মতামত

একবিংশ শতাব্দী ও সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা (১ম পর্ব )

সাম্প্রদায়িকতা ভারত উপমহাদেশে পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনাময় বিরতিহীন এক দুঃস্বপ্ন । একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এটা যদিও স্বীকার্য যে সমাজে মোটামুটি পরিবর্তনের প্রগতিশীল ধারা বিদ্যমান, অথচ এটাও সত্য যে ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ী, ধর্ম রাজনৈতিক, ধর্ম-অনুপ্রাণিত সুবিধাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী শ্রেণী বিভক্ত সমাজে মানুষের নিরাপত্তা ও অনিশ্চয়তা জনিত ভীতির সুযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে ‘অপর’ বিরোধী ঘৃণা উদগ্র, দাঙ্গার উসকানি দেয়া, তাদের শেষ অবলম্বন ভিটে-মাটী দখল এবং ছুরির ডগায় ‘শান্তির’ ধর্মে যোগ দিতে বাধ্য করা, এমনকি নির্দোষ মানুষকে হত্যা করা, ইত্যাদি বর্বরতাও প্রচলিত রয়েছে। এখনও নিরুপায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কার্যত স্বদেশে অনাহূত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব মেনে নিয়ে এমনকি সন্ত্রাসীদের আক্রমণের মুখেও রাষ্ট্রের সংরক্ষণের অনিশ্চয়তার ভয়-ভীতি’তে বেঁচে থাকতে হয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব প্রসারে দক্ষ আজকের সাম্প্রদয়িকতাবাদীদের স্পর্ধা সীমাহীন । গুজরাটের ২০০০ ও ২০০৬ সালের দাঙ্গা এবং বাংলাদেশে ২০১৩ এবং এবছরর (২০২১) সরস্বতী পূজার মৌসুমে সাম্প্রদায়িকতা প্রণোদিত ধ্বংস যজ্ঞ রাষ্ট্র-বিশেষের দম্ভ – ‘আমরা সাম্প্রদায়িক নই’ -এই মিথ্যার মুখোশ খুলে দিয়েছে । আশা ছিল ১৯৪৭ সালের কলঙ্কিত দেশভাগ সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে আমাদেরকে মুক্ত করবে । কিন্তু পূর্বপুরুষদের এই অবাঞ্ছিত ‘অবদান’ আজ’ও সহজেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিরোধী সন্ত্রাসে পরিণত করা সহজ। 

পাকিস্তান, তথা পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি অগণতান্ত্রিক দ্বিজাতি তত্বের শঠতায়; তার বাস্তবায়ন হয় পাকিস্তানি শাসক শ্রেণীর স্বৈরাচারী শাসন এবং পূর্বপাকিস্তান কে উপনিবেশে পরিণত করায়। সেই মতিভ্রংশের পরিবর্তনের সংগ্রামে, যা মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়, তার অভিপ্রায় শুধু অসম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবসানই ছিলনা, ছিল একটা ‘গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, সমাজতান্ত্রিক’ দেশ সৃষ্টি করার প্রয়োজনের উপলব্ধি ও অঙ্গিকার। এই প্রগতিশীল দূরদৃষ্টি ছিল আমাদের প্রথম সংবিধানের ভিত্তি প্রস্তর। পরিবর্তিত বাস্তব অবস্থা অবশ্য ভিন্ন। দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্য বিতাড়িত হলেও দেশজ প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নির্মূল হয়নি। এই চক্রের বিশিষ্ট অংশ সামরিক বাহীনির উচ্চপদস্থ কিছু নায়ক, যাদের পেশাগত প্রশিক্ষণের ফল উন্নাসিকতা ও সর্বজনীন ভোটাধিকার ভিত্তিক গণতন্ত্রকে অযোগ্য করতে শেখা; আর অসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে তাচ্ছিল্য পূর্ণ মনোভাব এবং সামরিক কায়দায় দেশ শাসন হওয়া উচিৎ এই বিশ্বাস পোষণ করা।   জাতির  পিতার কৌশলগত ও রাজনৈতিক ভুলের ফলে জনগণের সমর্থন হারাবার পর প্রথম সুযোগেই স্বৈরাচারী সৈন্য-শাসকরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধে শত্রু সৈন্যদের নারকীয় কর্মকাণ্ডে সাহায্যকারী সন্ত্রাসবাদী ধর্ম রাজনীতির নেতৃত্বকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে শেকড় গজাতে সাহায্য করে এবং সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা বিলুপ্ত করে।   

অত:পর সৈন্য সমর্থিত বাংলাদেশ জাতীয় দল একই নীতি অনুসরণ করেছে।  দুর্ভাগ্য বশত এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ও সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা পুনঃঅধিষ্ঠিত না করে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অর্জিত অঙ্গীকারকে ক্ষমতা দখলে ও রক্ষণে ব্যবহার্য্য পণ্যে পরিণত করেছে। লক্ষ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে ধর্মনীতির পুনর্জীবনে একমাত্র বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি এবং স্বল্প কয়েকটা বামপন্থী দল ছাড়া অন্য সব দলই জড়িত।

মুক্তিযুদ্ধে  অবিস্মরণীয় ত্যাগের পরেও ধর্মান্ধতা, গণতন্ত্র বিরোধী, অসহনশীল, বর্বর সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির পুনরুত্থানে নিরাশ না হওয়া মুশকিল। জামাত-ই-ইসলাম এবং হেফাজত-ই-ইসলামের মত ধর্ম ব্যবসায়ী, বাংলাদেশ-বিরোধী, বাংলাদেশকে হিন্দু-মুক্ত করে কোরান-হাদিস ভিত্তিক আদর্শ মুসলমান দেশে পরিবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সন্ত্রাসবাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক  দলের আপোষ করার প্রচেষ্টা হতাশাজনক। এই একবিংশ শতাব্দীতেও  সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ‘সফলতার’ পরিপ্রেক্ষিতে এই সমস্যার সমাধানে এ’যাবত অনুসৃত নীতি ও কর্মসূচীর পূনর্মূ্ল্যয়ান প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িকতা কি, এর উৎস কোথায়, কে দায়ী, ইত্যাদি নিয়ে – সম্প্রদায়-গত পক্ষপাতিত্ব, ডান-বাম ও অন্যান্য কারণে মতভেদ আছে। এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক, গবেষণা এবং লেখা-লেখি চলছে দীর্ঘদিন যাবত। বিশেষ করে বদরুদ্দীন উমর (“সাম্প্রদায়িকতা”, ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৬৬) ও বিপান চন্দ্র (“আধুনিক ভারত ও সাম্প্রদায়িকতা বাদ”, কলকাতা, ভারত, ১৯৮৯) এই সমস্যার ওপর গবেষণায়  পথ-প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন ।   অবশ্য নূতন সমস্যার আবির্ভাবে বিরতি নেই । স্বাধীনতার পাঁচ বৎসরের মধ্যে এত দ্রুত রাজনৈতিক পরিবেশের অবনতি,  স্বাধীনতা আন্দোলনের আদর্শ ও প্রেরণা প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বিকৃত করায় সমর্থ হওয়ার কারণ এবং এতে সাম্প্রদায়িকতার ভূমিকা, এসব বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন । তবে জনগণের নিরাপত্তার জন্য যারা দায়ী তাদের ওপর এইসব  বিশ্লেষণ ও গবেষণার কোন প্রভাব পড়বে কিনা বলা মুশকিল ।

যদিও ‘সম্প্রদায়’ অন্য অর্থে ব্যবহার সম্ভব, উপমহাদেশে তার নির্দেশ হয় ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী। সাম্প্রদায়িকতার উৎস নির্ণয়নে ধর্ম ও শ্রনী ভিত্তিক বিভেদের সাদৃশ্য (conformity, identity), তার ঐতিহাসিক পটভূমি, ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণার ফলাফল বিভিন্ন প্রকাশনায় নিবন্ধিত। সমস্যা হচ্ছে এই ভূয়োদর্শন-লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে যে ‘সিদ্ধান্তে’ পৌঁছনো হয় এবং সে অনুযায়ী যে ‘কর্মসূচী’গ্রহণ করাহয়, সে সব নিয়ে। সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবসান ও পুঁজিবাদী উন্নয়নের প্রসার, অতঃপর সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব এবং তারপর পদানুবর্তী সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল হবে সন্দেহ নেই । বাস্তবে, আকাঙ্ক্ষিত অগ্রগতির  অপর্যাপ্ততার ফলে’ই বিংশ শতাব্দীর অমীমাংসিত সমস্যা একবিংশ শতাব্দীতে ‘ও সংখ্যালঘু নাগরিকদের জন্য মর্মান্তিক পরিণতির সৃষ্টি করেছে। অনেকদিন হল ইংরেজ শাসনের অবসান হয়েছে; জমিদারী প্রথা উৎখাত হয়েছে, অথচ সাম্প্রদায়িকতা এখনো শক্তিশালী। আর আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা এবং সাধ্যমত চেষ্টা সত্যেও শ্রেণী শোষণের অবসানের সম্ভাবনার ধারে কাছেও আমরা পৌঁছেছি মনে হয়না। তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তাদের নিরাপত্তার জন্য, নাগরিকত্ব জনিত অধিকার অর্জনের জন্য বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা স্থাপনের অপেক্ষায় থাকার উপদেশে দেয়া প্রহসন মাত্র। সাম্প্রদায়িকতার সম্পূর্ণ উৎখাতরজন্য সমাজর মৌলিক প্রগতিশীল পরিবর্তন অনস্বীকার্য। কিন্তু এই মুহুর্তে অবশ্যকরণীয় কর্তব্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বর ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের আসন্ন আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হওয়া। 

২য় পর্ব জানুয়ারী ১০, ২০২২।