এ কোন দেশ – তামান্না হোসেন
আমার বড় হয়ে উঠা আক্ষরিক অর্থেই চারদিকে শুধুই আযান আর উচ্চ আওয়াজের মাইকে গান এক সাথেই। ইফতার আর সেহরির সাইরেন, ছিল উৎসব মুখর শবে বরাত ঈদের আনন্দর কথা নাই বা বললাম।একুশের ভোরে ফুল, পহেলা বৈশাখ নিয়ে ছিল না এই রকম আতিশয্যে। কিন্তু ছিল গভীর ভালো বাসা।ছিল শীতে পিকনিক।পাড়ায় পাড়ায়,ক্লাবের, স্কুল,কলেজের সবাই এক সাথে বড় বড় বাস নিয়ে রাজেন্দ্রপুর,চন্দ্রা, সাভার। মেইন রোডে সামিয়ানা খাটিয়ে ওয়াজ হত কিন্তু তেমন না। আমার মা,আশে পাশে খালাম্মারা সবাই শাড়ির ঘোমটা দিতেন। আমার মা বোরকা পরতেন। কিন্তু উনি ধর্মান্ধ ছিলেন না। কাউকে দেখিনি নামাজ কাজ্বা করতে। রোজা না রাখতে হিজাব কি তা জানতাম না।
কিন্তু এরি মাঝেই আমাদের বাসার পাশের বাসাতেই প্রতি সন্ধ্যাতেই ধুপ বাতি হত।একেই সময়ে ধুপ বাতির মাতাল করা পোড়া পোড়া ঘ্র্যানে আমাদের চারদিক সুভাসিত হত আর মাগরিবের আযানের সুমধুর সুরের মূর্ছনায় দিনের শেষকে আলিংগন করা হত। আমাদের ঘনিস্ট প্রতিবেশি ছিল চন্দ্রনাথ কাকারা। উনারা তিন ভাই । একেই বাসাতে থাকতেন। উনাদের সবার ছেলে মেয়েরাই ছিল আমাদের বন্ধু। আমরা এক সাথেই বেড়ে উঠেছি। ছিল ওদের মনি মাসী,শ্যামলা পিসী।ছিল পিসাতো বোন রাজা,প্রজা। আমাদের পুরো এলাকাই ছিল চন্দ্রনাথ কাকার অধিনে।এত পরোপকারী মানুষ খুব কম দেখা
যায়।সবার জন্য উনি ছিলেন গভীর আশ্রয় স্থল। উনাদের আদি বাড়িটি ছিল আমাদের পাড়া থেকে বেশি দুর না।আগে তো আমাদের বাসার পিছনেই ছিল ধু ধু খালি প্রান্তর। বরষার সময় টলটলে পানিতে চারদিক থই থই। কাকাদের পুরো পরিবার বিরাট নৌকা নিয়ে আমাদের বাসার সাথেই নোংগর করতেন আদি বাড়িতে চলাচল করার জন্য।সেই জায়গা দিনে দিনে ভরাট হল।তারপর নৌকা নিতে হত রামপুরা ব্রীজ এর নীচের থেকে। তখনও বনশ্রী পানির নীচে। আমরা সবাই নৌকা বোঝাই করে মেরাদিয়া যেতাম চন্দ্রনাথ কাকাদের বাড়িতে পুজোতে। আমার আব্বা
ছিলেন টাইটেল পাশ মৌলভী, (আব্বা একেই সাথে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা এবং পেশাজীবি) সেই উনিও যেতেন আমাদের সাথে পুজোর শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। কখনো মনে হয়নি দুইটি ভিন্ন ধর্মের, দুইটি ভিন্ন বিশ্বাসের ধারা। কোরবানির ঈদের সময় আমাদের সব চেয়ে বড় মেহমানই ছিল আমার বড় ভাই বোনের সনাতন ধর্মের বন্ধুরা।
একবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সফরে গেলাম আমরা ২৩ জন ছাত্র ছাত্রী। সেই শিক্ষা সফরের অনেক ঐতিহাসিক স্থানের সাথে ছিল মথুরা বৃন্দাবন দর্শন। উত্তর প্রদেশের মথুরা বিভাগের অন্যতম পবিত্র শহর হিন্দু সম্প্রদায়ের। আমরা যারা ছিলাম প্রায় সবাই ছিলাম ভিন্ন ধর্মের।কিন্তু এত পবিত্র যাদের কাছে তাদের তো কোন সীমাবদ্ধতা ছিল না আমাদের জন্য। উপরন্তু তাদের পবিত্র সিঁদুর আমাদের কপালে লাগিয়ে
আমাদের সবাইকে মন্দিরের ভিতরে যেতে সম্ভাসন করা হল।
নিউইয়র্কে একবার দুর্গা পুজোতে মাথায় সিদুঁর লাগিয়ে ঢুকে গেলাম একদম ভিতরে।গিয়ে দেখি এক জন আর এক জন কে কপালে সিঁদুর স্পর্শ করে আবার হাতের শাঁখাতে লাগাচ্ছে। আমিও সেই আনন্দে সামিল হলাম।শাঁখাতে লাগাতে গিয়েই বিপত্তি আমার হাতে তো শাখা নেই। অপর পক্ষের সেই মহিলা যার পর নাই বিরক্ত হলেন নিজে নিজে গজ গজ করছে,”নুতন বিয়ে হয়েছে নাকি”,”আজ কাল কার মেয়ে হাতে শাঁখা পরে না”। পরের দিন মাথায় সেই সিঁদুর নিয়েই গেলাম লিটল বাংলাদেশ খ্যাত জ্যাকসন হাইটস এ। আমরা হাটছি, ঘুরছি। হঠাৎ এক জন বেশ রাগত ভাবেই আমার সামনে এসে বলছে তুমি হুসনার বোন না? আমি বললাম জ্বী।
উনি বললেন,সেই কখন থেকে তোমাকে দেখছি,চিনতেও পেরেছি তবুও খুবেই দ্বিধায়,মাথায় সিঁদুর দিয়ে ঘুরছো। দেশে থাকতেও উৎসব মানেই বান্ধবীরা মিলে শাড়ি পরে মাথায় সিঁদুর লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো।
আমাদের এখন যেখানে বাস আমাদের ভিন্ন ধর্মের প্রচুর আপন জন।এই পরবাসে ঈদের দিন উনারাই আমার মেহমান।
কে কোন ধর্মের সেটা কখনই ছিল না আমাদের ধতব্যর মধ্যে। সব সময়েই ছিল দারুন সম্প্রীতি। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা দিনে দিনে কেমন করে এই রকম হিংস্রতায়পর্যবসিত হয়। পুজামন্ডপে হামলা , আগুন। পুজামন্ডপে কুরআনের নাটক করে পুরো দেশটাকে নারকীয় করে তোলা হল। কেমন করে তা সম্ভব হয়। হিন্দু, মুসলিম, বোদ্ধ, খীস্ট্রান সবাই ধর্মের উর্ধে উঠে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিল আর এত বছর শুরু হল গীতা আর কুরআন নিয়ে হাতাহাতি। কার পাপ কে ভোগ করছে। একে ওকে দোষারোপ। আর প্রশাসন নিরব। প্রশাসনের সামনেই তো ঘটছে। যে প্রশাসন জংগী দমন করে এত শক্ত হাতে সেই প্রশাসন কি পারে না গীতা, মা দুর্গা কে রক্ষা করতে।আদতে আমাদের দেশে গীতা,বাইবেল, কুরআন কেউ আর নিরাপদ নয়।
“নৈতিকতার স্খলন দেখেও
মানবতার পতন দেখেও
নিলজ্জ অলস ভাবে
ও গংগা তুমি বইছো কেন”