মতামত

একবিংশ শতাব্দী ও সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা (২য় পর্ব )

– মহসিন সিদ্দীক

পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বস্তুত বিলুপ্ত, তবু ইসলাম নিন্দার মিথ্যা অভিযোগে তাদর ওপর অত্যাচার চলছে, প্রকাশ্যে হত্যা করা হচ্ছে । বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আর্থিক অথবা রাজনৈতিক কোন অন্যায্য প্রভাবের জন্য দায়ী নয়,তবুও সুযোগ পেলেই ক্রমশ সঙ্কুচিত এই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অপপ্রচার অবারিত। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সমাজসেবক সংঘের অভিযোগ সত্তেও ভারতের মুসলমান অন্যায্য বিলাসতায় বেঁচে আছে বলে মনে হয়না। তথাপি তাদের প্রায় সমস্ত সমস্যার জন্য দায়িকরা অপচেষ্টার ও শেষ  নেই। সর্বত্র ই সাম্প্রদায়িকতা দমনের বেশিরভাগ প্রচেষ্টা সপ্রতিভ (proactive) নয়।  আমরা দাঙ্গা নিরোধ করা বা সাম্প্রদায়িকতার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করা ব্যবহার্য্যক সামর্থ্য অর্জন করার ওপর অপর্যাপ্ত গুরুত্ব দেই; ঘটনার পর প্রতিবাদে সীমিত থাকই নিয়ম।  সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের কাজ বিষাদে পরিণত হয়েছে।  ইতিমধ্যে গবেষকদের মতে ও জনতাত্তিক (demographic) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৯৪৭ সালের জনসংখ্যার ২৩% ছিল হিন্দু; ২০১১ সালে সেটা ৮.৫%এ নেমে এসেছে । এই হারে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যার সমাধানের জন্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় থাকলে তার আগেই পাকিস্তানের মত বাংলাদেশে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

মোদ্দা কথা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আলোচনা, বিশ্লেষণ, তাত্ত্বিক ভাবনা, ইত্যাদির প্রয়োজন এখনও আছে বটে, তবে এই ধ্বংস যজ্ঞের অবসানের উপায় এখন ভাবনা চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত। আর প্রয়োজন এই সমস্যাকে বৃহত্তর, ঐতিহাসিক পটভূমিকায় বিবেচনা করা। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের কারণ তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছুক সহবাসের সুদীর্ঘ ইতিহাসের বাস্তবতায় যদি সংস্থাপিত (embedded) না থাকত, তা হলে ঔপনিবেশিক শাসকরা সাম্প্রদায়িক বিভেদের সুযোগ নিতে এতটা সমর্থ হত না।  ইতিহাস যদিও এক, তার চেতনা, উপলব্ধি ও অনুভব বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন; ফলে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা এবং মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা এক নয়। তবে তার অর্থ এই নয় যে সম্প্রদায়-বিশেষ  সাম্প্রদায়িকতায় পার্থক্যের ফলে এর ধ্বংসাত্মক পরিণামে পার্থক্য আছে। সাম্প্রদায়িকতার অবসানের উপায় নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সম্প্রদায়-বিশেষ অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টি ভঙ্গী সম্পর্কে যতটা সম্ভব সচেতন অপরিহার্য। এ বিষয় অন্যত্র আলোচিত হয়েছে। 

বলা-বাহুল্য, সাম্প্রদায়িকতা নিষ্কর্ষণ দূরহ কাজ। সুবিধাবাদী অপব্যবহারের  জন্য ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর জন্য অনেক উপাদান আছে।, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার যৌক্তিকতা বলে কখনও কিছুই ছিলনা। বিশেষত, একবিংশ শতাব্দীর জগতে সাম্প্রদায়িকতার আবেদন জনতার যে অংশকে এখনও ধ্বংসাত্মক কাজে অনুসৃত (pursued) করে, তাদের মানসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক চরিত্র সংকীর্ণমনা ও  অসহিঞ্চু; তারা শ্রেণী বিশেষে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের সমাজে  ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সার্থকতার একটা  কারণ এই উপলব্ধির অভাব যে জনসমষ্টি ছোট বড় যে কোন পরিমাণের হউক না কেন, তা কখনই সম্পর্কিত (homogeneous) নয়, বরং তা মজ্জাগত ভাবে অসম্পর্কিত (inherently heterogeneous). তাই, এমনকি (সুস্থ) পরিবারের সব সদস্য প্রায়শ এক মতাবলম্বী হয় না। এই অনিবার্য অসম্পর্কিত সমাজে সমষ্টিগত জীবন ধারণের জন্য নাগরিকত্ব সম্ভব করার প্রয়োজনে সভ্যতার সুদীর্ঘ বিবর্তনের প্রক্রিয়ায়, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সাধরণ্যে-বিবেচিত উপযুক্ত শাসন পদ্ধতি হিসাবে স্বীকৃত ।  ভবিষ্যৎ সাম্যবাদী সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসন্ন হলে নাগরিকদের ধ্যানধারণার স্বাধীনতার পরিসর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজের অদান্দিক (non-antagonistic) অসম্প্রীতি বৃদ্ধির সম্ভাবনা ও বাড়বে । সে জন্য প্রয়োজন হবে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিবর্তন। সেই মাত্রায় উত্তরণের পথে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক নাগরিকতা শিক্ষার জন্য অপরিহার্য। সাম্প্রদায়িকতা তার অন্যতম প্রতিবন্ধক, দ্বিজাতি অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাস নির্ভর জাতি তত্ব  সামন্ততান্ত্রিক সমাজ পরিত্যাগ করে ধনতন্ত্রের অধীনে বুর্জোয়া সমাজে উত্তরণের পথে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছে। সমাজের প্রগতির জন্য এই উত্তরণের গুরুত্ব উপলব্ধি আমাদের জরুরী কর্তব্য।

একবিংশ শতাব্দীর বিশেষ চরিত্র গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার গুরুত্ব প্রায় সর্বজনীন স্বীকৃতি। বিশেষত প্রাক-সোভিয়েত যুগে  সমাজতন্ত্রের সমর্থকদের মধ্যেও গণতন্ত্রের গুরুত্বের  নব্য উপলব্ধি প্রতিফলিত। ১৯৯৩ সালে কার্ল মার্কসের ১৭৫’তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতায় সমাবিষ্ট ৫০-ঊর্ধ্ব সমাজতান্ত্রিক দলের আলোচনায় বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সীমিত পরিসর বর্ধিত  করার সংগ্রামের সঙ্গেই সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়া হয়।  বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির সমাজতন্ত্রে বিপ্লবী গনতন্ত্রিক উত্তরণের নীতি এই বিশ্বব্যাপী পরিবর্তিত রাজনৈতিক চিন্তাধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। 

পড়ুনঃ একবিংশ শতাব্দী ও সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা (১ম পর্ব )

পরবর্তী অংশ ১৭ জানুয়ারী ২০২২।