কবি শাহিদ আনোয়ার স্মরণে শিল্প সাহিত্য

আমাদের শাহিদ ভাই

– জিললুর রহমান

কবি শাহিদ আনোয়ার সম্ভবত আমার চেয়ে ৬/৭ বছরের বড় হবেন। তাঁকে প্রথম দেখি ১৯৮৮ সালে অচিরা পাঠচক্রে কবিদের আড্ডায়। কথা বেশি বলতেন না। চোখ দুটো ছিল কেমন স্বপ্নে ভরা উজ্জ্বলতায় দীপ্ত কিন্তু উদাসীন। সম্ভবত কবি হোসাইন কবির প্রথম আলাপ করিয়ে দেবার সময় বলেছিলেন, ‘কুঁকরে আছি মনোটোনাস গর্ভে’র কবি হিসেবে। তাঁকে ক্ষণে ক্ষণে উদাস হয়ে যেতে দেখেছি অনেকবার। তবে চা ও সিগারেটের ছিলেন দারুণ অনুরক্ত। অচিরা পাঠচক্রে তো কেবল সপ্তাহান্তে যেতাম, কিন্তু প্রাত্যহিক সান্ধ্য আড্ডা জমে উঠেছিল কথাকলি শীর্ষক পুস্তকালয় ঘিরে। শাহিদ ভাইও নিয়মিত আসতেন। সবার কথা শুনতেন নীরবে ধূম্রশলাকায় টান দিতে দিতে — মুচকি হাসি ধরে রাখতেন ঠোঁটে। শাহিদ ভাই অসম্ভব রাজনীতি সচেতন ছিলেন এবং রাজনৈতিক কর্মীও ছিলেন; বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে। তাঁকে পেয়েছি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সকল মিছিলে ও সভায়। জড়িত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। শাহিদ ভাই বিয়ে করেন আমাদের বন্ধু কবি সেলিনা শেলীকে। সেলিনা শেলীও রাজনীতি এবং কবিতায় শাহিদ ভাইয়ের সহযাত্রী। শাহিদ ভাই ছোট ছোট কবিতা লিখে নম্রস্বরে উচ্চারণ করে শোনাতেন। এক সময় তাঁর বন্ধুদের সাথে বের করেছিলেন ‘দ্রৌপদীর প্রেমিকেরা’ এবং পরে শুক্লা সেনগুপ্তা যুক্ত হবার পরে ‘দ্রৌপদীর প্রেমিকেরা ও অন্য একজন’ শিরোনামে। সবুজের আড্ডায়ও মাঝে মাঝে উপস্থিত হতেন শাহিদ ভাই। একান্তে পেলে আমার ২/১টা কবিতা তাঁকে শোনাতাম। ছন্দে ছিল দারুণ দখল। আমার ছোটখাট ত্রুটিগুলো পরম স্নেহে বুঝিয়ে দিতেন। একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী হয়েও কবিতায় তিনি ছিলেন নম্রস্বরের শব্দের কারিগর।

১৯৯০ সাল, একটি ভয়ঙ্কর সময়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আদর্শরূপে বিবেচিত সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষরণ ঘটে গেল —— গ্লাসনস্ত ও পেরস্ত্রইকার ডামাডোলে ৭০ বছর বয়সী মহীরূহের পতন নিশ্চিত হলো। এমন স্বপ্ন ভঙ্গের দিনে শাহিদ আনোয়ার চারিদিকে পূঁজিবাদের চর গেখতে পান, মার্কিন চরের অজানা আশঙ্কায় কম্পিত হন।ইতোমধ্যে শাহিদ ভাই কি একটা উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। কিন্তু সেখানেও তাঁর মনে হতে থাকে তিনি মার্কিন চরের নজরবন্দী হয়ে আছেন, তাঁকে তারা হত্যা করতে পারে। ফিরে আসার পর থেকে তাঁর মনোবৈকল্যের লক্ষণ আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। তাঁর ধারণা হতে লাগল, মার্কিনীরা তাঁকে মেরে ফেলবে। অনেককেই তাঁর মার্কিন চর হিসেবে সন্দেহ হতে লাগল। একসময় তিনি সম্পূর্ণরূপে পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন সিজোফ্রেনিয়ায়। চিকিৎসায় মাঝে মাঝে সুস্থ হয়ে ওঠেন, কিন্তু কিছুদিন পরে আবার জেঁকে বসে অসুখ। যখন সুস্থ থাকেন তখন তিনি অসামান্য কবিতাগুলো লিখেন। আর অসুস্থতার ভয়াবহতার কথা আমি জানতে পেতাম সেলিনা শেলীর কাছ থেকে। তাঁর এই দীর্ঘজীবন অসুস্থ কবির সাথে কাটানোর সংগ্রাম সবিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। তার মধ্যেও তিনি লিখেছেন ‘আমারে আল্লার রঙে রঞ্জিত করো’ কিংবা ‘শুড়িখানার নুড়ির মধ্যে’ কবিতাগুলোর অসাধারণ সব পংক্তি। শেষ দিকে তিনি বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলেন। আবার দেখা ও আলাপ হতে লাগল বিভিন্ন কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে।

শাহিদ আনোয়ার চিকিৎসাধীন ছিলেন আমার প্রিয় শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক স্যারের কাছে। জীবনের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে তাঁর চেম্বারে শাহিদ ভাইয়ের আগমন হতো কখনও স্বেচ্ছায়, আবার কখনো ঘোর আপত্তির মুখে। শাহিদ আনোয়ারের মত মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই থাকে। উনি এই সমাজ বদলাতে চেয়েছিলেন। প্রত্যুত্তরে দেখেছেন, মানুষ ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে পঙ্কিলতায়। উনি মেনে নিতে পারেননি সমাজের এই অবক্ষয়। তাঁকে সারাটা জীবন কাটাতে হয়েছে অন্যের অনুকম্পায় গলগ্রহ হয়ে। অথচ তিনি ছিলেন কুমিল্লা বোর্ডে স্ট্যান্ড করা মেধাবী ছাত্র। কেবল কবিতা লেখার জন্যে তিনি বাংলায় পড়তে গিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠালাভের অনেক লোককে ত্যাগ করে একটি সাধারণ জীবন বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই সামাজিক অবক্ষয়ের সাথে আমাদের মতো তাল মিলাতে না পারাকে আমরা অসুখ বলে ডাকি। শাহিদ ভাইয়ের জীবনোপলব্ধি বিশ্লেষণ করার মতো যোগ্যতা হয়তো আমার নেই। শাহিদরা খুব বেশি নেই আমাদের মাঝে। এ আমার অনুভব। যারা কবি শাহিদ আনোয়ারকে চেনেন, তারা জানেন একটি দীর্ঘ কালখণ্ড তিনি অসুস্থতার ভেতর দিয়ে যাপন করেছেন, তার ভেতরেও নিজেকে নিরন্তর সৃজনশীল রাখা এবং কবিতায় এমন ধ্রুপদীঢঙ্গে নিমগ্ন থাকা ভয়ংকর রকমের কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এই যে প্রতিনিয়ত অস্তিত্ব এবং সুস্থতার সংগ্রামে লিপ্ত থাকার প্রভাবও তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পেয়েছি।

এ নিছক বেঁচে থাকা, সময়ের সাথে সংগম
অবিরাম দোল খায় শংখচূড় ইচ্ছের ফণা
আয়ুর স্ফটিক খেকো ঈশ্বরীও হলো বেরহম
কপালে লেপ্টে থাক পয়াংমুখ মৃত্যুর কণা” (হতাশা ও আশা /  অগ্রন্থিত / শ্রেষ্ঠ কবিতা /২০১৯)

বছর তিনেক আগে একদিন সপরিবারে গিয়েছিলাম কবির বাসায়। অনেক কথা বলেছি। কিন্তু শাহিদ ভাই বলেছেন খুবই কম। তারপর, গতবছরের শুরুর দিকে এক রাতে শাহিদ ভাইয়ের স্ট্রোক হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। ফোন পেয়ে সাথে সাথেই ছুটে গিয়েছিলাম। কর্তব্যরত ডাক্তাররা তো আমার ছাত্র। তাদের বিশেষ নজর রাখতে বললাম। তৎকালীন অধ্যক্ষ শামীম হাসান ফটোগ্রাফার হলেও তিনিও একজন কবি। তাঁর প্রভাবে ভাল সীটের ব্যবস্থাও করা গেল। কিন্তু দীর্ঘকাল শয্যাগ্রহণের এই রোগ তাঁকে আর দাঁড়াতে দিল না। অনেক দিন তাঁকে রাখা হলে বন্দর হাসপাতালের কেবিনে। এর মধ্যে কোভিড এবং আমার কর্মস্থল পরিবর্তনের কারণে আর তাঁকে দেখার সুযোগ হলো না।

 

০১ অক্টোবর ২০২১; রাত ৯:৩১ চট্টগ্রাম