মতামত

টিসিবির চালের লাইন ও বাসদের অর্থনৈতিক ভাবনা

– অপু সারোয়ার

টিসিবি

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের -টিসিবি।  খোলা বাজারের চেয়ে তুলনা মূলক কম দামে  চাউল – আটা তেলের মত জিনিস বিক্রির সুবাদে টিসিবি এর নাম দশ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। চাল ও আটা সহ প্রতিদিনের প্রয়োজনীয়  জিনিসের দাম  অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। জিনিস পত্রের দাম বাড়ার সাথে মানুষের বেতন বাড়ে নাই। গত কয়েক বছর  মহামারী – করোনার কারণে অসংখ্য মানুষ চাকুরী হারিয়েছে। মানুষের অতি প্রয়োজনীয় খাওয়ার জিনিস কেনার সার্মথ্য কমে গেছে। টিসিবির   চাল ও আটা সহ প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় খাওয়া বস্তু  কিনতে মানুষের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। শহর গ্রামে একই অবস্থা। টিসিবির চাহিদার চেয়ে কয়েক গুণ মানুষের ভিড় ও  বরাদ্দ স্বল্পতার কারণে অনেকেই পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। ভিড়ের কারণে পরপর কয়েক দিন লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ অনেক না পাওয়ার অভিযোগ মানুষের। । টিসিবির ট্রাকের পিছনে সামান্য দুই /এক কেজি চাউল – আটা জন্য ভীড় ও মানুষের কষ্টকর দৌড়াদোড়ির ছবি সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। টিসিবির খোলাবাজারের পণ্য কালোবাজারে বিক্রির প্রমাণিত অভিযোগ সংবাদ মাধ্যমে আলোচনার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এখানে সেখানে টিসিবির পণ্য কালোবাজারীর জন্য জেল – জরিমানার সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে  ।

টিসিবি সরকারী প্রতিষ্ঠান।  পণ্য বিক্রির জন্য বিভিন্ন ব্যাক্তি – প্রতিষ্ঠানকে ডিলারশিপ দিয়েছে টিসিবি।  টিসিবির ডিলারশিপ পাওয়ার  সুস্পষ্ট নীতিমালা মালা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। টিসিবি হচ্ছে  যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে রেশনের দোকানের মত। রেশনের দোকানের পণ্য কেনার জন্য আগে রেশন কার্ড করতে হত। দুই ধরণের রেশনের দোকান ছিল। সরকারী চাকুরীজীবি ও সরকারী চাকুরীজীবি নন এমন মানুষদের জন্য আলাদা রেশনের দোকান ছিল। এই ভূখণ্ডে সব সময়ই সরকারী চাকুরীজীবীরা জনগণের পয়সায় নিজেদের অনুকূলে প্রবাহিত করতে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে এসেছে।   শেখ মুজিবর রহমানের শাসন আমলকে কালিমা লিপ্ত করতে সেই সময়কার রেশনের দোকান গুলির ভমিকা একবারে কম  ছিল না। টিসিবির পণ্য কিনতে আগাম কোন কার্ড বা কোন সরকারী দপ্তরে নাম লেখানোর দরকার পড়ে না। যুদ্ধত্তোর রেশনিং পদ্ধতির সাথে টিসিবির খোলা বাজারে পণ্য বিক্রির পার্থক্য এই টুকু মাত্র।

জিডিপি – প্রবৃদ্ধি বিভ্রম

জিডিপি- Gross Domestic Product – মোট দেশজ উৎপাদন।   কোন দেশের  এক বছরে চূড়ান্তভাবে উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার বাজারে সামষ্টিক মূল্যই হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদন।  সাধারণ ভাবে জিডিপি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সূচক। । আগের বছরের তুলনায় পরের বছরে উৎপাদন যে হারে বাড়ে সেটি হচ্ছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি। সাধারণ ভাবে, দেশের  অর্থনৈতিক উন্নয়নের গ্রহণযোগ্য মাপকাঠি  জিডিপি। জিডিপি নিয়ে অনেক মোহ ও প্রচারণা রয়েছে।  উন্নয়ন অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন , জিডিপি – মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি মানেই উন্নয়ন। জিডিপি প্রবৃদ্ধির  সুফল উপর থেকে নিচের দিকের মানুষের কাছে যাবে।  নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়বে।  দেশের ভাবমূর্তি ও   বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি  বড় ভূমিকা পালন করে থাকে ।  এই সব কিছুই সরকারের কৃতিত্ব সামনে নিয়ে আসে। সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়তে জিডিপির প্রবৃদ্ধি সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে।  রাজনৈতিক মূল্য থাকার কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ঢোল – মাদল সরকারী  পৃষ্টপোষকতায় বহে নিরবধি ।

প্রবৃদ্ধি বাড়লে এর ছিটেফোঁটা চুঁইয়ে নিচে নামার অর্থনৈতিক পরিভাষা ‘ট্রিকল ডাউন’। ছিটেফোঁটা চুঁইয়ে পড়ার তত্ব থেকে অর্থনীতিবিদের অনেকেই দূরে সরে দাঁড়িয়েছেন। অথবা সমালোচনা বা পরিপূরক তত্ব অংশ জুড়ে দিয়েছে। মানুষের জীবনে উন্নতি ও জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য পরিমাপে জিডিপি অক্ষম। প্রবৃদ্ধি যত বাড়ে, আয় বৈষম্য বাড়ে তার চেয়ে বেশি।

জিডিপি ঘাপলা

বাংলদেশের জাতীয় আয় ও জিডিপির পরিমান সঠিক  তথ্য প্রকাশ নিয়ে সরকারী লুকোচুরি এখন প্রকাশিত সত্য। অধিকাংশ দেশের জিডিপি তিন মাস পর প্রকাশ করা হয়ে থাকে।  বাংলাদেশের জিডিপির হিসাব অর্থ বছর  ( জুলাই – জুন ) শেষে পুরো বছরের টা একসাথে প্রকাশ করা হয়। এই পদ্ধতির কারণে জুলাই – সেপ্টম্বর মাসের মন্দা ও মানুষের কেনার সামর্থের অভাব পরবর্তী বছরের জানুয়ারী -মার্চ মাসের অর্থনীতির তুলনা মূলক তেজী ভাব দিয়ে ঢেকে ফেলা সম্ভব। দৈনিক প্রথম আলো – ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ”  গত চার অর্থবছরেরই প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে কমে গেছে। ২০০৫-০৬ ভিত্তি বছরের হিসাবে, ২০২০-২১ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। নতুন হিসাবে তা ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি কমে ৭ শতাংশের ঘরে নেমেছে। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮৬ থেকে কমে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ হয়েছে।” । প্রথম আলোর অপর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ২০-২১ সালের জিডিপির ঘাপলা ও শুভঙ্করের ফাঁকি ” ২০২০-২১ অর্থ বছর জুড়েই অর্ধেক আসনে যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলেছে। কিন্তু বিবিএসের হিসাব বলছে, বিদায়ী অর্থবছরে বাস, ট্রাক, ট্রেন—এসবের মূল্য সংযোজন আগের বছরের চেয়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। নৌযান চলাচলে বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। করোনা শুরু হওয়ার পর বিমান চলাচল আর স্বাভাবিক হয়নি। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশের বেশি চলেনি। অথচ বিবিএস বলেছে, বিমান চলাচলে আগের বারের চেয়ে ৬৬ কোটি টাকা বেশি মূল্য সংযোজন হয়েছে। বিবিএসের হিসাবে করোনার বছরে পরিবহন খাতে আগের বারের চেয়ে ৬৫৩ কোটি টাকা বেশি মূল্য সংযোজন হয়েছে।”

অর্থিনীতির গতি প্রকৃতি বোঝার জন্য জিডিপি একটি মাধ্যম। কিন্তু শুধু মাত্র একমাত্র মাধ্যম নয়। আধুনিক জিডিপি আবিষ্কারক সাইমন কুজনেতস (Simon Kuznets) । সাইমন কুজনেতস নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থিনীতিবিদ । কুজনেতস নিজেই   জিডিপির দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন । জিডিপির প্রবৃদ্ধি মানুষের জীবন যাত্রার কোন প্রতিফলন নেই তা বোঝার জন্য অর্থিনীতির দুরূহ পাঠের দরকার পড়ে না। টিসিবির চালের লাইনে উপচে পড়া ভীড় জিডিপির প্রবৃদ্ধির প্রচারণাকে ম্লান করে দেয়।

শূন্য পকেটের মাথাপিছু আয় – জাতীয় আয়

মাথাপিছু গড় আয় ব্যক্তির আয় নয়. দেশের বার্ষিক মোট আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয়ের হিসাব করা হয়। জিডিপির পাশাপাশি জাতীয় আয় রাষ্ট্র ও অর্থনীতিবিদদের আলোচনার আদুরে বিষয়। বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ২২৭ ডলার। চমকে উঠা বা খটকা লাগার বিষয় বৈকি। ভোট না দিতে পারলেও প্রত্যেক নাগরিক যেমন ‘ভোটার। তেমনি জীবন চালাতে হিমশিম খাওয়া, টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো মানুষের আয় রোজগার তেমনি ফুলেফেঁপে একাকার! ২০২০-২১ অর্থবছর মাথা পিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। আগের তিন বছরেও প্রতিবার মাথাপিছু আয় গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ ডলার বেড়েছে।

৪  ও ৫ ফেব্রুয়ারী  ২০২২ সালে বাংলাদেশের প্রায় সব গুলি জাতীয় দৈনিকে চাঁদপুরের মতলব  উপজেলায় হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ দিতে অসমর্থ বাবা মায়ের ৫০ হাজার টাকায় সন্তান বিক্রির সংবাদ সামনে আসে। পরে প্রশাসনের সহায়তায় নবজাতক বেঁচে চিকিৎসা ব্যায় পরিশোধে বাধ্য বাবা-মা শিশুটি ফিরে পান। শিশুটি ফিরে পাওয়ার বিষয় বা  শিশু বিক্রিতে বাবা-মায়ের দুঃসহ যন্ত্রনা পৃথক আলোচনার দাবী রাখে। অর্থ শাস্রের ভাষায় ,শিশু বিক্রিতে বাধ্য হওয়া বাবা -মা এর  আয় বেড়েছে ৫০ হাজার টাকা। গড়ে  দুজনের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২৫ হাজার টাকা।  এই আয়ের অংশ বিশেষ ২৬ হাজার টাকা হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ পরিশোধ করা হয় । এই অর্থ সেবা খাতের আয়। এর প্রভাব পড়বে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি)। আর জিডিপির প্রবৃদ্ধি মানেই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি !

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ” বলেন, জিডিপির আকার বেড়ে যাওয়ায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তবে আগে একজন রিকশাওয়ালা যা আয় করতেন, এখনো তা–ই আয় করেন। ” পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, জাতীয় আয় বেশি দেখতে জনসংখ্যা কমিয়ে দেখাচ্ছে অভিযুক্ত পরিসংখান ব্যুরো।

গৃহস্থলীর কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন

ঘরদোর পরিস্কার, রান্না, খাবার দেওয়া, কাপড় ও বাসন ধোয়া, বয়স্কদের সেবা, সন্তান লালন-পালন ইত্যাদি কাজকে মুজরী হীন ঘরের কাজ  হিসেবে ধরা হয়। জীবন চলার জন্য এই কাজ গুলির বিকল্প নেই। আমাদের দেশে এই সব কাজে পুরুষদের অংশগ্রহণ খুব কম। এটা কোন গোপন বিষয় নয় যে নারীরা অপ্রত্যাশিতভাবে অবৈতনিক কাজের বোঝা বহন করে চলছে । একটি নির্দিষ্ট দিনে পুরুষদের তুলনায় মহিলারা কত বেশি অবৈতনিক ঘন্টা কাজ করেন তার সঠিক তথ্য নেই।  তবে বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়  সারা বিশ্বে নারীরা গড়ে ৪.৪ ঘন্টা অবৈতনিক কাজ করে এবং পুরুষরা মাত্র ১.৭ ঘন্টা। দেশে এই পরিসংখানের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। নরওয়েতে, ব্যবধানটি কম , সেখানে মহিলারা ৩.৭  ঘন্টা অবৈতনিক কাজ আর  পুরুষরা  ৩ ঘন্টা । অন্য দিকে , মিশরে, মহিলারা প্রতিদিন ৫.৪ঘন্টা অবৈতনিক কাজ এবং পুরুষরা মাত্র ৩৫ মিনিট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মহিলারা ৩.৮ ঘন্টা অবৈতনিক কাজ এবং পুরুষরা ২.৪  ঘন্টা করেন। ঘরের অবৈতনিক কাজের অর্থিক মূল্যায়নের দাবী নারীর সামাজিক অবদমন ও লিঙ্গ বৈষম্যের দুর্বিষহ চেহারাকে সামনে নিয়ে এসেছে। সারা বিশ্বেই নারীদেরকে ঘরের অবৈতনিক কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার জন্য সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অগ্রসর পুঁজিবাদী সমাজে নারীরা সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা  নিষেধকে পদদলিত করতে তুলনামূলক ভাবে সফলতা পেয়েছে। কিন্তু  বাংলাদেশ – পাকিস্তান- মিশরের মত  দেশ গুলিতে সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা যাঁতাকল নারী – পুরুষের ঘরের সমতা ভিত্তিক অংশ গ্রহণের প্রধান বাধা।

জিডিপি ও জাতীয় আয় পরিমাপের সীমাবদ্বতা নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা ও পর্যালোচনা ছিল এবং অব্যাহত আছে।  এই সমালোচনার অন্যতম  হচ্ছে গৃহস্থলীর কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন। গত আশি বছর ধরেই অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছে।  ঘরের কাজের অর্থনৈতিক মূল্য পরিমাপের সঠিক নিয়মতান্ত্রিক কোন প্রতিষ্ঠান দেশে গড়ে উঠে নাই। আমেরিকা ২০০৩ সাল থেকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে ঘরের অবৈতনিক কাজের অর্থনৈতিক পরিমাপ করে আসছে।  যখন নারীরা বাড়ির অর্থ উপার্জনের বাইরে পূর্ণ-সময়ে নিযুক্ত থাকে, তখনও  গৃহস্থালির কাজ এবং শিশুর যত্নের বড় অংশ নারীদের ঘাড়ে।  ঘরের অবৈতনিক কাজের মূল্যায়ন কিংবা জিডিপিতে যুক্ত করার  দাবী  লিঙ্গ বৈষম্য ও নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবদমনের বিরুদ্ধে সচেতন ও আন্দোলনের গুরুত্বকে সামনে নিয়ে আসে। শুধু মাত্র জিডিপিতে ঘরের অবৈতনিক কাজের মূল্যমান যোগ করার  মধ্যদিয়ে নারী লিঙ্গ বৈষম্য ও অবদমিত অবস্থার পরির্তন হয় না।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশের মোট জিডিপিতে নারীর স্বীকৃত শ্রম এবং আয়ের মূল্যায়ন করার কোন নির্ভরযোগ্য সরকারী বা সার্বজনীন প্রতিষ্টান নাই। হাল আমলে বিভিন্ন  এনজিও এই কাজে হাত দিয়েছে। আমাদের দেশের এনজিও গুলি প্রধানত ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে গরীব মানুষকে শোষণ করে আসছে। এর পাশাপাশি দেশের মানুষের দরিদ্র্য ও নানা ধরনের সামাজিক বৈষয়িক দেখিয়ে বিভিন্ন বিদেশী সংস্থার কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে কিছু কাজ সংস্কার মূলক কাজ করে থাকে। এনজিওদের সংস্কার মূলক কাজ বা স্লোগানের বিপরীতে সরকার থেকে আয়কর বিহীন ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ হাতড়িয়ে নিয়ে আসছে। ঘরের কাজের মূল্যায়ন ও পরিমাপ করা জরুরি। ঘরের অবৈতনিক কাজের  সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরার  জন্য ঘরের  কাজের স্বীকৃতি প্রয়োজন। পরিবারের সব কাজ নারী-পুরুষের ভাগাভাগি করে নেওয়া প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষার দরকার । ঘরের কাজে পুরুষের অংশ গ্রহণ  নারীর কাজের সুযোগ ও  ক্ষমতায়নের পথও সুগম করতে পারে। নারীর ক্ষমতায়নের  সাথে শিক্ষা নীতি সংস্কার ও বেকারত্ব দূর করার বিষয়টি গভীর ভাবে জড়িত।

বাসদ তোপখানার অর্থিনীতিবিদরা 

বাংলদেশের সমাজতান্ত্রিক দল – বাসদ চার দশকের খরা কাটিয়ে মার্চ ২০২২ শুরুতে প্রথম কংগ্রেস শেষ করেছে । পুলিশ ও আমলাতন্ত্রকে সংস্করণের দাবীর পাশাপাশি নারীদের গৃহস্থলী কাজের মূল্য কে জাতীয় আয়ের অন্তৰ্ভুক্ত করার দাবী জানাচ্ছে বাসদ । ( সূত্র : বাসদ লিফলেট -২৮ ডিসেম্বর ২০২১) । মার্ক্সসীয় পরিভাষায় পুলিশ ও আমলাতন্ত্র হচ্ছে শোষণ মূলক সমাজ ব্যবস্থার রক্ষক। পুলিশ হচ্ছে প্রচলিত রাষ্ট্রের লৌহ কঠিন বজ্র মুষ্টি। গণতান্ত্রিক দেশ গুলিতে  প্রাত্যাহিক জীবনে পুলিশ  জনগণের সাথে সৌজন্য মূলক ব্যবহার করে থাকে। তারপরেও  সবচেয়ে পরিশীলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশ প্রচলিত ব্যাবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য জনসাধারণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে কসুর করে না। ইন্টারনেটের কল্যানে যুদ্ধ বিরোধী শান্তিপূর্ণ মিছিল, পরিবেশ বিধ্বংসী বিরোধী মিছিল  গুলিতে সাম্রাজ্যবাদী দেশের ‘সভ্য ‘ পুলিশের নির্যাতনের চিত্র ভেসে বেড়ায়। আমেরিকার কালো মানুষের কাছে ‘বন্ধু বাৎসল্য’ পুলিশ মূর্তিমান আতঙ্কের সত্য কাহিনী সম্ভবতঃ বাসদের অগোচরে রয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়াযর  আদিবাসীদের সাথে অস্ট্রেলিয়ান ‘সভ্য’ পুলিশের আচরণ চরম বর্ণবাদী ও বৈষম্যবাদী। আমলাতন্ত্র সব দেশে  সব কালেই শোষণ মূলক ব্যাবস্থার রক্ষক। সাময়িক সংস্কার এই ব্যাবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে কথা বলার নামান্তর মাত্র। বাসদ – তোপখানা  কাগজে কলমে এখনো মার্ক্সবাদ-লেনিন বাদের কথা বলে। তবে লেনিনের ধারণার সাথে বাসদ – তোপখানা  এর চিন্তার ফারাক  অনেক। লেনিন রাষ্ট্র ও বিপ্লব বইয়ে সেনাবাহিনী এবং পুলিশকে  প্রচলিত  রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রধান উপকরণ হিসেবে চিত্রিত করেছেন । সাধারণ ভাবে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীরা  প্রচলিত  রাষ্ট্র ব্যাবস্থার যেকোন অংশের সংকারের গণতান্ত্রিক দাবীকে সতর্কতার সাথে সমর্থন  কিংবা দাবী তুলে  থাকে । যে কোন  সংস্কারের দাবী তোলা বা সমর্থনের পাশাপাশি সংস্কারের সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট ভাবে উল্ল্যেখ করার অপারগতা প্রচলিত ব্যাবস্থাকে রং চং করে টিকিয়ে থাকতে  সাহায্য করার নামান্তর মাত্র।

দৈনিক বণিক বার্তা ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২০ রিপোর্ট থেকে জানা যায় ” গৃহস্থালির কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে (এসএনএ) যোগ করা গেলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৩৯ শতাংশ।” দৈনিক সমকাল -২০ জুন ২১ এর প্রতিবেদন  থেকে জানা যায়  ” নারীর মজুরিবিহীন গৃহস্থালি ও অন্যান্য কাজের মূল্যায়নে স্বীকৃতি ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের একটি প্রচারাভিযান ‘মর্যাদায় গড়ি সমতা’ পরিচালিত হয়ে আসছে ২০১২ সাল থেকে। প্রতিষ্ঠানটির সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে নারী ও পুরুষ উভয়েই মজুরিবিহীন কাজে নিয়োজিত থাকলেও এ কাজ সবচেয়ে বেশি অংশ নিতে হচ্ছে নারীদের। এসব কাজ হিসাবে আনা হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়ত প্রায় ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। মজুরিবিহীন কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ মাত্র ৯ শতাংশ হলেও নারীর অবদান ৩৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। দেশে এমন কাজে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ৩১ শতাংশ, যার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা মাত্র ১০ শতাংশ।” দেশে যে মুহূর্তে দেশের মানুষ চাউল – আটার জন্য টিসিবির ট্রাকের পিছনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সেই সময় মাথা পিছু আয় ২২০০ ডলার। বর্তমান জাতীয় আয়ের সাথে পত্রিকায় বর্ণিত গৃহস্থালির মুজরী হীন কাজের মূল্য সাথে ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ যোগ করলে বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় ৩৭০০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে । কিন্তু সাধারণের জীবন যাত্রা কিম্বা পকেটের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না । বাসদের দাবী  ” নারীদের গৃহস্থলী কাজের আর্থিক মূল্যকে জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ” । পত্রিকান্তরে প্রকাশ নারীরা জিডিপির ৩৯/৪০ শতাংশ ও পুরুষরা ৯ শতাংশ মুজুরী বিহীন গৃহস্থলীর কাজের সাথে যুক্ত। তোপখানার অর্থিনীতিবিদরা কেন শুধু মাত্র নারীদের গৃহস্থলীর কাজ যুক্ত করতে আগ্রহী তা স্পষ্ট নয়। তোপখানার অর্থিনীতিবিদরা হয়তো জানেনা পুরুষরা গৃহস্থলীর কাজ নারীদের প্রায় চার ভাগের একভাগ করে যা  প্রায় ৯/১০ শতাংশ। জিডিপি বা জাতীয় আয়ে নারীর গৃহস্থলীর অর্থমান সাধারণ ভাবে অন্যদেশ গুলি যোগ করে না। সেই ক্ষেত্রে  শুধু মাত্র বাসদ- তোপখানা অর্থনীতিবিদদের দাবী মেনে  নারীর গৃহস্থলীর অর্থমান যুক্ত করলে বাংলাদেশের তথ্য উপাত্ত অন্যদেশের সাথে মিলিয়ে দেখা বা তুলনা করার সুযোগ থাকবেনা।

নারীর সামাজিক অবদমনের সরব হওয়ার বিকল্প নেই। জিডিপিতে সমগ্রহ   জনগোষ্ঠী বা শুধু নারীর গৃহস্থলীর আয়কে অন্তর্ভক্ত না করাকে কোন ভাবেই নারীর ক্ষমতায়ন বিরোধী হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। গৃহকর্মে পুরুষের উত্তোরত্তর অংশ গ্রহণ নারীর ক্ষমতায়নের পথকে প্রশস্থ করবে। নারী পুরুষ সমতা ভিত্তিক ঘরের কাজে অংশ নিলে জাতীয় আয় বা জিডিপিতে পূর্ন বা আংশিক গৃহস্থলীর আয় অন্তর্ভক্ত করার দরকার পরে না। নরওয়ে সহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে   মুজরী হীন ঘরের কাজের পুরুষদের অংশ গ্রহণ তুলনামূলক ভাবে অগ্রসর । সন্তান লালন পালন, পরিবারের বৃদ্ধদের সেবা দানের মত ঘরের কাজকে অর্থমূল্যে পরিমাপের বিরুদ্ধেও অনেক যুক্তি রয়েছে । এইসব যুক্তি কোনভাবেই নারী বিদ্বেষী যুক্তি নয়। জাতীয় আয়ে নারীর মুজরী হীন কাজের মূল্যমান যোগের দাবী চট -জলদি চটপটির মত মুখরোচক। তবে এই দাবীর সাথে পূর্বাপর সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় বিবেচনায় আনা হয়নি। এই দাবীর গোড়ায় গলদ হচ্ছে শুধু মাত্র  নারীর মুজরী হীন কাজের মূল্যমান দাবী। একই কাজের জন্য পুরুষের অবদানকে বেমালুম চেপে গেছে বাসদ- তোপখানা। দেশে কিভাবে নারীর মুজরী হীন কাজের  পরিমাপের গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে সে বিষয়ে তোপখানার অর্থনীতিবিদগণ নীরবতার আশ্রয় নিয়েছেন। মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান , এই বিজ্ঞানের  অংশ বিশেষ প্রয়োগের বিরুদ্ধে কার্ল মার্কস নিজেই সরব ছিল।  ” বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যত্র থেকে এই ভদ্রলোকেরা বিভিন্ন ধরনের তাত্ত্বিক মত নিয়ে এসেছেন।  ..তার সঙ্গে চেষ্টা হচ্ছে ভাসাভাসা ভাবে আয়ত্ত করা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা গুলিকে নিজেদের চিন্তার সাথে খাপ খাওয়ানোর। প্রথমে নিজেরা নতুন বিজ্ঞানটিকে গভীর  ভাবে অনুধাবন না করেই  নিজেদের  সঙ্গে করে আনা চিন্তায় নিজেদের মত  করে একে ছেঁটে কেটে নিয়েছেন। এবং একই সাথে  একটি নিজস্ব ব্যক্তিগত বিজ্ঞান তৈরি করে ফেলেছেন। এবং কালবিলম্ব না করে এগিয়ে এসেছেন সেই বিজ্ঞান শিক্ষাদানের বড়াই করতে ।” বাসদের লিফলেট জনগণের সমস্যা নিয়ে মামুলি একটা বয়ান মাত্র। লিফলেটে দেশের শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাকে অল্প কথায় সামনে নিয়ে আসার পশ্চাৎপদতা নজর কাড়ার মত।

তথ্য সূত্র

১। বাসদের কংগ্রেস লিফলেট ২৮ ডিসেম্বর ২০২১

২ । দৈনিক প্রথম আলো – ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২। ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ । ১৯ আগস্ট ২০২১ । ৩ আগস্ট ২০২১। ২৩ এপ্রিল ২০২০।

৩ । দৈনিক সমকাল ৮ জানুয়ারী ২০২২। ৭ জুলাই ২০২১।

৪ । টিসিবির পণ্য কেনার লাইন দীর্ঘ হচ্ছে, যাচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্তরাও। ৬ জুলাই, ২০২১। কালের কণ্ঠ।

৫ । ‘প্রবৃদ্ধি বিভ্রম’ শব্দমালা The Growth Delusion by David Pilling বইয়ের নাম থেকে ধার করা ।