চলমান সংবাদ

কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা ১৫ দিনের মধ্যে উচ্ছেদ না হলে হাইকোর্টে যাওয়ার হুশিয়ারি

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর আনুমাঝি ঘাট থেকে হালদার মোহনা পর্যন্ত অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের নেতারা। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ১৫ দিনের মধ্যে কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা না হলে বিষয়টি হাইকোর্টকে অবহিত করা হবে বলেও হুশিয়ারি দিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। সোমবার ( ৩ জানুয়ারি) সকালে কর্ণফুলী নদীতে নৌকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান তারা। সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি চৌধুরী ফরিদ বলেন, মাছ বাজারের উজান অংশে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর নিচে বিএস খতিয়ান ও ২০১৪ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাস্টার প্ল্যান ফর চিটাগং পোর্ট’ শীষক জরিপে নদীর প্রবাহমান ধারা ছিলো ৮৮৬ দশমিক ১৬ মিটার। মাছ বাজার গড়ে উঠায় সেই অংশে নদীর বর্তমান প্রবাহমান ধারা মাত্র ৪১০ মিটার। শাহ আমানত সেতুর উত্তর পাশে নদীর মাঝ পিলার পর্যন্ত ভরাট হয়ে গেছে। ব্রিজের নিচে অর্ধেকের বেশি নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ব্রিজের তিন পিলার অংশে নদীর প্রচন্ড  স্রোত হয়। যে কারনে শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণ পাশে ধসে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে। চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গাফেলতির কারণে কর্ণফুলী নদী ভরাট ও দখল হয়ে যাচ্ছে। অক্টোবর মাসে জেলা প্রশাসক এক মাসের মধ্যে কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যকম শুরু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কর্ণফুলী উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়নি। তাই সরকারি সংস্থা কর্তৃক হাইকোর্টের আদেশ না মানার বিষয়টি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে হাইকোর্টকে অবহিত করে আদালত অবমাননার বিষয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করে আবেদন করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য বলা হয়, ২০১০ সালে হাইকোর্ট কর্ণফুলী নদী ও তীর দখলকারী ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করার নির্দেশ দেয়। যার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ২০১৪ সালে কর্ণফুলী তীর জরিপ করে ২১৮১ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে কর্ণফুলী নদী দখলকারী হিসাবে চিহ্নিত করে হাইকোর্টকে অবহিত করেন। জেলা প্রশাসন প্রতিবেদন দেয়ার পর মামলা চলাকালীন সময়ে ২০১৬ সালে বিএস ১নং খতিয়ানের ৮৬৫১ অনুযায়ী কর্ণফুলী নদী জাতীয় মৎসজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডকে ২০১৫ সালে ১৫ বছরের চুক্তিনামা দিয়ে লিজ দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। লিজ গ্রহিতাগণ কর্ণফুলী নদী দখল ও ভরাট করে মাছ বাজার ও বরফকল নির্মানকালে তা বন্ধ রাখার জন্য ২০১৬ সালে তৎকালীন চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন এবং চট্টগ্রাম সদর সার্কেল ভূমি সহকারী কমিশনার আছিয়া খাতুন বিএস ১নং খতিয়ানের দাগের ১৪৭ দশমিক ১০ একর জায়গা কর্ণফুলী নদী হিসাবে চিহ্নিত করে উচ্ছেদ নোটিশ দিয়ে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখ বন্ধ ও ভরাট করে জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের স্থাপনা নির্মান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। সেইসাথে মাছ বাজারকে বরাদ্দকৃত ১ লাখ ৭৫ হাজার ২৬৩ বর্গফুট নদীর অংশে নতুন মাছ বাজার গড়ে উঠেছে উল্লেখ করে তা উচ্ছেদ করতে বলা হয়। এছাড়া চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মোহনা দখল করে মাছ বাজার নির্মাণ বন্ধ রাখতে নোটিশ দেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ফরিঙ্গিবাজার থেকে মেরিনার্স পার্ক নতুন মাছ বাজার, ভেড়া মার্কেট ও বাকলিয়ার চরের মোড় পর্যন্ত ৪৭ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের দখলে থাকা এক হাজারের উপরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসনকে নোটিশ দেয়। নোটিশ দেওয়ার দুই বছর অতিবাহিত হলেও রহস্যজনক কারনে উচ্ছেদ অভিযান পরিচলনা করছে না জেলা প্রশাসন। যা হাইকোর্টের আদেশের লঙ্ঘন বলে জানান নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০১৪ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাস্টার প্ল্যান ফর চিটাগং পোর্ট’ শীর্ষক জরিপে চাক্তাই খালের মুখে কর্ণফুলী নদীর প্রবহমান ধারা ছিল ৯৩৮ মিটার। রাজাখালী খালের মোহনায় তা ছিল ৮৯৪ মিটার। শাহ আমানত সেতুর নিচে ছিল ৮৬৬ মিটার।কিন্তু ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ‘চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন’ কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতু থেকে ফিরিঙ্গিবাজার মনোহরখালী পর্যন্ত এর প্রস্থ জরিপ করে। বিএস শিট, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রণীত কৌশলগত মহাপরিকল্পনা ২০১৪ এর সঙ্গে তুলনা করে এ জরিপ করা হয়। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে শাহ আমানত সেতুর নিচে কর্ণফুলী নদীর প্রবহমান ধারা ছিল ৮৬৬ মিটার প্রস্থ। এখন তা ভাটার সময় দাঁড়িয়েছে ৪১০ মিটারে। জোয়ারের সময় তা ৫১০ মিটার পর্যন্ত পাওয়া গেছে। রাজাখালী খালের মুখে প্রশস্ততা ৪৬১ মিটার পাওয়া গেছে, যা আগে ছিল ৮৯৪ মিটার। চাক্তাই খালের মুখে এখন নদীর প্রশস্ততা ৪৩৬ মিটার, যা আগে ছিল ৯৩৮ মিটার। ফিরিঙ্গিবাজার মোড়ে নদীর প্রস্থ ছিল ৯০৪ মিটার, বন্দর কর্তৃপক্ষ খননের পর সেখানে নদী আছে ৭৫০ মিটার। বাকি অংশ বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের ইচ্ছামতো গাইড ওয়াল নির্মাণ করে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে বলে জরিপে বলা হয়েছে। জরিপ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শাহ আমানত সেতুর উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার নদী ভরাট হয়ে গেছে। ২০১৬ সালে নদী ভরাট করে গড়ে তোলা মাছবাজার, বরফকল, অবৈধ দখল ও ভেড়া মার্কেটের কারণে চাক্তাই খালের মোহনা এলাকায় কর্ণফুলী নদীর প্রবহমান ধারা কমে দাঁড়ায় ৪৬১ মিটারে। মূলত কর্ণফুলী নদী অবৈধ দখলের কারণে এর প্রশস্ততা কমছে বলে অভিযোগ নদী রক্ষা আন্দোলনকারী ও বিশেষজ্ঞদের। প্রসঙ্গত, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে রায় দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সর্বোচ্চ আদালত ২০১৯ সালে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। রায়ে দুই হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনা সরাতে ৯০ দিনের সময় দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জেলা প্রশাসন ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম ধাপে ২৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ১০ একর ভূমি উদ্ধার করে। এ অভিযানের ফলে অবমুক্ত হয় পাঁচটি খালের মুখ। বন্দর এলাকা থেকে শুরু করে বারিক বিল্ডিং মোড়-গোসাইলডাঙ্গা-সদরঘাট-মাঝির ঘাট-শাহ আমানত সেতু হয়ে মোহরা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার নদীর তীর জঞ্জালমুক্ত হয়। এরপর লালদিয়ার চর এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

# ০৩.০১.২০২২ চট্টগ্রাম #