পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পতাকা
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পতাকা

রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষার নামে ১৯৭১ সালে দেশের বাঙালি নাগরিকদের বিরুদ্ধে চরম হত্যা নির্যাতনের পথ নিয়েও বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠনের মাত্র ২৪ বছরের মাথায় রক্তাক্ত এক যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ভেঙে যায় পাকিস্তান।

পঞ্চাশ বছর পর সেই ইতিহাসের কাটাছেঁড়া কিভাবে হচ্ছে বর্তমানের পাকিস্তানে? বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে কীভাবে দেখা হয় সেখানে?

ধারণা পেতে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে পাকিস্তানের সমাজ ও রাজনীতির স্বনামধন্য কজন পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকের সাথে।

উনিশ’শ একাত্তর সালে যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হিসাবে যে যুক্তি যে ব্যাখ্যা বহুদিন ধরে পাকিস্তানের সামরিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশের মানুষকে গেলানোর চেষ্টা করে গেছেন তা হলো – তাদের দেশ ভারতের চক্রান্তের শিকার হয়েছে। বাঙালিদের ওপর হত্যা নির্যাতনের কথা যতটা সম্ভব চেপে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে।

পঞ্চাশ বছর পরেও সরকারি সেই ব্যাখ্যায় কি নড়চড় কিছু হয়েছে?

করাচিতে গবেষণা সংস্থা ইন্সটিটিউট অব হিস্টোরিকাল এবং সোশ্যাল রিসার্চের পরিচালক ড. সৈয়দ জাফর আহমেদ মনে করেন, ১৯৭১ নিয়ে পাকিস্তানে সরকারি ব্যাখ্যা গত ৫০ বছরে তেমন বদলায়নি।

“দুঃখজনকভাবে বদলায়নি। সরকারি পর্যায়ে আমরা এখন পর্যন্ত সেই ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ দেখি না,” বিবিসি বাংলাক বলেন ড. আহমেদ।

“সবাই জানে দেশের একটি অংশ চলে যাওয়াটা ছিল ট্রাজেডি, ব্যর্থতা, কিন্তু কেন তা হলো তা নিয়ে সত্যিকারের কোনো ব্যাখ্যা তারা পায়নি। মানুষ শুধু শুনেছে ভারত ছিল এর পেছনে এবং আওয়ামী লীগ ভারতের পক্ষে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।”

পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার সূচনা

তিনি বলেন, যুদ্ধের পর বহুদিন পর্যন্ত এটা নিয়ে তেমন কোনো কথাই হয়নি। এখনও স্কুলের সিলেবাসে সেই ইতিহাস নেই। “বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কথাবার্তা হয়, কিছু প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু সে পর্যন্তই।”

ড. আহমেদ, যিনি প্রায় ২০ বছর করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি এবং ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন, বলেন, ১৯৭১ এ ভারতের ভূমিকা অবশ্যই ছিল, কিন্তু প্রধান কারণ ছিল পাকিস্তানের একের পর এক সরকারের ব্যর্থতা যা দিনে দিনে বাঙালিদের মধ্যে বৈষম্য এবং বঞ্চনার মনোভাব শক্ত করেছে।

“বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। উনিশ’শ সাতচল্লিশ- এ দেশভাগের সময় বেঙ্গল ছিল পাকিস্তানের একমাত্র অঞ্চল যেখানে মুসলিম লীগ ক্ষমতায় ছিল। অথচ দেশ সৃষ্টির পর ঐ অঞ্চলের মানুষ সমান প্রতিনিধিত্ব পায়নি। এর প্রধান কারণ ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গিয়েছিল আমলা এবং সেনাবাহিনীর হাতে। সেখানে গোষ্ঠী স্বার্থ ছিল প্রধান বিবেচনা।”

“পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি করতে নয় বছর লেগেছে। ফলে বৈষম্য ঘোচানোর আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরিতেই বহু সময় চলে যায়। তারপর ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হয়ে যায়। আমি মনে করি পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সূচনা হয়ে যায় তখনই।”

ড. সৈয়দ জাফর আহমেদ
ড. সৈয়দ জাফর আহমেদ, পরিচালক, ইন্সটিটিউট অব হিস্টোরিকাল এবং সোশ্যাল রিসার্চ, করাচি

ভারতের ভূমিকায় পাকিস্তানের মুখরক্ষা

ড. আহমেদ মনে করেন, অভ্যন্তরীণ বিরোধ-অসন্তোষ মেটানোর রাজনৈতিক “সৃজনশীলতা” পাকিস্তানের শাসকদের মধ্যে ছিল না বলেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল। “বিরোধ নিরসনে রাজনীতিক এবং সেনা নেতৃত্বের মধ্যে ক্রিয়েটিভিটির দারুণ অভাব ছিল। উনিশ’শ সত্তর সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া উচিৎ ছিল। ভুট্টো মানেননি। সর্বনাশা সিদ্ধান্ত ছিল।”

“আমি মনে করি ১৯৭১ এ ভারতের ভূমিকা পাকিস্তানের সেসময়কার শাসকদের মুখরক্ষা করেছে। তারা অন্তত মানুষকে একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।”

তবে ড. আহমেদ বলেন, সরকারের কাছ থেকে কিছু না শুনলেও বা স্কুল-কলেজে বইপত্রে কিছু না পড়লেও ডিজিটাল মিডিয়ার সূত্রে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই সত্যিকারের ইতিহাস জানার চেষ্টা করছে। “আমার ২৬ বছরের শিক্ষকতার জীবনে বহু তরুণ-যুবকের সাথে আমার ওঠাবসা হয়েছে। আমি সেই আগ্রহ দেখেছি।”

পর্দা সরে যাচ্ছে

পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এবং পাকিস্তান সেনা গোয়েন্দা সংস্থার ( আইএসআই) সাবেক প্রধান লে. জে. (অবসরপ্রাপ্ত) আসাদ দুররানি বিবিসি বাংলাকে বলেন, গত ৫০ বছরে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো স্বীকারোক্তি না এলেও পাকিস্তানের মানুষ এখন অনেকটাই বুঝতে পারছে কোথায় গলদ হয়েছিল।

“মানুষের মনে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে ভুল হয়েছিল। সেনাবাহিনীর ভুল হয়েছিল। নির্বাচনের পর (সত্তরের নির্বাচন) শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব মেনে না নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো ভুল করেছিলেন। এখন সাধারণ মানুষের স্তরেও এই বোধ পৌঁছে গেছে।”

জেনারেল দুররানি বলেন, ভারত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। “ঘরের ভেতর সমস্যা থাকলে শত্রু তো সুযোগ নেবেই। তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।”

তবে জেনারেল দুররানি বলেন, এখনও ১৯৭১ নিয়ে তেমন কোনো কথাবার্তা প্রকাশ্যে পাকিস্তানে হয় না। “ডিসেম্বর এলে কিছু মানুষ কথা বলেন, লেখেন। কথা তেমন হয় না কারণ গত ৫০ বছরে আরো অনেক কিছু ঘটে গেছে পাকিস্তানে।”

পাকিস্তানে সিনিয়র সাংবাদিক নাসিম জেহরা বলেন, আমজনতা হয়তো ১৯৭১ নিয়ে মাথা ঘামায় না, কিন্তু যারা দেশ এবং সমাজ নিয়ে চিন্তা করেন, কথা বলেন, লেখালেখি করেন তারা এখন জানেন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপনায় ভুল হয়েছিল।

“অন্য অনেক বিষয়ের মত ১৯৭১ নিয়েও আত্মসমালোচনা এবং আত্মউপলব্ধি হচ্ছে। ভারতের ভূমিকা যে ছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু নিজেদের ভুলের পরিণতি নিয়েও অনুশোচনা বা দুঃখবোধ মানুষের রয়েছে।”

বাংলাদেশ সৃষ্টির পরিণতি

উনিশ’শ একাত্তর সালে দেশ ভেঙ্গে যাওয়ার পরিণতি কী হয়েছে পাকিস্তানের ওপর? পাকিস্তান কি দুর্বল হয়েছে?

পাকিস্তানে অবশ্য কোনো কোনো মহলে এমন বিশ্বাস রয়েছে হাজার মাইল দূরে ভারতঘেরা দেশের একটি অংশ যেখানকার মানুষের সাথে ভাষা-সাংস্কৃতির বহু অমিল সেটিকে অক্ষুণ্ণ রাখা প্রায় অসম্ভব ছিল। পাকিস্তানে অনেকে এমনও মনে করেন, ৭১-পরবর্তী পাকিস্তানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং এর প্রতিরক্ষা সহজতর হয়েছে।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আসাদ দুররানি
লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আসাদ দুররানি, পাকিস্তান সেনা গোয়েন্দা সংস্থার ( আইএসআই) সাবেক প্রধান

তবে এসব যুক্তি মানেন না জেনারেল আসাদ দুররানি। তিনি মনে করেন একাত্তরের পরিণতিতে রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে।

“সবদিকে দিয়ে ক্ষতি হয়েছে পাকিস্তানের। প্রথম কথা পূর্ব পাকিস্তানকে হারানোর মনস্তাত্ত্বিক আঘাত ছিল সাঙ্ঘাতিক। অনেকে হাজার মাইল দূরের দোহাই দেন। অনেকে বলেন দুটো সীমান্ত সমানভাবে সুরক্ষিত না রাখতে পারলে একটি ভালোভাবে রক্ষা করাই শ্রেয়। কিন্তু আমি মনে করি দুটো সীমান্তের কৌশলগত অনেক সুবিধাও রয়েছে, এবং সঠিক কৌশল নিলে দেশ অখণ্ড রাখা যেত।”

“উনিশ’শ আশির দশকে ভারতের ভেতর থেকে অনেক মানুষ বলেছেন, বাংলাদেশ করে আমাদের লাভ কী হলো? সেই আরেকটি ফ্রন্টতো রয়েই গেল। তার অর্থ দুটো পৃথক সীমান্তের কৌশলগত ফায়দা নষ্ট হয়েছে পাকিস্তানের।”

‘পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ক্ষতি হয়েছে’

ড. জাফর আহমেদ মনে করেন পূর্ব পাকিস্তান চলে যাওয়ায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ক্ষতি তেমন না হলেও, রাজনীতির ক্ষতি হয়েছে অনেক।

“পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মধ্যবিত্ত পশ্চিমের তুলনায় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অনেক বেশি তৎপর ছিলেন। অন্যদিকে পশ্চিমের অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্তা ছিলেন ভূস্বামী এবং উপজাতীয় নেতারা। গণতন্ত্রের বাতাসটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে আসতো যা ১৯৭১ সালের পর বন্ধ হয়ে যায়।”

“সন্দেহ নেই পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। উনিশ’শ একাত্তর সালের পর ১৯ বছর ধরে পাকিস্তানে সামরিক শাসন চলেছে।”

সাবেক আইএসআই প্রধান জেনারেল দুররানি মনে করেন বাংলাদেশের সাথে আস্থা এবং সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি করা গেলে, তার ভাষায়, ‘৭১ এ পাকিস্তানের যে ক্ষতি হয়েছে তা অনেকটা পুষিয়ে নেওয়া যেত।’

কিন্তু, তিনি বলেন, গত ১৮ বছর ধরে পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের চেষ্টা করলেও অগ্রগতি তেমন কিছু হয়নি।

নাসিম জেহরা
নাসিম জেহরা, সিনিয়র সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক

বাংলাদেশকে কাছে চায় পাকিস্তান

জেনারেল দুররানি ছাড়াও বাকি তিন পর্যবেক্ষকও বিবিসি বাংলার কাছে প্রায় অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন – বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য পাকিস্তান আগ্রহী, কিন্তু বাংলাদেশের কাছ থেকে তেমন সাড়া নেই।

সাংবাদিক নাসিম জেহরা বলেন, বিশেষ করে গত এক বছর ধরে ইমরান খানের সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা চলছে।

“জনগণের স্বার্থে পাকিস্তান এখন আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়তে খুবই আগ্রহী। একই ইতিহাস এবং সংস্কৃতির অংশীদার হওয়ায় বাংলাদেশের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তান এখন অন্য পক্ষের (বাংলাদেশের) সাড়ার জন্য অপেক্ষা করছে,” তিনি বলেন।

পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সেনেটর এবং লেখক জাভেদ জব্বার বিবিসি বাংলাকে বলেন, মিডিয়ায় খোলাখুলি না এলেও পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশ এবং সেদেশের মানুষের জন্য প্রচুর “শুভ কামনা” রয়েছে।

“শিক্ষকতা এবং দাতব্য কাজের সূত্রে নিয়মিত বহু মানুষের সাথে আমার দেখা হয়, কথা হয়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এখন বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক নিয়ে অনেক আগ্রহী হয়ে উঠছে। উনিশ’শ একাত্তরে এ যা হয়েছে তার জন্য তারা অনুতপ্ত।”

ক্রিকেট একমাত্র যোগাযোগ

কিন্তু, মি জব্বার বলেন, দুই দেশের সম্পর্কে এখনও “গভীর এক শূন্যতা বিরাজ করছে।”

“শুধু ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রেই তেমন যোগাযোগ হচ্ছে না – তা মানুষে মানুষে যোগাযোগ বলুন, রাজনীতিক ক্ষেত্রে বলুন বা অর্থনীতির ক্ষেত্রে বলুন… দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এ ব্যাপারে পাকিস্তান যত আগ্রহী বাংলাদেশ ততটা নয়।”

জাভেদ জব্বার
জাভেদ জব্বার, পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী এবং লেখক

যুদ্ধাপরাধের বিচার

বাংলাদেশের দাবি সু-সম্পর্কের আগে ১৯৭১ এ হত্যাকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানকে শর্তহীনভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালে এই দাবি জোরদার হয়েছে। একই সাথে বাংলাদেশ দাবি করে ১৯৭১ এ হত্যা নির্যাতনে জড়িত পাকিস্তানী সৈন্যদের বিচার করতে হবে।

পাকিস্তান এই দাবিতে চুপ। বরঞ্চ যুদ্ধাপরাধের বিচারে কয়েকজন জামাত নেতার ফাঁসির পর পাকিস্তানের সমালোচনার পর সম্পর্ক দুই দেশের সম্পর্ক আরো শীতল হয়েছে।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত একমাত্র জেনারেল পারভেজ মুশাররফ তার ক্ষমতাকালে ২০০২ সালের জুলাইতে ঢাকা সফরে গিয়ে ১৯৭১ নিয়ে ক্ষমা না চাইলেও দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।

উনিশ’শএকাত্তরের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধে গিয়ে সেখানে রাখা ভিজিটর বুকে তিনি লেখেন, “পাকিস্তানে আপনাদের ভাইবোনেরা ‘৭১ এর ঘটনার জন্য সমব্যথী। দুঃখজনক ঐ ঘটনার সময় যে বাড়াবাড়ি করা হয়েছে তার জন্য তারা দুঃখিত। আসুন আমরা উদারতা দেখিয়ে অতীত ভুলে যাই। ভবিষ্যতের আলোকে যেন আমরা নিভে যেতে না দেই।”

বাংলাদেশ মনে করে এ ধরণের দুঃখপ্রকাশ যথেষ্ট নয়, পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে শর্তহীন ক্ষমা চাইতে হবে।

ক্ষমা চাওয়া না চাওয়া

পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর মধ্যে এ ধরনের ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। তারা এমন ক্ষমা চাওয়াকে মর্যাদাহানির সামিল বলে মনে করেন। একই সাথে পাকিস্তানে অনেকেই যুক্তি দেন যে ১৯৭১ সালে প্রচুর সংখ্যায় অবাঙালিকেও হত্যা করা হয়েছে যার জন্য বাংলাদেশেরও ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।

সাবেক মন্ত্রী জাভেদ জব্বার বলেন, “একাত্তর সালে পহেলা মার্চের পর থেকে যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান সংহত করতে পারেনি সে সময়ে প্রচুর অবাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। সেসব হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ রয়েছে। সুতরাং ক্ষমার প্রশ্ন উঠলে দু পক্ষেরই সেই দায় রয়েছে।”

জেনারেল দুররানি মনে করেন দুই দেশের নেতৃত্বের মধ্যে ‘ইগো’ কাজ করছে, তবে এই ইগো কখনই দূর হবে না তা তিনি বিশ্বাস করেন না ।

“ক্ষমা চাইলেই সব ক্ষত দূর হয় না। তারপরও আমি মনে করি ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটি একবারে অসম্ভব কিছু নয়.” তিনি বলেন।

”বার্লিন দেয়াল যদি ভেঙে পড়তে পারে, সেভিয়েতরা যদি আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যেতে পারে, পাকিস্তানও একদিন ক্ষমা চাইতেই পারে। প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কবে হবে?”

জে. পারভেজ মোশাররফ
পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক এবং প্রেসিডেন্ট জে. পারভেজ মোশাররফ।

ক্ষমা চাওয়ার নমুনা বিরল

ড. জাফর আহমেদও মনে করেন ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নে পাকিস্তানী শাসকশ্রেণী এবং শেখ হাসিনা তাদের নিজেদের ‘ন্যারেটিভের বেড়াজালে আটকা পড়েছেন।’ তার মতে, দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে, মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়লে এক সময় ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি সহজ হয়ে উঠবে।

সাবেক মন্ত্রী জাভেদ জব্বার বলেন, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের উচিৎ বিভিন্ন পর্যায়ে – খোলাখুলি এবং একই সাথে পর্দার আড়ালে আলোচনা মীমাংসার মাধ্যমে জটিল এবং স্পর্শকাতর প্রশ্নগুলোর সমাধান করে ফেলা। “তখন ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটিও সহজ হবে।”

“দেখুন যুদ্ধ বিগ্রহের পর ক্ষমা চাওয়ার নমুনা বিরল। হিরোশিমা- নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা ফেলার জন্য কি আমেরিকা ক্ষমা চেয়েছে? ভারত কি কাশ্মীর নিয়ে কখনো ক্ষমা চেয়েছে? ফিলিস্তিনীদের দেশছাড়া করার জন্য ইসরায়েল কি ক্ষমা চেয়েছে? তাহলে পাকিস্তান কেন ব্যতিক্রম হবে? কিন্তু তারপরও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে সেটাও অসম্ভব নয়,” মি. জব্বার বলেন।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা