বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (২৫) বিজন সাহা

গত লেখায় বাহ্যত নাস্তিক সোভিয়েত ইউনিয়নও যে ধর্মীয় মাদকে বুদ হয়ে ছিল সে সম্পর্কে বলেছিলাম।  এ ব্যাপারে আরও কিছু কথা বলা দরকার। ধর্মে অন্ধবিশ্বাসী মানুষের বদ্ধমুল ধারণা যে ধর্মগ্রন্থে সব প্রশ্নেরই উত্তর আছে। এই ধারণা এতই ব্যাপক যে অনেক সময় নিজের কানকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ২০১২ সালে দেশে বেড়াতে গেলে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের ইনস্টিটিউটে কসমোলজি নিয়ে আমার কাজকর্মের উপর একটা সেমিনারে কথা বলি। এরপরে ছিল লাঞ্চের ব্যবস্থা। ওখানে খাওয়া দাওয়া প্লাস সেমিনারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা। হঠাৎ ওখানকার এক ছাত্রী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামকে বলল

– স্যার, আমাদের গেস্ট সেমিনারে যা বললেন সবই তো কোরআনে লেখা আছে। তাই না?

আমি একটু অবাক হয়ে তাকালাম। বুঝলাম, সঠিক উত্তরটা জানা থাকলেও উনি সেটাকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন কথাটা অন্যভাবে এড়িয়ে গিয়ে। মনে পড়ল বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সেই গল্প, যখন স্থানীয় জমিদার তাঁর গবেষণার বর্ণনা শুনে বলেছিলেন এসব তো বেদেই লেখা আছে। আমরা এখনও সমস্যা সমাধানে রাম রাজ্যে বা মদিনা সনদে ফিরে যেতে চাই। মিখাইল গরবাচভও প্রায়ই লেনিনের কাছে ফিরে যাওয়ার কথা বলতেন। এখানেই সমস্যা। এসব বই নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেটা সেই সময়ের জন্য। এখন পৃথিবীর অবস্থা বদলে গেছে, বদলে গেছে মানুষ। তাই  আমরা যদি অতীত শিক্ষাকে বর্তমান বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না করতে পারি তাহলে সমস্যার সামাধান হবে না, আমরা বরং সামনে না গিয়ে পেছনের দিকে ধাবিত হব।

এর আগেও বলেছি, আবারও বলছি, সব কিছুর উপর সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ – এটা অর্থনৈতিক সম্পর্ক, পুঁজির সাথে শ্রমের সম্পর্ক, সামাজিক সম্পদ বণ্টনের তত্ত্ব। এটা ঠিক, এসব করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। আমি মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ ততটা জানি না, ছাত্রজীবনে কয়েক বছর এসব আমাদের পড়তে হয়েছিল, আমার জানাশোনা তাতেই সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে অনেক কিছুই ভুলে গেছি। তবে যতদূর মনে পড়ে উন্নত পুঁজিবাদী সমাজে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ আসবে সেটাই ছিল মার্ক্সের কথা। এটা ছিল এভ্যুলুশনারী প্রসেস, রেভ্যুলুশনারী নয়। তাছাড়া সেখানে সম্পদের মালিকানার বিন্যাসের কথা বলা হলেও আগের সব কিছুকে অস্বীকার করার কথা বলা হয়নি। একটা সমাজ গড়ে ওঠে হাজার বছর ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে সেখানে নির্দিষ্ট রীতিনীতি, সংস্কৃতি, মনমানসিকতা ইত্যাদি গড়ে ওঠে। বিপ্লব করে রাজনৈতিক পট বদলানো যায়, মানুষ বদলানো যায় না। আইন তৈরি করেও মানুষ বদলানো যায় না। সোভিয়েত ইউনিয়নে সেটাই করা হয়েছিল, আইন করে হাজার বছরের রীতিনীতি সব নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষ নিজের অজান্তেই লেনিনকে ঈশ্বর বলে মনে করতে শুরু করেছে যেমন করে আমাদের দেশের মানুষেরা পীর বা গুরুকে প্রায় সর্বশক্তিমান মনে করে।  কিছুদিন আগে দুবনা থেকে মস্কো যাই ইভান নামে এক ছেলের গাড়িতে। কথায় কথায় বলল
– এক সময় ভাবতাম ঈশ্বর ছয় দিনে মহাবিশ্ব তৈরি করেছে। এমন কি যখন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই, তখনও তাই ভাবতাম। স্কুলে পড়ার সময় একদিন একথা বলায় শিক্ষক এমন জোরে থাপ্পর মারলেন যা জীবনে ভুলব না। উনি ছিলেন পুরানো কমিউনিস্ট। বললেন, এই আলো, এই বিদ্যুৎ, এই স্কুল, এই রুটি – এ সবই লেনিনের দান। উনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না, তবে তাঁর কাছে লেনিনই ছিল ঈশ্বর।

এখন অনেক কিছু দেখে আমার বদ্ধমুল ধারণা হয়েছে যে বিপ্লবের পরে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্কে যদি সেই কঠোর পরিবর্তন করা না হত সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক বিপদই এড়িয়ে যেতে পারত। প্রথমত সোভিয়েত বিরোধী প্রোপ্যাগান্ডা কমত, সারা বিশ্বের ব্যাপক সংখ্যক মানুষ শুধুমাত্র এ কারণেই সোভিয়েত বা সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করত না। একটু ভেবে দেখুন মাত্র তিরিশ বছর আগেও আমাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল চিঠি। এখন কয়জন লোক চিঠি লেখে? কেউ কিন্তু মানা করেনি, তবে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষ নিজে থেকেই সেটা বাদ দিয়েছে। করোনার আগে আমরা কি কল্পনা করতে পারতাম অনলাইনে বিভিন্ন আলোচনা সভা করা বা স্রেফ আড্ডা দেবার কথা? এখন সেটা করি। চাপিয়ে না দিলে মানুষ অনায়াসে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজে বদলে নেয়। বাংলাদেশের কত মানুষ ভারত বা হিন্দির প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়েও শুধু বলিউডের মুভি দেখতে দেখতে হিন্দি শিখে ফেলে। যেকোনো বাধা নিষেধের প্রতি মানুষের মন সব সময়ই প্রতিবাদী, কিন্তু সেটা না করে শুধু পরিবেশ সৃষ্টি করলেই সে নিজের অজান্তে নতুন বাস্তবতায় নিজেকে মানিয়ে নেয়। আমার বিশ্বাস ইতিহাসের ইতি না টেনে আর কোন রকম বাধা নিষেধ আরোপ না করে সোভিয়েত রাষ্ট্র যদি অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যেসব পরিবর্তন এনেছিল সেটাই চালিয়ে যেত তাহলে একদিকে যেমন সময়ের বন্ধন অবিচ্ছন্ন থাকত, অন্যদিকে তেমনি মানুষ বাধ্য হয়ে নয়, পরিবর্তনগুলো স্বেচ্ছায় বরণ করে নিত।

বিপ্লবের পর হাজার বছরের সময়ের বন্ধন যেভাবে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল তাতে মনে হয় বলশেভিকদের জন্য নতুন দেশ গড়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল পুরানো সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলা। আমেরিকায় স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের মেরে ইউরোপীয়রা সেই স্থান পূরণ করেছিল আফ্রিকা থেকে আমদানি করা দাসদের দিয়ে। রাশিয়া সেটা করেছিল যুদ্ধবন্দী আর ভিন্ন মত পোষণকারী  রাজনৈতিক বন্দীদের দিয়ে। লেনিন ভুলটা বুঝতে পেরে নিউ ইকনমিক পলিসির মাধ্যমে কিছু পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন, তবে তাঁর মৃত্যুর পর সব ভণ্ডুল হয়ে যায়। একই ঘটনা আমরা দেখি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে। শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্কই পরিবর্তিত হয় না, জলের দামে কল-কারখানা বিক্রি করে দিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়। এসব কাজের নায়ক চুবাইস নিজেই স্বীকার করেছেন, «আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করা যাতে তা আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।» ফলে নব্বইয়ের দশকের সেই অরাজকতা। আসলে ধ্বংসের ফিলসফি নিয়ে সৃষ্টি করা যায় না।

প্রশ্ন হল, ধর্ম যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে মানব মানসে আধিপত্য বিস্তার করে আছে সেখানে মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ যদি ধর্মই হয় তবে এই পতন কেন? ধর্ম ফলের কথা বলে মৃত্যুর পরে,  পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ এসব দিতে চায় এই জীবনে। খ্রুশেভ ১৯৮০ সালে সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। বরং দেশ আরও সংকটে ডুবে গেছে। সত্তরের দশকে এ দেশে ছিলাম না, তবে বন্ধুদের মুখে, বিভিন্ন সিনেমায় দেখেছি ব্রেঝনেভের ঐ যুগকে অনেকটা স্বর্ণযুগ বলে অনেকেই মনে করত। যদিও স্থবিরতা চারিদিক গ্রাস করেছিল, কিন্তু শান্তি ছিল। ১৯৫৬ সালে  হাঙ্গেরি ও ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত সৈন্য প্রেরণ দেশে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। যদিও প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ তেমন ছিল না, এ নিয়ে মানুষের মাঝে ক্ষোভ ছিল। সেদিক থেকে সত্তরের দশক ছিল মেঘমুক্ত। এমনকি ১৯৭৯ সালের আফগান আক্রমণ তখনও মানুষকে এতটা ভাবিত করেনি। কিন্তু আশির দশকে পরপর কয়েকজন নেতার মৃত্যু, স্তাব্রপোলের জনপ্রিয় নেতার আকস্মিক মৃত্যু, যা গরবাচেভকে ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে দেয় আর সর্বোপরি বাজারে পণ্যের অভাব – এসব মানুষকে কমিউনিজম সম্পর্কে হতাশ করে তোলে। আসলে কমিউমিজম প্রায় ধর্মের মত করে সাম্যের কথা বললেও যেটা করেনি, সেটা হল ভারতীয় দর্শনের মত কর্মই ধর্ম এটা ঘোষণা করা। কর্ম – এটা কাজ। আমি আজ যা করব, কাল সেই ফল ভোগ করব। আমার কর্মই আমার ভাগ্য নির্ধারণ করবে। তবে পুরহিতরা নিজেদের স্বার্থে এই জন্মের কর্মফল পরের জন্মে পাচার করে কর্মই ধর্ম সেই মহান বাণীকে অন্তঃসার শূন্য করেছে। যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন মানুষকে কর্মই ধর্ম সেই শিক্ষা দিতে পারত, মানুষকে কাজের ক্ষেত্রে উদ্যোগী করে তুলতে পারত, তাহলে হয়তো তাদের এই অর্থনৈতিক দুর্যোগে পড়তে হত না। এখানে লাখ লাখ মানুষ বলতে গেলে কিছু না করে বেতন পেয়ে স্বর্গসুখ ভোগ করেছে, কিন্তু যারা কর্মকে ধর্ম হিসেবে নিয়েছে তারা অনেক সময়ই অতি উৎসাহের অভিযোগে কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়েছে।

অনেকেই বলতে পারেন এখন এসব কথা বলে কী হবে? অক্টোবর বিপ্লব – এটা বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা, যা শুধু রাশিয়া নয়, সমস্ত বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তন আনতে বাধ্য করে। শুধু তাই নয়, এই ঘটনা সারা বিশ্বের মানুষের মানসিক পরিবর্তন ঘটায়। তাই এমনকি সোভিয়েত ব্যবস্থা ব্যর্থ হলেও তাকে কোন মতেই এড়ানো যায় না। এই ব্যবস্থা ভবিষ্যতে পৃথিবী কোন পথে যাবে সেই দিকও নির্দেশ করে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য যেমন আমাদের অনুপ্রেরিত করেছে সমাজতন্ত্রকে মুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করতে, এর ব্যর্থতা আমাদের দেখাবে কোন ভুলগুলো থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। এখানে আমাদের বুঝতে হবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা মানুষের জন্য, পার্টির জন্য নয়। তাই কমিউনিস্ট পার্টিকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের একমাত্র লাইসেন্সধারী পার্টি হিসেবে দেখাটা ভুল। তাহলে আমরা বিপ্লবের পর যত না মানুষের স্বার্থ দেখব তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকব পার্টির স্বার্থ দেখতে। সোভিয়েত ইউনিয়নে এক সময় সেটাই হয়েছে। আজ গণতান্ত্রিক বা গণতন্ত্রের থ্রিপিস পরা অনেক দেশেই সেটা হচ্ছে। ফলে দেশ নয়, দল হচ্ছে সবার উপরে, আর যখনই দেশের উপর দল স্থান পেয়েছে, একই সূত্র ধরে দলের চেয়েও বড় হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তি। আর সেটা হচ্ছে সব পর্যায়েই। তাছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের বুঝতে হবে যে বিপ্লব কোন ফর্মুলা মেনে চলে না। গণিতে যেমন সঠিক রেজাল্ট পাওয়ার জন্য ইনিশিয়াল বা বাউন্ডারী কন্ডিশন অপরিহার্য, বিপ্লবের সাফল্যের জন্যও তেমনি অপরিহার্য দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সাথে সাথে জনগণের মানসিক অবস্থা, তাদের বিশ্বাস, রীতিনীতি এসব ব্যাপারগুলোর সঠিক প্রয়োগ।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো