসব আমাদের সংস্কৃতির বিপুল বৈচিত্র্য ও প্রাণময়তাকে মনে করিয়ে দেয়। বিশ্বের নানা দেশের বাঙালি সমাজের উৎসব পহেলা বৈশাখ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে সম্প্রীতির বার্তা দেবে।
করোনাউত্তর বাংলাদেশে আমরা অন্য এক অর্থনীতি, অন্য এক সমাজ চাই, করোনায় বিষাদ আর স্বজন হারানোর বেদনা থেকে আমরা নূতন বছরে শান্তি, সম্প্রীতি আর মানবিক সমাজ চাই। বৈষম্য, মূঢ়তা, ধর্মীয় উগ্রতা, ক্ষমতার দাপট, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী দুর্বল ও প্রান্তিক মানুষের ওপর নানা ধরণের উৎপীড়ন সমাজ ও রাষ্ট্রে ক্ষত তৈরি করছে, সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা করছে। আমাদের রাষ্ট্রের বৈষয়িক উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু সমাজের পিছিয়েপড়া গতি, সমাজমানসে নানা বিভক্তি, মতান্ধ বিশ্বাসের ফিরে আসা রাষ্ট্রের অগ্রগতিকেই পিছু টানবে। আমাদের এই বিশ্বাস দৃঢ় করতে হবে যে, জাতীয় উন্নয়নের জন্য সামাজিক সুস্থিতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও উদার সমাজচিন্তা জরুরি। বাঙালির সমাজ ও মানসচিন্তায় একদা এসবের প্রবল অধিষ্ঠান থাকলেও এখন রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্যপ্রবণ গোষ্ঠীর রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক শ্রেষ্ঠত্ব মতবাদ, সমাজের প্রতাপশালী, ধনবানদের দাপট বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানছে। এর বিরুদ্ধে সামাজিক জাগরণ চাই। নববর্ষে তাই হোক সম্মিলিত অঙ্গীকার।
বাংলাদেশ ছোট রাষ্ট্র হলেও এর সংগীত, চিত্রকলা, প্রত্নতত্ত্ব, লোকায়ত জীবনের নানা অনুষঙ্গ তথা সংস্কৃতির বিপুল ঐশ্বর্য বিশ্বসভায় স্বীকৃতি পেয়েছে। এর কয়েকটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে। কয়েক বছর আগে পহেলা বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান করে নিয়েছে । এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’। আমাদের জীবনকে যা কিছু মলিন করেছে, তার অবসান ঘটিয়ে শুভ সুন্দর আর কল্যাণের নির্মল আবহে প্রতিটি মানুষের জীবন আলোকিত হোক-এই প্রার্থনা নববর্ষে।
করোনার দুর্যোগ বলে দিচ্ছে, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের সংহার নয় আর, সজীব বাংলাদেশ চাই- যেখানে উন্নয়ন অগ্রগতির, সাফল্যের মূল কেন্দ্রে থাকবে মানুষ। লোভ, মুনাফা, স্বার্থপরতা বৈষম্যের যাঁতাকালে পিষ্ট মানুষের ক্রন্দন আর নয়। রোগে শোকে, বিপদে-বিপন্নতায় মানুষের জন্যেই সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত হোক।
যুদ্ধের অবসান হোক বিশ্বে; প্রকৃতি, পরিবেশ, জলবায়ুর বিরূপ রূপান্তরের বিরুদ্ধে লড়াই হোক এক সাথে, মৈত্রী ও সহযোগিতায় রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সুসম্পর্ক হোক।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন/মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীর কাছে’। ধরিত্রীর আকাশ, মৃত্তিকা, বায়ু, জল, তৃণ, পশুপাখি, পাহাড়-নদী এর সবকিছুই আমাদের সতেজ আর সবল শ্বাস নেওয়ার উপকরণ। আসুন, আমরা ধরিত্রীকে সাজাই নবরূপে, নিজেদের জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোকিত করতে সকল সামর্থ উজাড় করে দিই।
বিদ্রোহী কবি নজরুলের কথায় বলি,
‘আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত,
গিরি গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর, বীর্যবান’