মতামত

দুদক (কর্মচারী) চাকুরী বিধিমালা ২০০৮

– ৫৪(২) ধারা ত্রুটিপূর্ণ এবং ন্যায় বিচারের পরিপন্থী

– ফজলুল কবির মিন্টু

বিগত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ সহকারী পরিচালক মো∙ শরীফ উদ্দিনকে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকুরী বিধিমালা ২০০৮ এর ৫৪(২) ধারায় চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সারা দেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। দেশের মানুষ জনাব শরীফ উদ্দিনের চাকুরিচ্যুতিকে ভালভাবে নেয়নি। এমনকি দুদকে কর্মরত তার সহকর্মীরাও বিক্ষুদ্ধ হয়েছেন। ফলে এ ঘটনার প্রতিবাদে তার সহকর্মীদেরকে মানববন্ধন করতেও দেখা গেছে। সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ ধরনের প্রতিবাদ এক নজিরবিহীন ঘটনা বলে অনেকে মনে করেন। এ ঘটনায় দুদক কর্মকর্তাদের মাঝে এক ধরণের আতংক তৈরি হয়েছে ফলে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তারা সার্ভিস এসোসিয়েশন গঠন করেছে বলে আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানতে পেরেছি।

রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে ভোটার করা, কর্ণফুলি গ্যাস ডিস্ট্রবিউশন লিঃ কোম্পানীর মাধ্যমে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেয়া, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন বাইপাস রোড এলাকায় পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর অফিস নির্মানের জন্য জমি অধিগ্রহণের সময় সংঘটিত দুর্নীতি ইত্যাদি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি ও মামলা দায়ের জনাব শরীফ ইতিপূর্বেও আলোচিত ছিলেন।

উপরে উল্লেখিত প্রতিবেদন ও মামলা গুলোতে বহু রাজনীতিবিদ এবং সরকারের উপরের মহলের অনেক প্রভাবশালী কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে আমরা সংবাদপত্র মারফত জানতে পেরেছি। ধারনা করা যায়, ঐ সকল রাঘববোয়ালেরাও শরীফ সাহেবের উপর ক্ষুদ্ধ ছিলেন। গত ৩১ জানুয়ারী ২০২২, তাদের একজন স্বশরীরে  শরীফ সাহেবের চট্টগ্রামের খুলশীস্থ বাস ভবনে গিয়ে শাসিয়ে আসেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে চাকুরিচ্যুত করার হুমকি দেন। এ ব্যাপারে শরিফ সাহেব খুলশী থানায় জিডি করেছেন। হুমকি দাতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আজও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তবে হুমকি দাতার কথা অনুযায়ী এক সপ্তাহের মধ্যে তার চাকরি না গেলেও ১৬ দিনেই তার চাকুরিচ্যুতির ঘটনা রহস্যজনক বটে।

শরীফ সাহেবের চাকুরিচ্যুতির পর সারাদেশে সৃষ্ট  তীব্র প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে গত ২০ ফেব্রুয়ারি দুদক সচিব এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন। দুদক সচিব সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদেরকে শরীফ সাহেবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ১৩টি অভিযোগের কথা জানিয়েছেন। তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত নির্দেশিকা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে নিজের খেয়াল খুশীমত কাজ করা, অভিযোগের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যক্তিদের ডেকে এনে বিনা কারণে হয়রানী করা, কমিশনের অনুমোদন না নিয়ে অনেকের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ বা ফ্রিজ করে দেয়া, জব্দকৃত ৯৫ লক্ষ টাকা সরকারী কোষাগারে জমা না দিয়ে দীর্ঘদিন তার দপ্তরের আলমারিতে সংরক্ষিত রাখা। এই অভিযোগগুলো যদি সত্য হয়ে থাকে এবং যদি গুরুতর অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে শরীফ সাহেবের বিরুদ্ধে ৫৪(২) ধারা প্রয়োগ করা কেন জরুরী হল? তার বিরুদ্ধেতো দুদক চাকুরী বিধিমালার ধারা ২(ঝ), ধারা ৩৮ এবং ৩৯ অনুযায়ী শৃংখলা ভংগজনিত অপরাধের জন্য অভিযোগ আনা যেত। উল্লেখ্য, যেকোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগ প্রমাণিত হলে ধারা ৪০ এ দন্ড দেয়ার বিধান রয়েছে। তবে ধারা ৪০ এ উল্লেখ আছে অভিযোগ যদি গুরুদন্ড দেয়ার যোগ্য হয় তাহলে কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তকে অভিযোগের বিষয় উল্লেখ পূর্বক কারন দর্শাও নোটিশ প্রদান করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যক্তিগত শুনানির ব্যবস্থা করবেন। অতঃপর তদন্ত কর্মকর্তার প্রদত্ত রিপোর্ট অনুসারে যদি অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয় তাহলেই কেবল কর্তৃপক্ষ গুরুদন্ড দিতে পারবেন। গুরুদন্ড হিসাবে বাধ্যতামূলক অবসর, অপসারণ এবং বরখাস্ত করার বিধান আইনে আছে।

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, দুদকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কি ধারা ২(ঝ), ৩৮,৩৯ এবং ৪০ সম্পর্কে অবগত নন? যদি অবগত হতেন, তাহলে শরীফ সাহেবের বিরুদ্ধে শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যবস্থা গ্রহণে সমস্যা কোথায় ছিল? দুদক সচিব সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তার মধ্যে কোথাও কোন ঘাটতি রয়েছে কি? কিংবা দুদক কর্তৃপক্ষ কি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ার আশংকা করছিল? কিংবা যেকোন প্রক্রিয়ায় শরীফ সাহেবকে চাকুরীচ্যুত করা খুব জরুরী ছিল বলেই কি দুদক স্বচ্ছতা এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ  না করে শর্টকাট প্রক্রিয়া হিসাবে ৫৪(২) ধারা প্রয়োগ করলো?

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বলে ৫৪(২) ধারা একটি ত্রুটিপূর্ণ আইন। ধারা ৫৪ তথা এই ধারার শিরোনামে আছে – “চাকুরীর অবসান” যার ইংরেজী অর্থ হচ্ছে “Termination of job”। আবার ৫৪(২) ধারায় উল্লেখ আছে, কর্তৃপক্ষ কোন কারন না দর্শাইয়া ৯০ দিন পূর্বে নোটিশ দিয়ে অথবা ৯০ দিনের টাকা পরিশোধ করে যেকোন কর্মচারীকে অপসারণ করতে পারবে। “অপসারণ” শব্দের ইংরেজি অর্থ “Remove”। আইনে দুই শব্দের প্রয়োগ ভিন্ন। সাধারানত শৃংখলা ভঙ্গের জন্য গুরুদন্ড হিসাবে অপসারণ অথবা বরখাস্ত করা হয়। যা দুদক কর্মচারী চাকুরী বিধিমালার ২০০৮ এর ৪০ ধারাতেও তা উল্লেখ আছে। এখন ৫৪(২) ধারার মাধ্যমে শরীফ সাহেবের চাকুরীর অবসান করা হয়েছে নাকি অপসারণ করা হয়েছে তা পরিস্কার নয়।

৫৪(২) ধারা এবং ৪০ ধারার মধ্যে সংঘাত এবং গোঁজামিল পরিলক্ষিত হয়। ধরুন একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগ প্রমান হওয়ার পর তাকে ধারা ৪০ অনুযায়ী অপসারণ করা হল আবার আরেক জন কর্মকর্তাকে কোন কারণ দর্শানো ছাড়া ৫৪(২) ধারায় অপসারন করা হল। এখানে দুইজনই অপসারন হল কিন্তু দ্বিতীয়জন ন্যায় বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হল। কারন সে জানলোইনা কেন তাকে অপসারণ করা হলো।

তাছাড়া ৫৪(২) ধারার নৈতিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। সেটা বোধকরি দুদক কর্মকর্তারাও খুব ভাল করেই বুঝতে পেরেছেন। এই ধারায় “কোন কারণ দর্শানোর প্রয়োজন নাই” সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও দুদক কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে জনাব শরীফের বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ উত্থাপন করলেন। বলা যায় অভিযোগ উত্থাপন করতে বাধ্য হলেন।

৫৪(২) ধারায় অবসান কিংবা অপসারণ যেটাই হোক, যে প্রক্রিয়ায় এ ধারাটি প্রয়োগ করা হয়েছে তাকে মূলত আমরা চাকুরির অবসান তথা Termination of job হিসাবেই অবিহিত করতে পারি। যা শ্রম আইনে ২৬ ধারার অনুরূপ।  শ্রম আইনের ২৬ ধারাকে ট্রেড ইউনিয়ন এবং নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কালো আইন হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। কারন উল্লেখ ২৬ ধারায় কোন শ্রমিকের চাকুরী অবসান করা হলে সেটা  অবৈধ বলে বিবেচিত হয়। সুতরাং ৫৪(২) ধারায় সেরকম হওয়াই বাঞ্চনীয়।

এছাড়া শ্রম আইনের ২৬ ধারায় কোন শ্রমিকের চাকুরী অবসান করা হলে সংক্ষুদ্ধ শ্রমিক যদি মনে করে তাকে ট্রেড ইউনিয়ন করার কারনে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে সেক্ষেত্রে  ৩৩(৯) ধারায়  অভিযোগ করার পর শ্রম আদালতে মামলা করে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে অথচ ৫৪(২) ধারায় গৃহিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুদ্ধ পক্ষের প্রতিকার চাওয়ার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি ফলে ধারাটি একদিকে ত্রুটিপূর্ণ অন্যদিকে ন্যায় বিচারেরও পরিপন্থী।

লেখকঃ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক ও শ্রম আইন বিশ্লেষক