কবি শাহিদ আনোয়ার স্মরণে শিল্প সাহিত্য

প্রিয় বন্ধু, কবি শাহিদ আনোয়ার

– মাইনুল হাসান চৌধুরী

১৯৮১’র চাকসু বার্ষিকীতে জন ডানের (John Donne, সপ্তদশ শতকের ইংরেজ মেটাফিজিক্যল কবি) The Flea কবিতাটির শাহিদ আনোয়ার কৃত অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ছন্দ প্রকরণ আর শব্দ চয়নে অনুবাদটি এতোটাই মূলানুগ হয়েছে মনে হতে পারে খোদ ডানই বুঝি এটি বাংলায় রচনা করেছেন। লেখালিখির কম বেশী ৪০ বছরের জীবনে শাহিদ আনোয়ার, বন্ধু শহীদুল ইসলাম চৌধুরী, কবিতা যা রচনা করেছে তার সবটাই প্রকাশ করে যেতে পারেনি। এর মূল কারণটা হচ্ছে সময়ে সময়ে তার শারিরীক অসুস্থতা আর বাকীটুকু হলো তার তীব্র বাম রাজনীতি সম্পৃক্ততা। সমাজ চিন্তক কবি শাহিদ আনোয়ার ছিল আপাদমস্তক এক সাম্যবাদী কবি কিন্তু স্থূল শ্লোগানধর্মী কবিতা সে লেখেনি, লিখেছে কবিতা। কবি ডাব্লিউ বি ইয়েটস সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনাকে যেমনটি চমৎকার কাব্যে রূপান্তর করেন, শাহিদ আনোয়ারও তেমনি। আবার বিষয়বস্তু ও ছন্দ বিন্যাসে শাহিদের কবিতায় বৈচিত্র্যও রয়েছে অনেক।
এ্যাকাডেমিক জীবনে অসম্ভব মেধাবী শাহিদ ছিল আমার বন্ধুদের মধ্যে নিকটতম প্রতিবেশী। এক সঙ্গে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছি, এক সঙ্গেই পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। অবশ্য স্নাতক সন্মান পরীক্ষা’র পর থেকে শাহিদ অতি মাত্রায় বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। আমি সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত না থাকলেও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অনেক সময় শাহিদের সঙ্গে রাজপথে থেকেছি। তবে শাহিদকে সে সময় বাম রাজনীতির এক তীব্র নেশায় পেয়ে বসেছিল যার ফল হলো এম এ পরীক্ষা ড্রপ করা। অনেক বুঝিয়েছি, কিন্তু প্রস্ততির অভাবে সে পরীক্ষা দিলো না। সন্মান পরীক্ষার প্রস্তুতি এক সঙ্গে নিলেও এম এ’র ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। শাহিদ অবশ্য এর পরবর্তী বছরই এম এ পাশ করলো। ভালোই করেছিল, তবে সন্মান শ্রেণীতে থাকাকালীন জন ডানের কঠিন কবিতার অনুবাদক, ব্যতিক্রমি মেধাবী শাহিদ আরো অনেক ভালো ফলাফলের দাবীদার।
কর্ম জীবনে সে সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতা একসঙ্গে চালিয়েছিল কিছু দিন। জাতীয় দৈনিকেও কাজ করেছে। কিন্তু একটি সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্নের ঘোরে থাকা শাহিদ বাস্তবের সুবিধাবাদি রাজনীতির সঙ্গে না পেরেছে খাপ খাওয়াতে, না পেরেছে তাল মেলাতে। ফলে সে শারীরিক মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সাংবাদিকতা ছেড়ে কেবল শিক্ষকতায় থিতু হয়। তবে এতো কিছুর মধ্যেও তার কবিতা লেখা থেমে থাকেনি। বন্ধু কবি ওমর কায়সারের বাস্তব সহযোগিতায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে কাব্যামোদি মহলে সাড়া পড়ে যায়। তার স্ত্রী, কবি সেলিনা শেলীর নিরন্তর অনুপ্রেরায় এবং ওমর কায়সারসহ কিছু বন্ধুর সহযোগিতায় আরো তিনটি কাব্যগ্রন্থ ( একটি যৌথভাবে সেলিনা শেলির সাথে)। আরো অনেক কবিতা তার অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। শাহিদের জীবদ্দশায় শ্যামল দত্ত ‘ভোরের কাগজ’ শাহিদ আনোয়ার সাহিত্য পাতা প্রকাশ করে শাহিদকে জাতীয় পর্যায়ে আরো বড় পরিচিতি দিয়ে এক দরদী বন্ধুর কাজ করেছে।
কবি ওমর কায়সার, অজয় দাশ গুপ্ত, বিশ্বজিত চৌধুরী, শ্যামল দত্ত, জিল্লুর রহমান, শোয়েব নঈম প্রমুখ তাঁদের কয়েকটা রচনায়শাহিদের কবিতা’র চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। শাহিদের কাব্য প্রতিভার মূল্যায়নে তাদের প্রত্যেকের লেখাই অবদান রাখবে। শ্রদ্ধেয় কবি স্বপন দত্ত প্রয়াত খালিদ আহসান ও শাহিদ আনোয়ার স্মরণে কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর কবিতাগুলোও আমাদের বন্ধু প্রয়াত কবিদের বুঝতে সাহায্য করবে।
আমি আশাবাদী, ওমর কায়সার, শ্যামল দত্ত সহ আমরা সবাই চেষ্টা করলে শাহিদের অগ্রন্থিত রচনাগুলো আলোর মুখ দেখবে এবং সেটাই হবে এই অসাধারণ কবি ও সমাজ চিন্তকের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাবার প্রকৃষ্ট উপায়। শাহিদ আনোয়ারের মাগফিরাত কামনা করছি।

মাইনুল হাসান চৌধুরী, অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।