মতামত

পূর্ব পশ্চিমের শ্রমিকেরা

১.

নাঈম ভাই অবসর যাপন করছেন এক যুগ হতে চলল। মনে শান্তি নেই। আগামী মাসের বাড়ী ভাড়াটা জুটবে কিনা জানা নেই। একটাই ছেলে। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ছিল। নাইম ভাইয়ের সামর্থ্য ছিল না। সারাজীবন ছোট চাকুরী করেছেন, সৎ থাকার চেষ্টা করেছেন। নিজের গাড়ী-বাড়ী হয় নি, কিন্তু শান্তি ছিল। কিন্তু ভাবেননি অবসর জীবনের কথা। প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্রেচুইটির টাকা যা পেয়েছেন তাতে টেনে টুনে চলেছে বছর দশেক। খরচের হিসাব জিনিসপত্রের দামের সাথে লাগামহীন বাড়ছে। প্রতিদিন ভাবেন আগামীকাল সকালটা না দেখলে ভালই হয়। বুড়ি বউটার কি হবে!

সাতান্ন বছরে অবসরের পর চাকুরীর চেষ্টা করেছেন। এ বয়সে কেউ চাকুরী দিতে চায় না। নাঈম ভাই পুরানো ফোন বুকটা খুঁজতে থাকেন। পুরানো পরিচিতদের ফোন করে সাহায্য চাইবেন। আজকাল অনেকেই তার ফোন ধরেন না। অজান্তে চোখের কোনে জল জমে। ভবিষ্যতের মত দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে যায়।

২.

দু’মনের বস্তা এসাথে দুটো তুলতে পারতো রজব মিঞা। সবাই বাহবা দিতে। ঠিকাদারের সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন তিনি। হঠাৎ একদিন কোমরে আর পিঠে ব্যাথা অনুভব করতে লাগলেন। সপ্তাহখানেক বাদে ব্যাথায় একেবার শয্যাশায়ী। বউ বাসাবাড়ী কাজ করে। মেয়ে দুটোকে স্কুল ছাড়িয়ে দুই বাড়িতে কাজে পাঠানো হয়েছে। নিজেরা বস্তির ভাড়া মিটিয়ে একবেলা খেয়ে কাটায়। ভবিষ্যত বলে আর কিছু নেই। বউ যতদিন কাজ করতে পারবে খাওয়া জুটবে, তারপর হয়তো ভিক্ষে করে খেতে হবে।

৩.

রোজিনা রানাপ্লাজায় কাজ করতো দূর্ঘটনায় দুটো পা হারিয়েছে। চলেফেরা করা খুবই কষ্ট। রোজিনা জানে তার দুহাতে এখনো চাইলে মেশিন চালাতে পারেন। কিন্তু দুটো পা ছাড়া ঢাকায় চলাফেরা করা খুবই কষ্ট। প্রতিবন্ধীদের সহায়ক কোন যানবাহন নেই। গ্রামে বাবা ও ভাইদের আশ্রয়ে অর্ধাহারে দিন যাচ্ছে। তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সে কোন ভবিষ্যত আছে বলে ভাবতেই পারেন না।

তিনটা ছোট ঘটনা। তিনটায় সত্যি। জনসংখ্যার পরিসংখ্যাণে বাংলাদেশ একটি যুবক রাষ্ট্র। বাংলাদেশের জনগনের গড় বয়স ২৭.৬ বছর। শুধু ৫% জনগণ ৬৫ বছরের উর্ধে। বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত মানুষদের দূর্ঘটনায় কর্মহীন জীবন এবং অবসর কালীন জীবনে নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষনা ও পরিকল্পনায় ব্যাপক শুণ্যতা রয়েছে। বাংলাদেশের শ্রম আইন অকার্যকারীতা এবং প্রচলিত শ্রমিক/মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় দুরদর্শিতা ও পরিকল্পনার অভাব উপরের তিনটি অমানবিক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে।

আমি প্রবাসী। যে দেশে থাকি এখানে যারা জীবন সায়াহ্নে অবসর জীবনযাপন করেন তাদের পৃথিবীর সুখীতম বৃদ্ধ বলা হয়ে থাকে। অন্তত পরিসংখ্যান ও জরিপ তাই প্রমাণ করে। এর পিছনে নেই আলাদীনের চেরাগ। আছে পরিকল্পনা, আইন ও আইনের বাস্তবায়ন। শ্রমিকের কর্মদক্ষতা যদি যোগ্যতার মাপকাঠি হয়, মালিক বা নিয়োগদাতারও যোগ্যতা চাই মালিক বা নিয়োগদাতা হবার জন্য। এ যোগ্যতাগুলোর কতগুলো শ্রমজীবী মানুষের জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। যেমন নূন্যতম মজুরী, নিরাপদ কাজের পরিবেশ, শ্রম দুর্ঘটনার বীমা পরিশোধের ক্ষমতা, অবসরকালীন তহবিলে বেতনের ১০ শতাংশ নিয়মিত জমা দেয়ার ক্ষমতা। আমি বলে রাখি নিয়োগদাতা হবার যোগ্যতার তালিকা কিন্তু আগের চারটিতে সীমাবদ্ধ নয়। এ ধরনের দায়িত্বের যে কোনটা পালনে অক্ষমতার জন্য সুপষ্ট শাস্তির বিধান আছে। এই শাস্তিগুলো হরহামেশায় প্রয়োগ করা হয়।

শ্রমিকের অবসরকালীন তহবিলগুলো ব্যবস্থাপনার জন্য এখানে বহু বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মালিক ও শ্রমিকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অবসরকালীন বয়সসীমার (যা এখানে ৬৬.৫ বছর) আগে শ্রমিক এই তহবিলের টাকা তুলতে পারেন না। এ বয়সের আগে মৃত্যপথযাত্রী না হলে এ টাকা তোলা দুরূহ। এসব বিনিয়োগের যথাযত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে আইন ও নিয়মিত জবাবদিহিতার বিধান আছে। এই ধরনের শ্রম নিরাপত্তার কারণে অবসর জীবন এখানে সোনার হরিণ, মধুময়। ঘুমহীন রাত নয়।

শ্রমিকের নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনার কথা বলতে আমি আমার জীবনের গল্প বলতে চাই। বাংলাদেশ থেকে এসে আমি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতাম। বলা যায় নিম্নবেতনভুক শ্রমিক। আমার কাজ ছিল মেসিনে সীল করা এক কেজির প্যাকেটগুলো কার্টুনে ভরা। কাজটা কঠিন নয়। কিন্তু চলমান বেল্টের সাথে তাল মেলাতে আমার বেশ বেগ পেতে হোতো। একদিন অনুভব করলাম আমার কব্জিতে ব্যাথা। ডাক্তারের কাছে গেলাম। বললেন, কাজের ধরন বদলাতে হবে। ডাক্তার মালিকপক্ষকে তার সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে জানালেন। তার মতামত, আমাকে অন্য ধরনের কাজ দেয়া হোক, যেখানে কব্জির নিয়মিত ব্যবহার কম। মালিকপক্ষ আমাকে ধীরে কাজ করতে বললেন, ফিজিওথেরাপীর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু আমাকে বিকল্প কাজ দেয়া হলো না। ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়তে লাগলো। সাথে আমি কব্জির জোড় হারাতে লাগলাম। এরপর ব্যাপারটা সরকারী মধ্যস্ততাকারী ও আইন কার্যকর করতে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ‘Safe Work’ পর্যন্ত গড়ালো। ডাক্তারের নির্দেশ না মানাতে বাকি জীবন চিকিৎসা সংক্রান্ত সমস্ত খরচ বহন করার আদেশ আসলো। আমার জন্য করা হলো বিকল্প কাজের ব্যবস্থা। যতদিন বিকল্প কাজের ব্যবস্থা হয়নি ততদিন আমাকে পূরো বেতন দেয়া হয়েছিল। চাকুরীজনিত শারিরিক অক্ষমতার জন্য আমার কাজ বা আয় কোনটা একদিনের জন্যেও হারাতে হয়নি।

রানা প্লাজার ঘটনা চলমান একুশ শতকের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনা। প্রতিবছর এখানকার সরকারী টিভিতে রানা প্লাজা স্মরণে প্রামাণ্য চিত্র দেখানো। রানা প্লাজার পরেও অনেক ছোট বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। পুড়ে মরেছেন অনেক শ্রমিক। পঙ্গু হয়েছেন অনেকেই। পঙ্গুত্বেরও ধরণ রয়েছে। আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ। আবার কিছু পঙ্গুত্ব সুচিকিৎসা নিরাময়ও হয়। এর জন্য প্রয়োজন সহায়ক ব্যবস্থা। শ্রম আইনের মধ্যে এর উদ্যোগ থাকতে হবে। সে সাথে সরকারী বেসরকারী ব্যবস্থাপনা। এসব উদ্যোগ না থাকলে যতই শিল্পায়ন হোক, Made in Bangladesh ব্র্যান্ডিং হোক, শ্রমসভ্যতার নিরিখে আমরা অসভ্যই থেকে যাবো। শ্রমিকের অশ্রু-কান্না প্রামাণ্য দলিল হিসেবে দেশে বিদেশে প্রদর্শিত হবে। শ্রমিকের জীবনের অমানবিক বাস্তবতার কোন সুরাহা হবে না।

লেখকঃ প্রভাত ঘোষ, সরকারী কর্মচারী, কমনওয়েলথ অব অস্ট্রেলিয়া; এডভোকেট, ঢাকা বার; প্রাক্তন হিউমেন রিসোর্স ম্যানাজার, এসিআই গ্রুপ।