চলমান সংবাদ

চট্টগ্রামে পূজামন্ডপে হামলার পরিকল্পনায় ভিপি নূরের সংগঠনের নেতারা

জামায়াত-শিবিরের সাবেক নেতাকর্মীরা হামলায় জড়িত চট্টগ্রামের জেএম সেন হল পূজা মন্ডপে হামলার পরিকল্পনায় যুব অধিকার পরিষদের নেতারা জড়িত। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের নেতৃত্বাধীন সংগঠন যুব অধিকার পরিষদের তিন নেতাসহ দশজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওই নেতাদের ‘পরিকল্পনাতেই’ গত ১৫ অক্ট্বোর বিজয়া দশমীর দিনে পূজা মন্ডপে হামলা হয়েছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। হামলা পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে কয়েকজন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছাত্র শিবিরের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। একজন জামায়াতের ফেইসবুক গ্রুপ বাঁশের কেল্লার অ্যাডমিন প্যানেলেরও সদস্য ছিলেন। গ্রেপ্তাররা হলেন- যুব অধিকার পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক মো. নাছির (২৫), সদস্য সচিব মিজানুর রহমান (৩৭), বায়েজিদ থানা শাখার আহ্বায়ক মো. রাসেল (২৬) এবং ইয়ার মোহাম্মদ (১৮), মো. মিজান (১৮), গিয়াস উদ্দিন, ইয়াসিন আরাফাত (১৯), হাবিবুল্লাহ মিজান (২১), মো. ইমন (২১) ও ইমরান হোসেন। বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রামের সাতকনিয়া ও নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এরমধ্যে ৯জনই যুব ও ছাত্র অধিকার পরিষদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পূজামন্ডপে হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের এসব তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশ জানিয়েছে, কুমিল্লায় দুর্গাপূজার মন্ডপে কোরআন শরিফ পাওয়ার ঘটনা জেনে চট্টগ্রামে সক্রিয় হয়ে ওঠেন সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের সংগঠনের যুব ও ছাত্র অধিকার পরিষদের চার নেতা। নগরীর টেরিবাজার, রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায় প্রভাব রাখেন- বিএনপি ও জামায়াতের এমন কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরিকল্পনা করে গত ১৫ অক্টোবর (শুক্রবার) জুমার নামাজের পর নগরীর জেএম সেন হলে পূজামন্ডপে হামলার ছক তৈরি করেন। সেই ছক অনুযায়ী মিছিল নিয়ে সাধারণ মুসল্লিদের উত্তেজিত করে হামলার ঘটনা ঘটান। নগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় বসাক বলেন, ‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, ভিডিও ফুটেজ, ঘটনাস্থলের ছবি ও গ্রেপ্তার আসামিদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আমরা নুরুল হক নুরের সংগঠনের কয়েকজন নেতার জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি। এর ভিত্তিতে আমরা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারাও ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্যপ্রমাণ আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, তারাই হামলার পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেওয়ার পুরো কাজটি করেছেন। তবে এর সঙ্গে আরো কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারে। আমরা তাদের বিষয়েও তদন্ত করছি।’ কোতোয়ালী থানার ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, হামলার ঘটনায় সব মিলিয়ে মোট ১০০ জনকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মূল পরিকল্পনায় ছিলেন যুব অধিকার পরিষদ নেতা নাছির, মিজানুর ও রাসেল। তাদের পরিকল্পনাতেই জুমার নামাজ শেষে তাৎক্ষণিক মিছিল ও সমাবেশ করা হয়। পরে সেই মিছিল থেকে হামলা চালানো হয়। হামলার ঘটনার পরপরই টেরিবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতার আত্মীয় ইমরান মাজেদ রাহুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তার মধ্যমেই সেদিন টেরিবাজার এলাকার দোকান কর্মচারী, ঘাটফরহাদবেগ, খলিফাপট্টি এলাকার লোকজনকে মিছিলে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। ওসি বলেন, যুব অধিকার পরিষদ নেতা মিজানুর আগে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ফেইসবুক গ্রুপ বাঁশের কেল্লার অ্যাডমিন প্যানেলেরও সদস্য ছিলেন তিনি। পরিকল্পিতভাবে মিছিল করে তারা মন্ডপে হামলার চেষ্টা চালায়। হামলার পরপর অভিযান শুরু হলে তারা বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে যায়। তাদের গতিবিধি নজরে রেখে সাতকারিয়া উপজেলা থেকে নাছিরকে এবং নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। ওসি নেজাম উদ্দীন বলেন, ‘যুব ও ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতারা শুধু বিএনপি-জামায়াত নয়, সরকার বিরোধী বিভিন্ন চক্রকে কাজে লাগায়। পরিকল্পনা করে তারা বিএনপির কিছু নেতাকর্মীকে ব্যবহার করেছে, জামায়াত-শিবিরও তাদের সঙ্গে ছিল। তাদের পরিকল্পনাই ছিল, তারা সাধারণ মুসল্লিদের উত্তেজিত করে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করবে। সে অনুযায়ী তারা শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, নি¤œ আয়ের লোকজনদের নিয়ে মিছিল শুরু করে। তাৎক্ষণিক মিছিল নিয়ে এসে সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করে। তাদের কয়েকজনের মাধ্যমে হামলা চালায়। পুলিশ সেদিন গুলি না ছুঁড়লে জেএম সেন হলের মন্ডপে তারা আরও বড় ধরনের নাশকতা করত।’ প্রসঙ্গত কুমিল্লার একটি মন্দিরে কুরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে ১৩ অক্টোবর কয়েকটি মন্দিরে হামলা ও ভাংচুর চালানো হয়। এর পর দেশের বিভিন্ন জেলায় মন্দিরে ও পূজা মন্ডপে হামলা হয়। তা ঠেকাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও বাঁধে, বিভিন্ন স্থানে প্রাণহানিও ঘটে। কুমিল্লার ঘটনার জেরে ১৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের আগে চট্টগ্রাম নগরীর জেএম সেন হল পূজা মন্ডপে হামলা হয়। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে জুমার নামাজের পর মিছিল নিয়ে এসে জেএম সেন হল পূজা মন্ডপের গেইট ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা চালায় হামলাকারীরা। পুলিশ ফাঁকা গুলি ও টিয়ারশেল ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করে। সেখানে ৮৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও কয়েকশ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ জানায়, কুমিল্লার ঘটনার পর যুব ও ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতারা গোপন স্থানে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে মুসল্লিদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি ও মিছিলের সিদ্ধান্ত নেয়। নাছির ও মিজানুর রহমান মূল পরিকল্পনকারী ও সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব নেন। সিদ্ধান্ত হয়, টেরিবাজার ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের দোকান কর্মচারীদের উসকানি দিয়ে উত্তেজিত করে মিছিলে শরিক করা হবে। চট্টগ্রামে পূজামন্ডপে হামলার আগে ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদের নেতারা সাদেক ও ইমরান মাজেদ এবং বিএনপি-জামায়াতের স্থানীয় পর্যায়ের আরও কয়েকজন নেতাসহ বৈঠক করেন। বৈঠকে নগরীর আন্দরকিল্লা ও রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে দু’টি মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত হয়। টার্গেট নির্ধারণ করা হয় রহমতগঞ্জে জেএম সেন হল পূজামন্ডপ এবং নন্দনকানন ইসকন মন্দির। মিজানুর রহমান, রাসেল, ইমন ও ইমরান মাজেদকে আন্দরকিল্লায় মিছিল সংগঠিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর রিয়াজউদ্দিন বাজারের গোলাম রসুল মার্কেটের সামনে থেকে নন্দনকানন ইসকন মন্দির পর্যন্ত আরেকটি মিছিলের দায়িত্ব দেওয়া হয় সাদেককে। পুলিশ জানিয়েছে, পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ অক্টোবর শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর রিয়াজউদ্দিন বাজারের গোলাম রসুল মার্কেট থেকে মিছিল রাইফেল ক্লাব হয়ে নন্দনকানন ইসকন মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। মিছিলে শতাধিক লোকজন ছিলেন, যাদের অধিকাংশই রিয়াজউদ্দিন বাজারের দোকান কর্মচারী এবং সাধারণ মুসল্লি। জামায়াত নেতা সাদেক মিছিল বের করে দিয়ে সরে পড়েন। মিছিল নন্দনকাননের বোস ব্রাদার্স পর্যন্ত যাওয়ার পর পুলিশ সেটি আটকে দেয়। এসময় মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। তবে পুলিশ অনড় থাকায় তারা মিছিল নিয়ে ইসকন মন্দির পর্যন্ত যেতে না পেরে ফেরত যায়। অন্যদিকে, জুমার নামাজের পর হঠাৎ টেরিবাজারের দিক থেকে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের সামনে দিয়ে মিছিল এগিয়ে যায় আন্দরকিল্লায়। সেই মিছিলেও শ’খানেক লোক ছিলেন। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মিজানুর, রাসেল, ইমন ও ইমরান মাজেদ। তাদের অধিকাংশই টেরিবাজার ও খলিফাপট্টি এলাকার বিভিন্ন দোকানের কর্মচারী।

# ২২.১০.২০২১ চট্টগ্রাম #