মতামত

কমরেড ফরহাদ ও মস্কোর সোনালি শরৎ

– বিজন সাহা  

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

ছাত্রজীবনে ক্লাস শেষে রিডিং রুমে হোম টাস্ক করে প্রায়ই আমি বেড়াতে যেতাম বন্ধুদের ওখানে। সাধারণত প্লেখানভে, কখনও কখনও ফার্স্ট মেডিক্যাল, মেই বা মামি। এ ছাড়া প্যাট্রিস লুমুম্বার বিভিন্ন ব্লক তো আছেই। চার বছর মস্কো থাকার পর ১৯৮৭ সালের সামারে দেশে গেলাম বেড়াতে। সেখানে দুই মাস ছিল ব্যস্ত সময় – পার্টির বিভিন্ন সভা সমিতিতে যোগ দিয়ে সময় কেটেছে,  বাড়িতে প্রায় থাকাই হয় নাই।

সেদিন ছিল শুক্র বার। ক্লাস শেষে চলে গেছি মামির হোস্টেলে ইকবালের ওখানে। ইকবাল আমার ইয়ার মেট। একই বিমানে পাশাপাশি বসে ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমরা মস্কো আসি। আমি প্যাট্রিস লুমুম্বায়, ও চলে যায় রোস্তভ না দানু ভাষা কোর্স করতে। পরের বছর মস্কো ফিরে আসে। ওই সময় আমাদের মাসে একবার স্টাইপেণ্ড দেওয়া হত ৭ তারিখের দিকে। ওদের দিত দুই কিস্তিতে যার এক কিস্তি পেত ২৫ তারিখের দিকে। কোন দিনই হিসেব করে চলতে পারিনি, তাই টাকা পেলেই শেষ হয়ে যেত, পড়তাম ঝামেলায়। ইকবালই বলল আমি যেন স্টাইপেণ্ড পেয়ে ওকে ২৫ রুবল দিই, ও ২৫ তারিখে আমাকে ফেরত দেবে। তাতে দুজনেরই সুবিধা হত। এই চুক্তি আমাদের ছাত্র জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল। ওই দিন আমি গেছিলাম সেই ২৫ রুবল দিতে। ওদের ওখানে কেউই ছিল না, তাই ঠিক করলাম যাব প্লেখানভে রুমা আর সুস্মির ওখানে আড্ডা দিতে (পড়ুন রাতের খাবার খেতে)। রেডি হয়ে বেরিয়েছি। নীচে এসে শুনি ইকবালের নামে একটা চিরকুট আছে, সেটা ওর দরজায় রেখে এসেছে। ফিরে গিয়ে খুলে দেখি তাতে লেখা «কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মারা গেছেন»। একদম বিশ্বাস হচ্ছিল না, ভাবলাম কেউ ঠাট্টা করেছে। বিশেষ করে সে সময় ছাত্র সংগঠনে বেশ রেষারেষি চলছিল।

সে সময় সিপিবির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোঃ ফরহাদ মস্কোয় ছিলেন চিকিৎসার জন্যে। আমার ঠিক মনে নেই ফরহাদ ভাইয়ের সাথে আমরা একই ফ্লাইটে মস্কো এসেছিলাম কিনা, তবে আসার পরে সেন্ট্রাল ক্লিনিকে তাঁকে দেখতে গিয়েছি বেশ কয়েক বার। অনেক সময় উনি (শুধু উনিই নন, অনেকেই, যারা সেখানে চিকিৎসার জন্য আসতেন) আমাদের কিফির, ইয়োগারট ইত্যাদি বিভিন্ন খাবার দিতেন। তখন অনেক কথা হত দেশের রাজনীতি নিয়ে। মাত্র দু তিন দিন আগেও দেখা হয়েছিল। তবে হোটেল অক্টোবরে। ওখানে যেতাম সময় পেলেই। অনাদের সাথে দেখা করা ছাড়াও পছন্দ করতাম সেখানকার কফি আর চকলেট। অনেক সময় কিনে নিয়ে আসতাম। সদা হাস্যময় এই মানুষ আর নেই, এটা কি বিশ্বাস করা যায়?

যেদিনের কথা বলছি, সেটা ৯ অক্টোবর ১৯৮৭। তখন তিনি অক্টোবর হোটেলে ছিলেন। সিপিবির উচ্চ পর্যায়ের ডেলিগেট এলে এখানেই থাকতেন। অনেক গিয়েছি সেখানে। টেলিফোন জানা ছিল। নীচে গিয়ে ফোন করলাম। রিসেপশনে কিছুই বলল না, ওখানে সাধারণত যে আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলে সেটাও পেলাম না। কী করা? চল, প্লেখানভ না গিয়ে ১০ নম্বরে, মানে প্যাট্রিসের ১০ নম্বরে যাই। ওখানে গেলে সব জানা যাবে। মেট্রো বাসে করে ওখানে যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টার বেশি। মনে হয় এই প্রথম কোন রকম কথা না বলে এতটা পথ এলাম। মনে শুধু একটাই আশা – ওখানে সবাইকে পাব বরাবরের মত আড্ডায়। এই দুঃস্বপ্নের বিকেল শেষ হবে রোদের ঝিলিক দেখে।

আমাদের বাড়িতে সক্রিয় রাজনীতি কেউ করত না, তবে ভোটে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করা আর ভোট দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। পরবর্তীতে বিএনপি, জাতীয় দল এসব নিয়ে আলোচনা হলেও আমরা নিজেরা বাম রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়ার আগে পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কর্মীদের নিয়ে তেমন আলোচনা বাড়িতে হত না। সত্যেন সেনের অনেক বই ছিল, পত্রিকায় বাম ঘরানার অনেকের লেখাও পড়া হত, তবে তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব তেমন দেওয়া হত বলে মনে হয় না। মনি সিংহের নাম কখনও কখনও আসত বড়দের আলোচনায়। তবে দেশদ্রোহী মামলায় কমরেড ফরহাদ গ্রেফতার হলে তিনিও বাড়ির রাজনৈতিক আড্ডায় জায়গা করে নেন।

১৯৮১ সালে কলেজে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিই। ধীরে ধীরে পার্টির সাথেও সংযুক্ত হই। বুয়েটে কিছুদিন ক্লাস করি। কোন কাজে ঢাকায় গেলে আজাহার ভাই পার্টির কোন কাজকর্ম যেমন চিঠি পত্র আদানপ্রদানের দায়িত্ব দিতেন। তাই স্বল্পকালীন ঢাকায় বসবাসের সময় প্রায় বিকেলেই হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম পুরানা পল্টনে পার্টি অফিসে। সেখানে নুরুল ইসলাম ভাই, লেনিন ভাই, সুনীল দা এরা পরিচিত ছিলেন। লেনিন ভাইয়ের বাসায় বেশ কয়েক বার গেছি। লেনিন ভাই, সুনীল দা আমাদের গ্রামের বাড়ি তরায় এসেছেন অনেক বার।

সবচেয়ে বড় কথা তখন পার্টি অফিসে এক আন্তরিক পরিবেশ ছিল, তাই গিয়ে ভালো লাগত। তখনই একদিন কী এক উপলক্ষ্যে একটা সভা হয়, সেখানে মনি দা, ফরহাদ ভাই – এঁদের বক্তব্য রাখার কথা ছিল। বরাবরের মত ঠিক সময়ে গিয়ে হাজির হলাম। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সিঁড়ির ঠিক নীচটায়। মনি দা নামছেন মঞ্চে যাবেন বলে। «ধর ধর» শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দেখি মনি দা সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পেছন দিকে পড়ে যাচ্ছেন। মন্ত্রমুগ্ধের মত হাত বাড়িয়ে দিলাম। উনি আমাকে আঁকড়ে ধরলেন। আমার ওজন তখন ৪৩ কেজি। মনি দাকে  ধরব কী নিজেই পড়ে যাই যাই অবস্থা। কালী দা দৌড়ে এসে পেছন থেকে ধরলেন। মনি দাকে নিয়ে গেলেন মঞ্চে। মনি দা, ফরহাদ ভাইসহ অনেকেই বক্তব্য রাখলেন, কিন্তু আমি এতটাই উত্তেজিত হয়েছিলাম যে তাদের কথা শুনতেই পেলাম না। তাই সামনাসামনি ফরহাদ ভাইয়ের বক্তৃতা শোনার জন্য আমাকে আরও অনেকদিন অপেক্ষা করতে হল।

মস্কোয় থাকার ফলে সিপিবি, ন্যাপ, আওয়ামী লীগ সহ অনেক পার্টির নেতাদের সাথে রেগুলার দেখা হত। মস্কোয় তখন পার্টির নেতারা প্রায়ই আসতেন। মানিক ভাই, লেনিন ভাই, নুরুল ইসলাম ভাই, সালাম ভাই, সেলিম ভাই, মঞ্জু ভাই – কে না এসেছেন। তবে এরা এলে হোস্টেলে যেমন আড্ডার আয়োজন থাকত ফরহাদ ভাইয়ের সাথে তেমন হত না, বা আমি জানতাম না। কিন্তু সময় করে হোটেলে বা হাসপাতালে দেখা করতাম। ফরহাদ ভাই প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির কাছাকাছি কোন এক সময়ে (না কি পয়লা বৈশাখ?) তিন নম্বর ব্লকের হলে আমাদের অনুষ্ঠানে আসেন। সেখানে বক্তব্য রাখলেন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। এর আগে ও পরে অনেকের বক্তব্যই শুনেছি। কিন্তু এমন যুক্তিপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য আর কাউকে দিতে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। ফরহাদ ভাইয়ের মস্কো সফর ছিল স্বল্পকালীন আর ব্যস্ত। তাই আমাদের খুব বেশি সময় দিতে পারতেন না। তবে ১৯৮৭ সালে চিকিৎসার জন্য সেন্ট্রাল ক্লিনিকে থাকাকালীন তাঁর কথা শোনার সুযোগ হয়েছে।  অগ্নিযুগের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সম্পর্কে পড়েছি তাদের ত্যাগের কথা। ধর্মে বিশ্বাসী না হলেও তাদের চেহারার সাধু সন্তের ছাপ ছিল। ফরহাদ ভাই ছিলেন সেই প্রজন্মের শেষ বিপ্লবী।

চিরনিদ্রায় কমরেড ফরহাদ ছবিঃ বিজন সাহা

১০ নম্বরে এসে চলে গেলাম ১৪ তলায়। ৫ তলার ইঞ্জিনিয়াররা পড়াশুনা শেষ করে পিএইচডি করছে। তাদের সাথে সাথে আমাদের আড্ডাও উপরে উঠে এসেছে। ঘর ভর্তি লোকজন। সবার চোখেমুখে বিষাদের ছায়া। ধীরে ধীরে খবর আসতে শুরু করল। তবে খবর একটাই – ফরহাদ ভাই আর নেই। এর আগে উনি মস্কো থেকে যখন দেশে ফেরেন বিমানে বসে তাঁর মাথায় এসেছিল ১৫০-১৫০ সীটের তত্ত্ব। পরে উনি নিজেই একথা বলেছিলেন কোন এক আলোচনায়। আমরা ছিলাম এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে পড়াশুনা করত পৃথিবীর পিছিয়ে পড়া দেশের ছেলেমেয়েরা যাদের অনেকেই হয় বিপ্লবী পার্টির সাথে যুক্ত ছিল, অথবা ফিরে গিয়ে দেশের সেবা করার স্বপ্ন দেখত। আর ফরহাদ ভাইয়ের মত নেতারা এদের স্বপ্ন দেখাতেন নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে। সে সময় সারা দেশে বাম আন্দোলনের জোয়ার। কৃষক, শ্রমিক, খেতমজুর সমস্ত জায়গায় লাল ঝান্ডা উড়ছে। মাত্র কিছু দিন আগে দেশ থেকে ফিরেছি। প্রত্যক্ষ দেখে এসেছি এসব। যদিও এই জোয়ার, এই উত্থান ছিল সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল তবুও ফরহাদ ভাইয়ের ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত। তাই ফরহাদ ভাইয়ের মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার খবর শুনে যেমন স্তম্ভিত হয়েছিলাম, ১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর আবারও তেমনি স্তম্ভিত হলাম। যে প্রদীপগুলো সোনার বাংলা গড়ার পথ দেখাত তাদের আরও একটা আজ নিভে গেল।

এরপর বিদায়ের পালা। সবাই মিলে গেলাম সেন্ট্রাল ক্লিনিকের পাশে একটা হলে। হলের মাঝে অন্তিম শয্যায় শুয়ে আছেন ফরহাদ ভাই। মুখে বরাবরের মত সেই হাসিটা লেগে আছে। বাজছে ট্রাউরের মিউজিক। শপেন খুব সম্ভবত। ছবি তোলার অভ্যেস। কত নেতাদের যে ছবি তুলেছি মস্কোয়! ফরহাদ ভাইয়ের ছবি কেন যেন তোলা হয়নি। আজ হল। অন্তিম শয্যায় শায়িত কমরেড মোঃ ফরহাদের ছবি। এরপর সব ইতিহাস। নতুন কংগ্রেস, নতুন কমিটি, প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পরে পার্টির ভাঙ্গন যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস পৃথিবীতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। আজ দেশে দেশে ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে যে পাহাড় সম ব্যবধান সেটা কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুর্বলতার কারণেই। তবে সময়ের সাথে এদের বদলাতে হবে, মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ ডগমা হিসেবে নিলে এরাও মৌলবাদী দলেই পরিণত হব, শুধু ভিন্ন দিক থেকে। দেশের ঐতিহাসিক পটভূমি মাথায় রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক গড়া, চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হতে মাঝে মধ্যে কৌশল পরিবর্তন – সেটাই রাজনীতি। এক্ষেত্রে কমরেড ফরহাদ ছিলেন তুলনাহীন। গোঁড়ামি নয়, লক্ষ্যে পৌঁছুনর জন্যে পরিস্থিকে ব্যবহার করাই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। সেটা ছিল বলেই তিনি ১৫০-১৫০ ফর্মুলা দিতে পেরেছিলেন। আমার বিশ্বাস আশির দশকের সে দিনগুলোয় বাম আন্দোলনের জোয়ারের আরেকটা কারণ ছিল পার্লামেন্টকে ব্যবহার করা।  বাংলাদেশের বাম আন্দোলনকে চাঙ্গা করার জন্য তাই ফরহাদ ভাইয়ের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া খুবই জরুরি, বিশেষ করে আশির দশকে তিনি যে সব যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেটার সঠিক ব্যাখ্যা পার্টির বর্তমান নেতৃত্বকে অনেক ক্ষেত্রে ফ্লেক্সিবল হতে সাহায্য করবে বলে আমার বিশ্বাস।

মস্কোয় ২০১০ সালের পর আমরা বেশ কয়েক বার এ দিনটা পালন করেছি , কিন্তু বিভিন্ন কারণে এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমার বিশ্বাস আমার মত অনেকেই যারা সেদিন এখানে ছিলেন, আজ সেদিনের স্মৃতিচারণ করছেন, কমরেড মোঃ ফরহাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেণ্ডশীপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া