কবি শাহিদ আনোয়ার স্মরণে শিল্প সাহিত্য

সহযোদ্ধা শাহিদঃ আজীবন শোষণ মুক্তির সংগ্রামের অগ্র সৈনিক

– মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

শাহিদ আনোয়ার আমাদের প্রজন্মের ছাত্র আন্দোলনের সবচেয়ে মেধাবী, দৃঢ়চেতা, আপোষহীন ও আমৃত্যু শোষণ মুক্তির সংগ্রামের নিবেদিত প্রাণ যোদ্ধা ছিল। শাহিদ ও আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ব্যাচে লেখাপড়া করেছি। ছাত্র ইউনিয়নও করেছি এক সাথে। তবে শাহিদ সারাজীবন লড়াইয়ের কর্মী ছিল। এত মেধা, শ্রম শক্তি, লেখার অসাধারণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোনদিন পদ-পদবীর ধারে কাছেও যায়নি। সে ছিল অত্যন্ত আবেগ প্রবণ। কোন একটা ঘটনা নিজের মনের মত না হলে দ্রুত নিস্তেজ হয়ে যেত কিন্তু হতাশ হত না। আমরা যখন এরশাদের বিরুদ্ধে সারাদেশে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত,  তখন সামনের সারির কর্মী হিসাবে শাহিদ আমাদের সাথে থাকত। শাহিদ  যেকোন ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতো কবিতার মাধ্যমে। সে ছিল একজন মেধাবী ও জাত কবি, লেখার জন্য বিন্দুমাত্র সময়ের প্রয়োজন হতনা। ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের ছাত্র হলেও বাংলা ভাষার উপর তার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। আমরা যেকোন নিউজ লেখে শাহিদকে খুঁজতাম দেখানোর জন্য। শাহিদ সেই নিউজে কত কাটা ছেঁড়া করতো নিউজের একটা পরিপূর্ণ এবং অর্থবহ রূপ দেয়ার জন্য। আমি অবাক হয়ে দেখে থাকতাম। তাকে কোন সময় রাগ করতে দেখিনি। সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শের প্রতি শাহিদ ছিল অবিচল এবং নিবেদিত প্রাণ।

৮১-৮২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমরা একটা কোচিং সেন্টার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। শাহিদ ছিল ইংরেজির শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজেকে উজাড় করে দিত। সকলে তার ক্লাস করার জন্য উদগ্রীব থাকত-কখন শাহিদ আসবে। যেহেতু আমরা বাণিজ্যিকভাবে কোচিং করানোর চিন্তা করিনি তাই বেশিদূর আগাতে পারিনি। তবে সেই কোচিং সেন্টারের এক ঝাঁক শিক্ষার্থী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিল। একথা বলার অবকাশ রাখেনা এদের বেশির ভাগ ছিল শাহিদের দ্বারা প্রভাবিত।

শাহিদের সাথে সাথে তার পরিবারের সদস্যরাও ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিল। চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের একটি সভায় ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা হামলা চালালে আমরা অনেকে আহত হয়েছিলাম তন্মধ্যে শাহিদের ছোট ভাই মাইনুদ্দিন মহসিন কলেজের সামনে নালায় পড়ে গিয়েছিল। শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা তার উপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। আমরা যখন তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যাই তখন এত রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল আসলে সে বাঁচবে কিনা তানিয়ে চিকিৎসক সহ আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ি। কিন্তু শাহিদ ছিল নির্বিকার। কোন প্রকার বাহ্যিক বা অতিরিক্ত উদ্বেগ তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি।

শাহিদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর বেশ কিছুদিন কোন কাজের সাথে যুক্ত হয়নি। আমি অনেকটা জোর করে লতিফা সিদ্দিকী কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগ দিতে বাধ্য করি। এরপর পুর্বকোন পত্রিকা বের হলে সেখানে অনুবাদক হিসাবে সাংবাদিকতা শুরু করে। পরবর্তীতে ইসলামিয়া কলেজে শিক্ষকতা ও দৈনিক পূর্বকোনে সাংবাদিকতার কাজ একই সাথে চালিয়ে গেছে।

শাহিদ স্থিতি হয়েছে অনেক পরে আরেক সংগ্রামী নেত্রী কবি ও শিক্ষক সেলিনা শিলিকে জীবন সঙ্গী হিসাবে পেয়ে। শেলির সাহচার্য ছাড়া সে এতদিন বেঁচে থাকতো কিনা বলা কঠিন। শেষ দু’বছর অতিমারি পরিস্থিতিতে শাহিদ অনেক কষ্ট করেছে।

শাহিদ আনোয়ার একজন সত্যিকার অর্থে অনেক বড় মাপের মেধাবী মানুষ ছিল। চাইলে সে দেশের অনেক বড় কর্তা   হতে পারতো কিন্তু সেদিকে তার কোন আকর্ষন ছিলনা। লেখালেখি করেই জীবনটা দেশের মানুষের জন্য নিবেদন করে গেছেন।

নব্বই এর দশকে পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের পরে অনেকে শোষণ মুক্তির চিন্তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও শাহিদের দৃঢ় অবস্থান ছিল মানব মুক্তির দর্শন হিসাবে সমাজতন্ত্রের পক্ষে। শাহিদ আমৃত্যু মেহনতি মানুষের শোষন মুক্তির জন্য অবদান রেখে গেছে। শাহিদের মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরন হবার নয়। আমৃত্যু মানুষের শোষণ মুক্তির সংগ্রামের অগ্র সৈনিক শাহিদ আনোয়ারকে জানাই সংগ্রামী লাল সালাম।