চলমান সংবাদ

বুদ্ধিজীবী দিবস ও আমরা

– বিজন সাহা

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির অনেক সূর্য সন্তান, যারা মাত্র দু’দিন পরে স্বাধীনতা লাভ করা জাতিকে পথ দেখাতে পারতেন, নিয়ে যেতে পারতেন অভীষ্ট লক্ষ্যে, প্রাণ হারিয়েছিলেন পাক হানাদার আর তাদের দেশীয় দোসরদের হাতে। আসন্ন পরাজয় বুঝতে পেরে ওরা হেনেছিল শেষ আঘাত, ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিল জাতির মেরুদণ্ড। আজ দেশের সার্বিক অবস্থার দিকে তাকালে বুঝি এ ব্যাপারে ওরা অনেকটাই সফল হয়েছিল।

অনেকেই প্রশ্ন করেন কেন এই জ্ঞানী গুণী লোকেরা এত বিপদের মধ্যেও পরিবার পরিজন নিয়ে দেশে থেকে গেলেন, পালালেন না, অনেকেই সরকারি চাকরি করে গেলেন। এ প্রশ্ন আমার মাথায় যে কখনও আসেনি তা নয়। কিন্তু যদি একটু ভেবে দেখি, বুঝব এদের থেকে যাওয়াটাও স্বাধীনতার জন্য অপরিহার্য ছিল। সেই বিপদ সংকুল দেশে থেকে এরা নিজের নিজের মত করে স্বাধীনতার জন্য কাজ করে গেছেন।  সেই সময়ে ভারতে প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। আরও কয়েক হাজার বুদ্ধিজীবী তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে সেখানে গেলে হয়তো তাদেরও জায়গা হত। পাক বাহিনী আর তাদের দোসররা তো সেটাই চেয়েছিল। তারা তো দেশের মানুষ চায়নি, চেয়েছে মাটি। তাই সবাই যদি ওপার চলে যেত তাহলে তো ওদের বরং সোনায় সোহাগা হত। তাই তো একদল মানুষ সব বিপদ জেনেও থেকে গেছেন, ভেতর থেকে চালিয়ে গেছেন যুদ্ধ। এরাই মনে হয় শত্রুর শিবিরে লুকিয়ে থাকা মিত্র, যারা বিভিন্ন ভাবে দেশের পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের, প্রয়োজনে আশ্রয় দিয়েছেন। আসলে যেকোনো যুদ্ধে শত্রু  শিবিরে নিজেদের লোক পাঠানোর রেওয়াজ নতুন নয়।  থেকে যাওয়া এরাই ছিলেন শত্রু শিবিরে আমাদের মানুষ, ছিলেন সেই অন্ধকারে ছোট ছোট আলোকবর্তিকা যা মুক্তিকামী মানুষদের পথ দেখাত।

 

জানিনা শহীদ না হলে এই সব বুদ্ধিজীবীদের কে আজ কোথায় থাকতেন, কার কোন শিবিরে অবস্থান হত। অন্তত বর্তমানে বুদ্ধিজীবী বলে যারা নিজেদের দাবি করেন তাদের অধিকাংশকে দেখলেই এই প্রশ্ন  মাথায় আসে। বুদ্ধিজীবী – উনি কি শুধুই বুদ্ধির ফেরিওয়ালা? আর বিক্রি করেন যে বেশি দাম দেয় তার কাছে?  বুদ্ধিজীবী যদি মুক্তবুদ্ধির মানুষ না হন, যদি অন্ধভাবে কাউকে সমর্থন বা কারও বিরোধিতা করেন তবে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত লাভের খাতায় দুটো পয়সা আনলেও দেশের কোন লাভ তাতে হয় না। নিরপেক্ষভাবে কোন ঘটনা বিচার করতে না পারলে অনেক সময়ই ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছুনোর সম্ভাবনা থাকে। তাই দল করার পরেও ঘটনার বিশ্লেষণে বুদ্ধিজীবীদের দলনিরপেক্ষ থাকাটা জরুরি। কেন আমরা প্রতি বছর ঘটা করে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি, অথচ স্বাধীন দেশে একটা সত্যকার বুদ্ধিজীবী শ্রেণি গড়ে তুলতে পারলাম না সেটা ভাবার বিষয়। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার অর্জনগুলো এই যে আজ দলীয় অর্জনে পরিণত হচ্ছে সেটার উৎসও এখানেই। আচ্ছা, আমরা যখন একাত্তরের কথা বলি তখন কি কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আর কিছু মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া আর কারও মুখ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে?  নাকি ত্রিশ লক্ষ আর দুই লক্ষ এই দুটো সংখ্যার মধ্যেই সবাই হারিয়ে যায় তাদের আত্মত্যাগ, তাদের অশ্রু, ঘাম, রক্ত – সব?

 

আমি রাশিয়ায় সেই ১৯৮৩ থেকে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শহরে বা গ্রামে যাই বেড়াতে বা কাজে। একটা জিনিস যা সব জায়গায় দেখি – সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত অজানা সৈন্যের সমাধি, অনেক ক্ষেত্রেই সেখানে জ্বলে অনির্বাণ শিখা আর তাতে লেখা «কাউকে ভুলিনি, কিছুই ভুলিনি।»  এসব মেমরিয়ালে আছে দেয়ালে খোঁদাই করা অনেক নাম, সেই লোকদের নাম যারা সেই এলাকা থেকে যুদ্ধে গিয়ে ফিরে আসেনি। এখনও বাবা মারা তাদের সন্তানদের নিয়ে সেখানে যায়, শ্রদ্ধা জানায় সেই সব মানুষদের যাদের ত্যাগের বিনিময়ে বর্তমান প্রজন্ম আজ বেঁচে আছে। আমাদের দেশে এখনও কতজন মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারাল সেই তালিকা নেই। তাই তো বিভিন্ন শক্তি সাহস পায় সংখ্যাটার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করতে। আর সেটা পারে বলেই স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধারা আজ অবহেলিত। বাংলার বুকে আবার শোনা যায় পাকিস্তানের প্রেতাত্মার উল্লাস।

এই মানুষগুলো, এই বুদ্ধিজীবীরা কি শুধু মাটির জন্য লড়াই করেছিল? তারা চেয়েছিল বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে। কিন্তু আজ আমরা কী দেখি? পাঠ্যপুস্তক থেকে অবলীলায় বাদ পড়ে যায় এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের লেখা। গান গাইবার অপরাধে জেল খাটতে হয় বাউলদের। আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই মুক্তিযোদ্ধাদের, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার প্রতি সম্মান দেখাতে চাই তাহলে একাত্তরের সব শহীদদের তালিকা প্রস্তুত আজ যুগের দাবি, সেটা রাজাকারের তালিকা তৈরির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বুদ্ধিজীবী তিনি বুদ্ধি যার জীবিকা নয়, বুদ্ধি যার জীবন। এটা তখনই সম্ভব যখন বুদ্ধি অন্ধবিশ্বাসের দাস নয়, সীমাহীন আকাশে মুক্ত বিহঙ্গ।

 

দুবনা, ১৪ ডিসেম্বর ২০২১