মতামত

একবিংশ শতাব্দী ও সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা (শেষ পর্ব )

– মহসিন সিদ্দীক

সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আদর্শবাদী রাজনৈতিক সংগ্রাম আরও তীব্র হওয়া প্রয়োজন, সন্দেহ নেই । তবে বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রতিবাদ, সংগঠন ও সংহতি (mobilization) মূলত শহর কেন্দ্রিক; এই রাজনৈতিক কাজ শহরের বাইরে প্রসার করা প্রয়োজন । আর একটা গুরুত্ব পূর্ণ দুর্বলতা এই যে সাম্প্রদায়িকতা নিধনের বেশিরভাগ প্রকল্প পরোক্ষ (indirect), প্রত্যক্ষ (direct) নয়। এমন কি পরোক্ষ প্রকল্প সমূহ, যেমন বিভিন্ন ধর্ম-নিরপেক্ষ দেশজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকলাপ, পরোক্ষ ভাবে অসাম্প্রদায়িক অদর্শ প্রচারে অত্যন্ত সহায়ক; এসবও গ্রামাঞ্চলে প্রসার করা প্রয়োজন। 

বিশেষত যেসব গ্রামাঞ্চলে সংখ্যালঘু বসতিরা আক্রমণের শিকার হয়েছে, এবং যেখানেই তারা বসবাস করে, সে অঞ্চলের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বসতিদের  উদ্যোগে, সংখ্যালঘু বসতিদের সহযোগিতায় সাম্প্রদায়িক অত্যাচার প্রতিহত করার প্রত্যক্ষ ব্যবস্থার প্রয়োজন। গ্রামে হউক, শহরে হউক, অন্য সব নাগরিকদের মত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের; এই মৌলিক কাজে ব্যর্থ হলে ক্ষমতাসীন সরকারের বৈধতা থাকেনা । সর্বত্রই সাম্প্রদায়িক দমনে ভারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করার দায়িত্ব প্রগতিবাদীদের গ্রহণ করা উচিৎ। যে এলাকায় সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সম্ভাবনা আছে, তা সনাক্ত করা এবং সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ভারপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘু নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা দাবী করা প্রয়োজন। প্রতিরক্ষার প্রচেষ্টা যদি আন্তরিক হয়, প্রগতি বাদীদের উচিৎ ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীদের সঙ্গে সহায়তা করা; অন্যথায় তাদের ভুল নীতির সমালোচনা করাও তাদেরই দায়িত্ব ।

প্রগতিশীল ছাত্র, যুবক ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীদের বিভিন্ন স্তরে স্বতন্ত্র ভাবে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি কালে গ্রামাঞ্চলে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের পরিপেক্ষিতে আন্দোলন শুধু মিছিল-শ্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকা যথেষ্ট নয় । প্রয়োজন যেখানে তারা বসবাস করে, সেখানেই আক্রমণ প্রতিহত কারার ব্যবস্থা করার জন্য আগে থেকে সম্ভাব্য দুস্কৃতিকাীদের শনাক্ত করা, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার জন্য চেষ্টা করা, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আঞ্চলিক গণশিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং সংগঠন সৃষ্টি করা প্রয়োজন। অন্যান্য সৃজনশীল পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের রন্ধ্রে -রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের প্রকল্পের উদ্যোগ বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সার্থকতার জন্য প্রয়োজন, প্রগতিশীল ভবিষ্যতর জন্য প্রয়োজন, এবং আমাদের মনুষ্যত্ব সংরক্ষেনের জন্য আবশ্যকীয়। সবসময় রাষ্ট্রের জন্য অপেক্ষা না করে যেখানে প্রয়োজন এবং সম্ভব প্রগতিশীল কর্মীদের উদ্যোগে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের প্রকল্প বাস্তবায়িত করা দরকার।

সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের বৃহত্তম ব্যর্থতা আমাদের শিক্ষা নীতি কেউ সাম্প্রদায়িক হয়ে জন্মায় না, মানুষ সাম্প্রদায়িকতা শেখে যদি তারা সাম্প্রদায়িক সমাজে জন্মায় এবং বাবা-মা, সমাজ, ইত্যাদি সচেতন ভাবে প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক হতে না শেখায় । দুটি অপরিহার্য পরিবর্তন প্রয়োজন: প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় ঘৃণা শেখানো নিষিদ্ধ করা। দ্বিতীয়টি হ’ল অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক নাগরিকত্ব শেখানোর জন্য পাঠ্যক্রম তৈরি করা। যদিও সরকারের পক্ষে দেশব্যাপী এই নীতিগুলি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা ভাল; যদি এটি তা করতে অস্বীকার করে, প্রগতিশীলদের অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বিকল্প সংগঠন এবং ক্ষমতার কেন্দ্র তৈরি করতে হবে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি গ্রহণ করতে হবে।

এই একবিংশ শতাব্দীতে ও আমাদের সমাজে আধুনিক জগতের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রত্যাখ্যান  পৌরাণিক ধ্যান-ধারনা ভিত্তিক (mythology based) সংস্কার এবং অপ্রাসঙ্গিকতা দ্বারা পরিচালিত হওয়াই আমরা বেছে নেই । ডারউয়িনের আবিষ্কার যে মানুষ – তথা প্রাণীর সৃষ্টির পেছনে যে কোন সৃষ্টিকারী নেই, আমরা এই মহাবিশ্বের অংশ বিশেষ এবং যে বৈজ্ঞানিক নিয়মে তা পরিচালিত, তারই পরিণতি – এইসব জ্ঞানের প্রভাব সজ্ঞানে প্রত্যাখ্যান করি।  পদার্থ, রসায়ন,ও জৈব এবং বিশেষ করে বিবর্তন বিজ্ঞানে যেসব বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সামাজিক সচেতনতা বাংলাদেশে আছে তার প্রমাণ যোগ্য কোন নিদর্শন নেই। সম্প্রতি প্রকাশিত  জনপ্রিয় বই “Sapiens A Brief History of Humankind” এ ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারি একটি মৌলিক সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করেছেন: “…আধুনিক রাষ্ট্র হোক, মধ্যযুগীয় গির্জা (অর্থাৎ ধর্ম)  হোক, এই ধরনের সংগঠনের উৎস কল্পজগত, সাধারণ পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে নিহিত যা কেবল মানুষের সম্মিলিত কল্পনায় বিদ্যমান…” (পৃ: ২৭)। বিভিন্ন (মিথ্যা) সৃষ্টি-কল্পের (origin myth) ভিত্তিতে সৃষ্ট ধর্ম প্ররোচিত অত্যাচার ও প্রাণ হানী চলছে – কল্পিত ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের নামে। আমাদের সমজে পি এইচ ডি র অভাব নেই, আমাদের সমাজ আধুনিক বিজ্ঞান-উদ্ভূত যুক্তি চালিত (rational) মানুষের অভাব । এই একবিংশ বিশ্বে যুক্তি-অবিহিত (devoid) মানুষ কে বুদ্ধিমান গণ্য করা যায়না । আমরা এই ভবেই আধুনিকতা এড়িয়ে মধ্যযুগের  প্রভাব মেনে নিয়েছি। এর কারণ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন।                   

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে খুব কম সক্রিয় শিক্ষা রয়েছে। এজন্য কিছু অপরিহার্য পরিবর্তন প্রয়োজন:(১) প্রাণীর সৃষ্টির অবৈজ্ঞানিক ‘কিচ্ছা’ শেখানোর পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শেখাতে হবে; (২) প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় ঘৃণা শেখানো নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। (৩) অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক নাগরিকত্ব শেখানোর জন্য পাঠ্যক্রম তৈরি করা দরকার। সরকারের পক্ষে দেশব্যাপী এই নীতিগুলি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা উচিৎ।; যদি এই দায়িত্ব সরকার অস্বীকার করে, প্রগতিশীলদের অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বিকল্প সংগঠন এবং ক্ষমতার কেন্দ্র তৈরি করতে হবে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি গ্রহণ করতে হবে। একটি উন্নত ভবিষ্যতের জন্য পুরানো সমাজে পরিবর্তনের বীজ রোপণ  প্রয়োজন। 

অবর্ণনীয় ভোগান্তির পর এই একবিংশ শতাব্দীতে’ও আমাদের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িকতার অমানুষিকতা মাথাচাড়া দিতে সক্ষম, তা মেনে নেয়া কোন সভ্য সমাজের উচিৎ নয়।  সাম্প্রদায়িকতা ক্যানসার কে সরসরি আক্রমণ না করে তার ধ্বংসাত্বক পরিণতি এড়ানো সম্ভব নয়; সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল না করে আমাদের সমাজে প্রগতি সম্ভব নয়। আর যারা সত্যিকার প্রগতি বাদী, তাদের মেধা, উৎসর্গ এবং বিশেষ করে নেতৃত্ব ছাড়া এই সংগ্রামে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়।      

মহসিন সিদ্দীকঃ প্রাবন্ধিক, সম্পাদক,  ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ‘ নাগরিক’ পত্রিকা।