বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (২০)

– বিজন সাহা

সোভিয়েত আমলে অক্টোবর বিপ্লবের কথা বললেই মনে হত এক নতুন সমাজের কথা, দেশে দেশে বাম ঘরানার মানুষ স্বপ্ন দেখত কবে তাদের দেশেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর অন্য অনেক প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে। যেমন কেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙল? এই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। সেই আলোচনা যেমন এদেশে, তেমনি বহির্বিশ্বেও চলছে। এদেশে যারা সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থাকে ভালবাসেন তারা দোষ দিতে চান বাইরের শক্তি আর অযোগ্য নেতৃত্বকে, যারা সমাজতন্ত্র বিরোধী তারা বলতে চান সিস্টেমটাই ভুল। আসলে আমার মনে হয় এর কারণ বহুমুখী – বাইরের চাপ ও নিজেদের ভুল সব মিলিয়েই এই বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার কথা বলি, তবে সেটার পেছনে যতটা না অবজেক্টিভ কারণ ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল সাব্জেক্টিভ কারণ। অন্তত সেই সময়। যদিও বাল্টিকের দেশগুলোতে কখনই সোভিয়েত ব্যবস্থা জনপ্রিয় ছিল না, আর পশ্চিমা বিশ্ব ঐ তিনটি রিপাবলিককে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ বলে মেনে নেয়নি, তারাও গরবাচেভের নতুন বিন্যাসে রাজী হয়েছিল। জর্জিয়ায় কিছুটা সমস্যা বরাবরই ছিল আর সমস্যা ছিল ইউক্রাইনের পশ্চিম অঞ্চলে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকবে কি থাকবে না এই ব্যাপারে এদেশের অধিকাংশ মানুষই পক্ষে ভোট দেয়। কমিউনিস্ট পার্টি ছিল প্রচণ্ড রকম দুর্নীতিগ্রস্থ, তাই সাধারণ মানুষ পার্টিকে তেমন পছন্দ করত না। ফলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয় একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় সেটাকে পূরণ করার মত কেউ ছিল না। আর এ কারণেই তিন স্লাভিয়ান রিপাবলিক, যথা রাশিয়া, ইউক্রাইন ও বেলরাশিয়ার তিন নেতা ইয়েলৎসিন, ক্রাভচুক আর শুষকেয়েভিচ জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করেই দেশ ভেঙ্গে দিয়েছে। এশিয়ান রিপাবলিকগুলো বেরিয়ে যায় নি, তিন নেতার সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এখনও এক্স সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিকাংশ দেশ বিভিন্ন চুক্তিতে আবদ্ধ। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গাটা ছিল অনেকটা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। সেখানে বাইরের শক্তির হাত থাকলেও মূল ঘটনা ঘটেছে মস্কোয় ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে।

তাই মনে হয় আমাদের দেখা দরকার সমস্যা কি সমাজতন্ত্রে নাকি অন্য কিছুতে। সমাজতন্ত্র যতটা না রাজনৈতিক ব্যবস্থা তারচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ডক্ট্রিন। অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি কায়েম অসম্ভব। জাতীয় সম্পদের বন্টন ব্যবস্থা হল এর অন্যতম প্রধান কথা। কিন্তু কথা হচ্ছে বণ্টন করার জন্য সম্পদ উৎপাদন করা দরকার। যদি সম্পদ না থাকে তাহলে বন্টনের প্রশ্ন আসবে কিভাবে?

যেহেতু বিপ্লবের পর পর এ দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা যার পর নাই খারাপ ছিল তাই সরকারের প্রায় সব পদক্ষেপই তাদের পক্ষে গেছে। তবে ধনী ও মধ্য বিত্ত শ্রেণীর পক্ষে যে সেটা যায়নি তা সে সময়ের বিভিন্ন আনেকদোত থেকে বোঝা যায়।

বিপ্লবের সময় রাস্তায় শোরগোলের শব্দ শুনে এক অভিজাত ধনী গৃহকর্ত্রী তার পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করলেন

রাস্তায় এত গোলমাল কিসের?
শ্রমিকেরা উন্নত জীবনের জন্য মিছিল করছে।
সে তো আমরাও চাই যে ওরাও ধনী হোক। কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে ওরা সবাইকে গরীব বানাতে রাস্তায় নেমেছে।

হ্যাঁ, বিপ্লবের পর পর সবাইকে সমান করার চেষ্টায় শত শত মানুষকে যেমন গৃহহারা করা হয়েছিল, তেমনি হাজার হাজার মানুষকে দেওয়া হয়েছিল মাথা গোঁজার ঠাই। এরপর গৃহযুদ্ধ, স্তালিনের উৎপীড়ন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ – একের পর এক বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে এদেশের সাধারণ মানুষকে। এসবের পাশাপাশি মানুষ পেয়েছে শিক্ষার সুযোগ, কৃষি প্রধান দেশ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিণত হয়েছে শিল্প প্রধান দেশে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই সোভিয়েত ব্যবস্থার হাত ধরেই এসেছে পারমাণবিক অস্ত্র, কৃত্রিম উপগ্রহ, এসেছে মহাশূন্য বিজয়। কিন্তু সমষ্টির জন্য এসব অনেক উদ্দীপনার জন্ম দিলেও ব্যক্তি মানুষের জীবনে তার প্রভাব কম। কেননা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সবাই মিলে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠা যায় ঠিকই, কিন্তু ঘরে ফিরলে সেটা দিয়ে পেট ভরে না। ব্যক্তি জীবনে দরকার অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা এসব। বলব না যে সোভিয়েত জীবনে এসব ছিল না, ছিল, তবে সেটা শরীরের খোঁড়াক মেটানোর জন্য যথেষ্ট হলেও মনের খোঁড়াক মেটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। কী ব্যক্তি জীবনে, কী সামাজিক জীবনে – সমস্যার শুরু হয় অসন্তোষ থেকে। আর এই অসন্তোষ ছিল সমাজের প্রায় সর্ব স্তরে। তার কারণ ছিল একটাই – নো চয়েজ। রাজনীতিতে যেমন সিপিএসইউ ছাড়া অন্য কোন কিছু বেঁছে নেওয়ার উপায় ছিল না, প্রায় একই ঘটনা ছিল জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। কী খাবারদাবার, কী পোশাকআশাক, কী চাকরিবাকরি – সবই প্রায় নিয়তির মত নির্ধারিত ছিল। তাই এক দিকে সমাজতন্ত্র যেমন লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষকে, মানুষের মনকে মুক্তি দিয়েছিল, অন্য দিকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাকে খুব ছোট্ট এক গণ্ডীর মধ্যে বেঁধে রেখেছিল। আর এর ফলেই সমাজে এক ধরণের আন্টাগোনাস্টিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল। রাষ্ট্রের কড়া নজরে এসব ঘটনা বাইরে বেরুতে না পারলেও রান্না ঘরে এসব নিয়ে মানুষ আলোচনা করত। পার্টির লোকজন কী এসব জানত না? নিঃসন্দেহে জানত। তবে যেহেতু পার্টির নেতারা প্রায় সবাই কমবেশি বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করত, হয়তো এ কারণে এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাত না। আসলে দেশে ছিল এক ধরণের দ্বৈত শাসন – প্রশাসনের ও পার্টির। আর অনেক ক্ষেত্রেই পার্টির ক্ষমতাই ছিল বেশি। আমরা যদি নিজ নিজ দেশে প্রশাসনের কাজে সরকারি দলের হস্তক্ষেপ না মানতে পারি এ দেশে মানুষ সেটা মানবে কেন?

আমার এখনও মনে আছে মানব সমাজের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে মার্ক্সীয় দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে সামাজিক উন্নয়নের কয়েকটি ধাপের কথা বলা হত – আদি সাম্যবাদী সমাজ, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ। হয়তো এ থেকে পার্টির নেতা কর্মীদের এ ধারণাই ছিল যে যেহেতু সমাজতন্ত্র সমাজ বিকাশের এ ধারায় পুঁজিবাদের চেয়ে উপরে সেহেতু এর আর কোন মতেই পুঁজিবাদে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সমাজের এই ধাপ উত্তরণ মনে হয় পিছল বাঁশ বেয়ে বানরের উপরে ওঠার মত, হাত একটু শিথিল করেছ তো হিড়হিড় করে নীচে নেমে যাবে। এখানে হাত শিথিল করা মানে কম শক্তি প্রয়োগ করা নয়, মানুষের অধিকারের দিকে, স্বার্থের দিকে নজর না দেওয়া। এখানেও হয়তো মার্ক্সবাদের প্রতি অন্ধবিশ্বাসই কাজ করেছে।

আরও একটা জিনিস যেটা ভাবা দরকার তা হল আল্টিমেটলি দেশটা কার ছিল। কেন বলছি? আসলে বিপ্লবের পরে ছিল সর্বহারার একনায়কত্ব। কিন্তু যখন সর্বহারা দেশের মালিক হল সে কি তখনও সর্বহারাই রইল। তাছাড়া এ কথা তো ঠিক শুধু মাত্র কৃষক বা শ্রমিক দিয়েই একটা দেশ, একটা সমাজ চলতে পারে না। সেখানে নিজের প্রয়োজনেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, বিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন পেশার লোক থাকবে, থাকতেই হবে। আর যদি তাই হয় সমাজে তাদের অবস্থান কি হবে? এসব পেশার লোকজনের অধিকাংশই কিন্তু এক সময়ে সমাজের অবহেলিত, লাঞ্ছিত শ্রেণী থেকে উঠে আসা। তাহলে কি আবার সেই কুলাকের অবস্থা হবে?

হ্যাঁ, এক সময় কৃষকদের একটা করে গরু বা ঘোড়া দেওয়া হয়েছিল। পরিবারে একটা পশু থাকায় কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু যদি ঐ গরু বা ঘোড়া বাচ্চা দেয় তখন দুটো প্রাণী থাকার অপরাধে সেই পরিবারকে কুলাক আখ্যা দিয়ে তাদের সব কেড়ে নেওয়া হত, তাদের করা হত গণশত্রু। এটা অবশ্য বিপ্লবের পর পর, তবে এসব ঘটনা মানুষের মনে রেখাপাত করে। আমার বন্ধু ফিওদর বলেছিল ওদের গ্রামে আগে লোকজন নিজেরাই রুটি তৈরি করত। খ্রুশ্চেভ নিয়ে এলেন রুটির মিল। সেই মিল ছিল কয়েকটা গ্রামের জন্য মাত্র একটা আর রুটি গ্রামে গ্রামে দিয়ে আসা হত গাড়িতে করে। ফলে গরম রুটির পরিবর্তে লোকজনকে প্রায়ই ঠাণ্ডা রুটি খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হত। আসলে এ সবই একটাই কথা বলে – মানুষের ভালমন্দের চেয়ে পার্টির লাইনই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সোভিয়েত আমলে কিন্তু মানুষের ইচ্ছে মত থাকার বা চাকরি করার উপায় ছিল না। পাশ করলে পার্টি বা সরকার ঠিক করত কে কোথায় চাকরি করবে। ঠিক আছে, যদি সবাইকে ইচ্ছে মত যেখানে খুশি কাজ করতে দেওয়া হয় তাহলে সবাই বড় বড় শহরে বা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ এলাকায় যেতে চাইবে। তাহলে কী করা দরকার? হতে পারত সারা জীবনের জন্য না পাঠিয়ে বিশেষজ্ঞদের একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠানো যেত আর বিনিময়ে ভাল বেতন আর বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যেত। মোট কথা জোর করে নয়, অন্য ভাবে তাদের আকৃষ্ট করতে হত। তাহলে হয়তো অসন্তোষ কম হত। এমন প্র্যাক্টিস যে ছিল না তা নয়, উত্তরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অঞ্চলে যারা কাজ করত তাদের বেতন ছিল অনেক বেশি আর তারা কয়েক বছর কাজ করে পরে দক্ষিণ এলাকায় এসে স্থায়ী ভাবে বাস করত। এটা করা হত উত্তরের প্রতিকূল পরিবেশের কথা মাথায় রেখে।

সে সময় এদেশের মানুষের কাছে জিনসের প্রচণ্ড চাহিদা ছিল। সরকার কি পারত না বিদেশ থেকে এসব কিনে দোকানে বিক্রি করতে? তাতে একদিকে মানুষের হাতে থাকা টাকা, যা তারা প্রায়ই খরচ করতে না পেরে তোষকের নীচে জমিয়ে রাখত, বাজারে চালু থাকত, অন্য দিকে কালো বাজারীও দমন করা যেত। আসলে অর্থনীতির মূল কথা তো বাজার – কেনা বেচা। অথচ সেটাই এদেশে বেআইনি ছিল। অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে তো আর তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। আর যদি অর্থনীতিই না বাঁচে সমাজতন্ত্র বাঁচবে কী করে? এক্ষেত্রে আমার মৌলানা আবুল কালাম আজাদের “ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রীডম” বইয়ের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ব্রিটিশ ভারতে যখন দেশীয় সরকার গঠিত হয় নেহরু হন সরকার প্রধান। সর্দার প্যাটেল দাবী করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ যেটা মুসলিম লীগের পক্ষ থেকেও দাবী করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মীমাংসা হয় মুসলিম লীগকে অর্থমন্ত্রীর পদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এখানে আজাদ লিখেছেন যে এমন কি নিজের অফিসে একজন চাপরাশি নিয়োগের জন্যও সর্দার প্যাটেলকে লিয়াকত আলীর দারস্থ হতে হত। এ থেকেই আমরা বুঝি বর্তমান বিশ্বে অর্থনীতির গুরুত্ব। মারণাস্ত্র দিয়ে সব ধ্বংস করা যায়, কিন্তু অর্থনীতির নিয়ম মেনে না চললে সামান্য জিনিসও উৎপাদন করা যায় না।

আমাদের ছাত্র জীবনে মূলত পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আর কম বেশি বড় বড় শহরে বাস করায় এসবের অনেক কিছুই আমরা জানতাম না। আর তাছাড়া এরাও তখন অনেক কিছুই আমাদের বলত না। পরবর্তী কালে যখন চাকরিতে ঢুকি আর এদের সাথে বন্ধুত্ব হয় আর সবচেয়ে বড় কথা যখন কথা বলার স্বাধীনতা আসে, অনেকের মুখেই এসব কাহিনী শুনেছি। এমনকি সেই আশির দশকে মস্কোয় বসেও এমন সব জিনিসের অভাব অনুভব করেছি যে তাদের কথার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ তেমন থাকে না।

তাহলে কি সে দেশে কিছুই ছিল না? ছিল আবার ছিল না। ঐ সময় আমরা অনেকেই যারা সোভিয়েত নাগরিকদের বাসায় গেছি সেখানে অভাবের ছাপ দেখিনি। জিনিসপত্রের প্রাচুর্য ছিল। এমনও হয়েছে দোকানে যখন কোন মহিলা কোন একটা জিনিস কিনছে, তার সন্তান বলছে – এটা তো বাসায় আছেই, আর কী দরকার? আসলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সে দেশের মানুষ তখন কমবেশি নিশ্চিত হলেও ঐ টিস্যু পেপার, ঐ খাতাকলম, ঐ টুথ পেস্ট এসব আগামীকাল পাওয়া যাবে কিনা সে সম্পর্কে তাদের মনে কোন ধরণের নিশ্চয়তা ছিল না। গত বছর যখন করোনার কারণে দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করল, অনেককেই দেখলাম বেশি বেশি সব কিছু কিনছে। আমার স্ত্রীও বলল চাল, ডাল, তেল এসব কিনে রাখতে। এটাও মনে হয় সেই সোভিয়েত আমলের উত্তরাধিকার। আসলে সেই সময়ের সবচেয়ে প্রচলিত শব্দ ছিল ডেফিসিট আর সেটা মনে হয় শুধু জিনিসপত্রের ক্ষেত্রেই নয়, ডেফিসিট ছিল কমিউনিস্ট পার্টি ও সমাজতন্ত্রের প্রতি এদের বিশ্বাসেরও।

আমাদের দেশে দোকানে গেলে কোন কিছু না কিনে ফিরে আসা কঠিন। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিক্রেতারা ছিল নিঃস্পৃহ। যেহেতু তাদের বেতন বিক্রির উপর নির্ভরশীল ছিল না, তাই তারা সে ব্যাপারে সামান্য চেষ্টাও করত না। ভাবখানা এই, ক্রেতার দরকার কেনা, আমাদের কী। একই মনোভাব ছিল উৎপাদনকারীদের। পুঁজিবাদ গেছে ঠিক উল্টো পথে। তারা চয়েজের অভাব দিয়ে নয়, চয়েজের প্রাচুর্য দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করেছে, এখনও করছে। এতে পুঁজিপতি যেমন লাভবান হয়েছে ক্রেতাও সন্তুষ্ট হয়েছে। সোভিয়েত ব্যবস্থা যদি তাদের অর্থনীতিতে বাজারের এই স্বাভাবিক নিয়ম কার্যকর করতে পারত আজ আমাদের সে দেশ সম্পর্কে হয়তো অতীত কালে কথা বলতে হত না।

জানি এ সবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিশাল দেশের বিশাল অর্থনীতির কাছে এসব ঘটনা একেবারেই নগন্য। কিন্তু অনেক মানুষ যখন এ ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয় তখন সেটা আর ব্যক্তি সমস্যা থাকে না, সামাজিক সমস্যা হয়। না, এসব লেখার উদ্দেশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্জনকে ছোট করে দেখানোর জন্য নয়। যদি কখনও কোথাও সত্যকার অর্থেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করা হয়, এসব ঘটনা থেকে তাদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি আর সমাজতান্ত্রিক বণ্টন – এই তিনের সমন্বয়েই শুধু শোষণ মুক্ত সমাজ গড়ার পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো