বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৩৮)

-বিজন সাহা     

এক বন্ধু তার স্ট্যাটসে লিখল আমরা কেন রবীন্দ্র সঙ্গীতকে আধুনিক গান হিসেবে শুনতে পারি না। তাঁর মত আধুনিক করে কেউ তো লেখেননি, সুর করেননি। তাই তাঁর অনেক গান আমাদের “রবীন্দ্র সঙ্গীত” হিসেবে শোনা বন্ধ করা উচিৎ।

আসলেই তো তাই। তাহলে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা রবি ঠাকুরের নয়, আমাদের। কালোত্তীর্ণ লেখা সব সময়ই সমসাময়িক বা আধুনিক। আসলে আমরা যারা তাঁকে বিশুদ্ধ রাখার চেষ্টা করি তারাই আসলে তাঁকে সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে কুলীন ব্রাহ্মণ সাজাই। লেখকের অধিকার তাঁর লেখার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়, পড়ার সময় শুরু হয় পাঠকের অধিকার। পারসেপশন বা উপলব্ধি একান্তই ব্যক্তিগত। যারা পারসেপশনে বিশুদ্ধতার নামে অন্ধভাবে হস্তক্ষেপ করে তারা মৌলবাদী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে রবীন্দ্র মৌলবাদী।

রুশরা বলে সত্যটা সব সময় মাঝামাঝি কোথাও থাকে। কিন্তু সেই মাঝ পথ খুঁজে বের করা কি এতই সহজ? সহজ আবার কঠিনও। কারণ এই মাঝখানটা কোন ভৌগলিক কিছু নয়। তাছাড়া এটা খুবই ফ্লেক্সিবল। তাই সেই মাঝ পথটা নির্ণয়ের জন্য ছোট বড় অনেক কিছুই বিবেচনায় নিতে হয়। কিন্তু মানুষ সব সময়ই বড় বড় ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় নেয় আর ভাবে ছোট ছোট জিনিসগুলো এমনিতেই বশে আসবে। সে ভুলে যায় বোঝার ওপর শাকের আটিও অনেক সময় ডিসিসিভ রোল প্লে করতে পারে। ফলে সেই মাঝ পথটা প্রায়ই অধরাই থেকে যায়।

যদিও আমরা গানের কথা দিয়েই শুরু করেছি তবে এটা শুধু গান নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তা হোক সে রাজনীতি, হোক বিজ্ঞান, হোক ধর্ম বা অন্য কিছু। আসল কারণ হল মহাবিশ্বে সব কিছুই পরিবর্তনশীল। ফলে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে শর্তসমূহ। আর একথা কে না জানে যে প্রতিটি বিশেষ সমস্যা বিশেষ হয়ে ওঠে এই সব শর্তের কারণে। আমরা যখন এই পরিবর্তিত বাস্তবতাকে মানে নতুন শর্তগুলো মেনে নিতে না পারি, এইসব শর্তের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের বদলাতে না পারি তখনই চিন্তায় আর চেতনায় আসে স্থবিরতা। এক সময়ের প্রগতিশীল চিন্তা হয়ে ওঠে চরম প্রতিক্রিয়াশীল।

মানুষ কখন তার অতীতকে আঁকড়ে ধরে? যখন ভবিষ্যত প্রজন্মকে দেবার মত নতুন কোন আইডিয়া তার না থাকে। এটা আমরা দেখেছি সোভিয়েত ইউনিয়নে। যখন সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের স্লোগান দিয়ে কাজ হচ্ছিল না তখন জানালা দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে যাতে বাইরের বাতাস এসে ভেতরের সব কিছু লণ্ডভণ্ড করতে না পারে। কি এই বাতাস? তথ্য। বাইরের মানুষ কিভাবে জীবন যাপন করছে সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য। বাইরের সমাজ সম্পর্কে সঠিক তথ্য। এটা সোভিয়েত ব্যবস্থার সমস্যা নয়, এটা যেকোন ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ব্যবস্থারই সমস্যা। আর সেটা যে ঠিক তার প্রমাণ আমরা পাই বর্তমান ইউরোপ আর আমেরিকাকে দেখে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যে ভিন্নমত  ছিল না তা নয়, তবে তা ছিল মূলত রান্না ঘরে। তবে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন আড্ডায় অনেক সোভিয়েত বন্ধুর মুখেও সমাজের সমালোচনা শুনেছি। এছাড়া জিনস থেকে শুরু করে কালো বাজারে বিভিন্ন বিদেশী পণ্য কেনা সেটাও ছিল এক ধরণের প্রতিবাদ। প্রায় একই ঘটনা আমরা দেখি বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বে। এখানে যেমন বিবিসি বা ভয়েজ অফ আমেরিকার প্রচারে বিঘ্ন ঘটানো হত এখন পশ্চিমা বিশ্বে একই ভাবে রুশ সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা হয়। যদিও বলা হয় রুশ প্রোপ্যাগান্ডার কথা, কিন্তু এটা আসলে ভিন্ন মত প্রকাশে বাধা দেয়া। আর ভিন্ন মত প্রকাশে আমরা তখনই বাধা দিই যখন নিজের মত সম্পর্কে আর আগের মত নিশ্চিত হতে পারি না। অবশ্যই পশ্চিমা বিশ্বে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে আর এ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, তবে মেইন স্ট্রীম মিডিয়ায় যে ভিন্ন মত প্রকাশের সুযোগ যে খুবই কম সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আর তার কারণ এখন সরকার বলতে গেলে ক্ষমতার রথের মেলায় বড় বড় কর্পোরেশনের প্রতিনিধি আর মিডিয়াও সেই সব কর্পোরেশনগুলোর মুখপাত্র। তাই মিডিয়া হয় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির সমালোচনা করে অথবা স্বপক্ষের রাজনৈতিক দলের প্রশংসা করে। আসলে বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কেউ নিজের সবলতার কথা বলতে পারে না বা বলে না, বলে প্রতিপক্ষের দুর্বলতার কথা।  কেন বলে না? কারণ বলার কিছু নেই। ভোগবাদে অভ্যস্ত মানুষ আর আদর্শে বিশ্বাস করে না। সে চায় ম্যাটেরিয়াল ওয়েল-বিং বা বস্তুগত মঙ্গল। আর সে এটা চায় কম খরচে স্বল্প প্রচেষ্টায়। মানুষের এই কর্ম বিমুখতা একদিনে গড়ে ওঠেনি। বিগত কয়েক দশক ধরেই তাকে এভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। এটা মানুষের সৃজনশীলতা কমায় আর মানুষ যখন সৃজনশীল নয় তখন তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক সহজ। আর এ কারণেই আমরা মানুষকে হাতে গোনা কয়েকটা বইয়ের মধ্যে বেঁধে রাখি। মানুষকে যত অন্ধকারে রাখা যায় তাকে তত সহজে নিজের কাজে লাগানো যায়।

টেকনোলজি একদিকে যেমন আশির্বাদ, অন্যদিকে তেমনি অভিশাপ। দোষ অবশ্য টেকনোলজির নয়, যারা সেটা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের। কোন কিছুর পূর্ণ চিত্রের জন্য সেটা সব দিক থেকেই দেখা দরকার, তবে টেকনোলজি ব্যবহার করে আজকাল এমনকি আংশিক চিত্রকে পূর্ণ চিত্র হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়। দেশের উন্নয়নের গল্প যেমন সত্য তেমনি সত্য এই উন্নয়নের নীচে পড়ে পিষে মরা অনেক সাধারণ মানুষের জীবনের করুণ কাহিনী। সমস্যা হল আমরা নিজ নিজ প্রয়োজনে এরকম হাজারো ন্যারেটিভের একটা নিয়ে পথ চলি। আংশিক সত্যকে চরম সত্য হিসেবে গ্রহণ করি। আর এটাই যে একদিন বিপর্যয় ডেকে আনবে না সেটা কে বলবে? তাই আমাদের দরকার সন্দেহ প্রবন হওয়া, সবকিছু বার বার যাচাই-বাছাই করে দেখা। আজ রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধেও আমরা সেটাই দেখতে পাই। চারিদিকে এত মিথ্যার ছড়াছড়ি যে জঞ্জাল সরিয়ে সত্যটা বের করাই কঠিন। কিন্তু সমস্যা হল অনেকেই নিজের তৈরি এই মিথ্যাটাই বিশ্বাস করে, অন্যদেরও বিশ্বাস করায়। এই মিথ্যা মিথ্যা খেলার পরিণাম কী হতে পারে সেটা আমরা ইরাকে দেখেছি। টেকনোলজি ব্যবহার করে সুন্দর ছবি পাওয়া যায় এটা সত্য আবার সেটা যে বাস্তব নয় সেটাও একই রকম সত্য। আবার তাসের ঘর যে যেকোনো সময়ই ভেঙ্গের পড়তে পারে সেটা আরও কঠিন সত্য।

ফিরে আসি আবার গানে।  বাড়িতে বরাবরই গান বাজনার রেওয়াজ ছিল। মস্কোয় আসার পর বাংলাদেশ কোরাসের সাথে জড়িত ছিলাম। এই জড়িত থাকার কারণে বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েদের সাথে অনুষ্ঠান করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। জানতে পেরেছিলাম বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েরা কি ধরণের গান গায়। আসলে গান তো অনেকগুলো জিনিসের সমন্বয়। কথা আর সুর তো আছেই, আছে গায়ক, আছে বাদক, আছে বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র। আমাদের সাথে সাউথ আফ্রিকার ছেলেমেয়েরা গাইত। ওরা গাইত খালি গলায়, অনেকটা রাশান অর্থোডক্স চার্চের গানের মত। কিন্তু তার যে শক্তি ছিল সেটা বলার মত নয়। সেটা ছিল আশির দশক, নেলশন ম্যান্ডেলা তখনও জেলে। আবার ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা আর আরবের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করত। আর সেগুলোও ছিল একে অন্যের পরিপূরক। আমাদের ছিল হারমনিয়াম, পিয়ানো আর তবলা। ওদের তুলনায় একেবারেই সাদামাটা। কিন্তু আমাদের দেশাত্মবোধক গানে অন্য রকম জোর ছিল। ছিল কথা। বিপ্লবের কথা। হ্যাঁ, গানে কথাটা প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রবীন্দ্র সঙ্গীতে। সেই বন্ধুর স্ট্যাটাসে একজন লিখেছে গানের সুরের কথা। অসাধারণ, চির আধুনিক সেই সুর। অনেক আগে মস্কোর এক শিল্পী একদিন বলল,

– আমাদের অনুষ্ঠানে যারা আসে তারা কেউই রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে না। তাহলে কি এটা গাইবার দরকার আছে?
– অবশ্যই আছে। ওরা অন্তত জানবে এমন কিছু গান আছে বাংলা ভাষায়।

আগেই বলেছি বর্তমানে অন্যতম প্রধান সমস্যা হল মানুষ ভাবে না, ভাবতে চায় না। অথবা তাকে ভাবতে শেখানো হয় না। শিক্ষার ক্ষেত্রে আজ উত্তর বেছে নিতে হয়, ভেবে লিখতে হয় না। আসলে বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থাই এমন – তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার হয়ে আমরা ভাবব। তোমার একটাই কাজ – আমরা যা বলি সেটা বিশ্বাস করা, যা করতে বলি সেটা করা আর আমাদের সব কাজে সমর্থন জানানো। এই যখন অবস্থা তখন মানুষকে নতুন করে কথা বলতে শেখাতে হবে, শেখাতে হবে ভাবতে। আর সে কারণেই সুরের চেয়েও বেশি দরকার রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো, ভাবনাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার। তিনি নিজেও তো সাধারণ মানুষের লোক হয়েই থাকতে চেয়েছিলেন। আমরাই পারি তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ করতে। তাঁকে, তাঁর লেখাকে সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে। আর শুধু তাঁকেই নয়, যারা সারা জীবন জীবনের গান গেয়ে গেছেন তাঁদেরকেও, তাঁদের কথাও।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া