মতামত

কান্না করতেও কি পুলিশের অনুমতি নিতে হবে?

৩১ জানুয়ারী দিবাগত রাত ১টায় আরিফুল ইসলাম সুজন নামে একজন জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিক মারাত্মক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে কর্মস্থলেই নিহত হন। সুজন কবির স্টিল শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কাটাররম্যান হিসাবে কর্মে নিয়োজিত ছিল। উল্লেখ্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে রাত্রিকালীন শিপ ইয়ার্ডে কাজ করা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কবির স্টিল শিপ ইয়ার্ডে কাজ চলছিল। ফলে সুজনের অকাল মৃত্যুর জন্য অনেকগুলো কারনের মধ্যে রাত্রিকালীন কাজ করাও একটা অন্যতম কারন হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন।

জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা প্রবণ শিল্প খাত। শ্রমিকেরা এর নাম দিয়েছে মৃত্যু কুপ। বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার এবং জীবন-মান উন্নয়নে সক্রিয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ – বিলস এর হিসাব মতে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প সেক্টরে বিগত ৩ বছরে ৪৬ জন শ্রমিক নিহত এবং শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে নিহত শ্রমিকদের পারিবার বা উত্তরাধিকারীরা শ্রম আইন অনুযায়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ পেলেও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে অনুদান এবং শ্রম আইন ও জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন অনুযায়ী বিমার টাকা পায়না। এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তর, মালিক এবং ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদেরো কোন পরিকল্পিত উদ্যোগও অনুপস্থিত।

অন্যদিকে যারা আহত হয়, তারা আহত হওয়ার পর পর কেবল তাৎক্ষনিক কিছু চিকিৎসা পেলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে আহত শ্রমিকদেরকে অবর্ণনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয়।  শুধু তাই নয় আহত শ্রমিকেরা পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে তাদেরকে চরম অপমানিত হতে হয় বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে।

আহত শ্রমিকদের বড় অংশ স্থায়ী অথবা আংশিক পঙ্গু হয়ে যায়। ঐ সকল স্থায়ী ও আংশিক পঙ্গু শ্রমিকেরা শ্রম আইন অনুযায়ী আদৌ কোন ক্ষতিপূরণ পায় কিনা সেই তথ্যও অজানা।

আমরা মনে করি দুর্ঘটনায় শ্রমিক আহত বা নিহত হলে এর দায় রাষ্ট্র এবং মালিকের। রাষ্ট্রের পক্ষে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের। একটা গণতান্রিক রাষ্ট্রে একটি নির্দিষ্ট শিল্প খাতে প্রতি বছর ১৫/১৬ জন নিহত হবে আর রাষ্ট্র নির্বিকার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে তা কখনো সচেতন মানুষ মেনে নিতে পারে না। শুধু এ চেতনাবোধ থেকেই আমরা জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানাতে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে গিয়েছিলাম মানববন্ধন করতে।

পুলিশ মানববন্ধন করতে দেয়নি। কর্তব্যরত পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? পুলিশ জানালো মানববন্ধন করতে পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে অনুমতি লাগবে। আমরা বললাম এটা কোন সরকার বিরোধী আন্দোলন নয়। কিংবা আমরা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির কথাও বলতে আসিনি। আজ আমরা আজ কান্না করতে এসেছি। আমাদের একজন সহকর্মী, আমাদের ভাই জীবনের তাগিদে কাজ করতে গিয়ে জীবন হারিয়েছে। আমরা রাষ্ট্রের কাছে, মালিকদের কাছে প্রেস ক্লাব চত্বরে সাংবাদিক ভাইদের মাধ্যমে আকুল আবেদন জানাতে এসেছি – জাহাজ ভাঙ্গা শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। পুলিশকে আকুতি জানিয়ে বললাম কান্না করার সুযোগও কি আমরা পাবোনা? পুলিশের সাফ জবাব কান্না করতেও অনুমতি লাগবে . . .

হায়রে আমার প্রিয় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত আমার প্রিয় বাংলাদেশে ভাই হত্যার প্রতিবাদে কান্না করার জন্য প্রেস ক্লাবের সামনেও দাঁড়ানো যাবেনা। বাংলাদেশের কোথাও এক ইঞ্চি জায়গাও নেই যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা ভাই প্রতিবাদ জানাবো। সমগ্র বাংলাদেশ আজ অবরুদ্ধ। এদেশে এখন কান্না করতেও পুলিশের অনুমতি লাগবে . . .

লেখকঃ শ্রম আইন বিশ্লেষক ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক