মতামত

ফরহাদ ভাইয়ের বিদায় বেলায়

অশোক সাহা (ফাইল ছবি)

১৯৮৭ ইংরেজীর ৯ অক্টোবর আমাদের পার্টির সাধারন সম্পাদক জাতীয় নেতা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে মৃত্যুবরন করেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে । সে সময় আমি পার্টির লেনিন স্কুলে পড়ালিখা জানাবুঝার নিমিত্তে মস্কোতে ছিলাম । এর আগেই ফরহাদ ভাই বাংলাদেশে একবার হৃদরোগে আক্রান্ত হবার পর দেশে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য মস্কো যান । মস্কোতে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবার দুইদিন আগে ফরহাদ ভাই আমাদের আমন্ত্রনে লেনিন স্কুলে আসেন । সেদিন ছিল বুধবার । সেই সন্ধ্যায় আয়োজিত অন্যান্য দেশের কমরেডদের সমাবেশে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উপর বক্তব্য রাখেন । নানা প্রশ্নের উত্তর দেন । রাতে আমাদের সাথে আহার করেন । পরে কিছুক্ষন আমাদের সাথে সময় কাটিয়ে হোটেল অক্টোবরে চলে যান । ফরহাদ ভাইয়ের সাথে সেই আমাদের সাথে শেষ দেখা । দুইদিন পর শুক্রবার বিকেলে আমি, খোন্দকার মো ফারুক, বগুড়ার মোস্তাফিজুর রহমান ফিজু ভাই, সিরাজগঞ্জের হাবিবুর রহমান তারা ভাই একসাথে টেলিভিশন দেখছিলাম । আমাদের দলনেতা খোরশেদুল ইসলাম ভাই কোন এক মাধ্যমে খবর পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফরহাদ ভাইয়ের হঠাৎ মৃত্যু সংবাদ জানান । লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরের সাথে একটা বৈঠক করে হোটেলে এসে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন । এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন । ভাল মানুষটা মাত্র দুইদিন আগে হাসিখুশী আমাদের সাথে দেখা করলেন । গল্প করলেন । সবার খোজ খবর খুটে খুটে নিলেন । বললেন, ‘ পরিবারের কাছে চিঠিপত্র দেবার হলে আমার কাছে দিবেন । আমি পৌছে দেবো ‘ । এর কয়েকদিন পর মস্কো থেকে ওনার কিউবা যাবার প্রোগ্রাম ছিল । আর হলো না । পরে ফরহাদ ভাইকে রাখা হিমাগারে যাই আমরা সবাই । মস্কোতে অধ্যয়নরত অনেক শিক্ষার্থীও আসেন ফরহাদ ভাইকে দেখতে এবং শেষ সম্মান জানাতে । শিক্ষার্থীদের কান্নার রোল এখনো আমার চোখে ভাসে ।

আমাদের নেতা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ শুধু পার্টি নেতা নন, একজন সম্মানিত বিশ্বাস ভাজন জাতীয় নেতার সম্মান নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন । বড়ই অকালে অসময়ে । এ অসময় মৃত্যুতে কমিউনিস্ট পার্টি নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । জনারন্যে তিনি তাঁর প্রিয় পার্টিকে মর্যাদাপূর্ন সম্মানিত আসনে রেখে গিয়েছিলেন ।
আজো দেশের যে কোন সংকট নিরসনের সংগ্রাম আন্দোলন কালে অনেকেই আমাদের নেতা ফরহাদ ভাইকে গভীর আস্থা এবং শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করেন । যে কোন সংকীর্নতা পরিহার করে তিনি সমাধানের দিশা বের করতে পারতেন । সময়ে তিনি জাতীয় সংকটে বা নিজের পার্টি পরিচালনার প্রশ্নেও নির্ভর কেন্দ্রের ভূমিকা রাখতেন । জীবনের শেষ অব্দি লাখো শহীদের বাংলাদেশটাকে প্রগতির ধারায় অগ্রসর করে নেয়ার জন্য কমরেড ফরহাদ সর্বাত্মক সচেষ্ট ছিলেন । যে কোন ধরনের হঠকারীতা সংকীর্নতার বিরুদ্ধে সাহসী লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশে । বিশেষত আশির দশকে ভাত কাপড় জমি কাজের রনধ্বনির বিশাল বিস্তৃত লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে জাতীয় সম্মানের জায়গায় রেখে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের বাম প্রগতির আন্দোলনের ফ্রন্ট লাইন লিডার কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ । আকন্ঠ বিপ্লব পিপাসা নিয়ে তিনি সৃজনশীল কারিগরের মত গড়ে তুলেছিলেন তেভাগা আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহ, নানকার টংক আন্দোলন এবং একাত্তরের হাজারো মুক্তিযোদ্ধার কমিউনিস্ট পার্টিকে ।
লেখক, সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি