চলমান সংবাদ

কাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম: গ্রেপ্তারকৃত ইসলামী বক্তা দুই দিনের রিমাণ্ডে, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও প্রতারণার অভিযোগে দুটি মামলা

হাত কড়া পরানো ছবি

ইসলামী বক্তা কাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।

এর আগে সকালে পুলিশ বাদি হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেছে মি. ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে। একই থানায় জেড এম রানা নামের একজন ব্যক্তি প্রতারণা ও সম্পদ হারিয়ে নেয়ার অভিযোগে আরেকটি মামলাও করেন তার বিরুদ্ধে। পরে এ দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মি. ইব্রাহিমকে আদালতে হাজির করে দশ দিনের রিমাণ্ড চায় পুলিশ।

সোমবার মধ্যরাতে মি. ইব্রাহিমকে তার মোহাম্মদপুর কলেজ রোডের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ। সেসময় পুলিশ বলেছিল তাকে অনলাইনে ‘ঘৃণাসূচক, অসত্য ও ভিত্তিহীন’ বক্তব্য দেবার অভিযোগে আটক করা হয়েছে।

মি. ইব্রাহিমের তরফ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, তাকে ‘হয়রানি এবং হেয়’ করা হচ্ছে।

তার আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই মামলা করার মতো উপাদান আসলে নেই। মামলায় যে কথাগুলো বলা হয়েছে, তার সঙ্গেও ওনার কোন সম্পর্ক নেই।”

মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে

ডিএমপির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বিবিসি বালাকে বলছেন, গোয়েন্দা পুলিশের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে অসত্য, ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট তথ্য প্রচার এবং উগ্র বক্তব্য দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করছিলেন।

মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি করোনাভাইরাস নিয়ে নানারকম ‘অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেয়া’, ‘টিকা নিয়ে নারীর দাড়ি গজাচ্ছে’, ‘পুরুষ কণ্ঠ পাল্টে যাচ্ছে’, ‘স্বপ্নে দেখেছেন অন্য একটি দল ক্ষমতায় চলে এসেছে’ ইত্যাদি বক্তব্য দিয়ে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করেছেন।

এর আগে মঙ্গলবার রাতে মোহাম্মদপুর থানায় জেড এম রানা নামের প্রতারণা ও অর্থ সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগে যে মামলা করেন তাতে তিনি কাজী ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে বাদী একটি স্কুলের টাকা আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগ করেছেন। সেই সঙ্গে তার কাছে চাঁদা দাবিরও অভিযোগ আনা হয়েছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলে ইসলামী বক্তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে
বাংলাদেশের বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলে ইসলামী বক্তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে

হেফাজতে ইসলামের উদ্বেগ

কাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে গ্রেপ্তারের পর একটি বিবৃতিতে নিন্দা জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম।

হেফাজতে ইসলামের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ”সম্প্রতি কিছু আলেমদের বিভিন্নভাবে গভীর রাতে তাদের নিজ বাড়ী থেকে বা অন্য কোন স্থান থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে এরূপ ঘটনা অনুচিত বলে আমরা মনে করি।”

”আমরা বলছি না যে, আলেম ওলামারা সবাই নিষ্পাপ বা সকল দোষ ও অভিযোগমুক্ত। হতে পারে তাদের মধ্যেও কেউ অপরাধী কিংবা দোষী থাকবেন। কিন্তু আমাদের দাবী হল, অভিযুক্তদেরকে দেশের সাধারণ নিয়মে বিচারের আওতায় আনলে জনগণ স্বস্তি পাবে।” বিবৃতিতে বলা হয়েছে।

কে এই কাজী ইব্রাহিম?

কাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামে এই ব্যক্তিকে ওয়াজ মাহফিলে নানারকম বিতর্কিত বক্তব্য দেয়ার কারণে বহু মানুষ চেনেন।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তার যেমন বিপুল অনুসারী শ্রেণি রয়েছ, তেমনি তাকে নিয়ে সমালোচনা ও ট্রলও কম নেই।

বৈজ্ঞানিক ইস্যুতে নানা অবৈজ্ঞানিক বক্তব্য দেয়ার কারণে বিভিন্ন সময়ে ট্রল হয়েছে তাকে নিয়ে।

সোমবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে মোহাম্মদপুর কলেজ রোডের বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়।

আটক হবার আগে ফেসবুক লাইভে এসে প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে বক্তব্য দেন মি. ইব্রাহিম।

সেখানে তাকে বলতে দেখা যায়, “আমি মুফতি কাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলছি। বিগত দুই সপ্তাহে এই দেশের সরকারের কল্যাণে, এ দেশের জনগণের কল্যাণে, এই দেশের স্বাধীনতার জন্য অকুতোভয় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুটো খুতবা দিয়েছিলাম। সাথে সাথে হিন্দুস্তানি রাজাকার, র-য়ের (ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) গুণ্ডারা এই মুহূর্তে আমার বাসায় লালমাটিয়ায় হানা দিয়েছে”।

তিনি ভিডিওতে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তাকে “গুম” করা হতে পারে।

ভিডিওটি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

এর আগে তিনি বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কারণ হয়েছেন।

বিশেষ করে তার “স্বপ্নে করোনাভাইরাসে টিকা আবিষ্কারের সূত্র”, “ভ্যাকসিন দিয়ে মানুষের শরীরের সব প্রাইভেসি নিয়ে নিচ্ছে”, “টিকা নিয়ে মেয়েরা ছেলে হয়ে যাবে” ইত্যাদি বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিস্তর ট্রল হয়েছে।

ইউটিউবে তার এক একটা বক্তব্যের ভিডিও লাখ লাখ বার দেখা হয়।

ওয়াজ মাহফিলে কি ধরনের বক্তব্য আসছে, তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম এবং বিভিন্ন মহলের পাশাপাশি সরকারের ভিতরেও আলোচনা ছিল।

এ বছরের জানুয়ারিতে ওয়াজ বা ধর্মীয় সমাবেশে কোরান এবং বিশুদ্ধ হাদিসের রেফারেন্স বাধ্যতামূলক করে বক্তব্য প্রদানের নির্দেশনা চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী মাহমুদুল হাসান।

তিনি বলেছিলেন, মাহফিলে অনেক বক্তা কাল্পনিক বক্তব্য, গালগল্প এবং রাষ্ট্রদ্রোহ বক্তব্য দিচ্ছেন। অনেকে গানও করেছেন। যা সমাজে বিভ্রন্তি সৃষ্টি করছে বলে তিনি মনে করেন।

মি. হাসান বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে মাহফিলের বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে কোরান হাদিসের রেফারেন্স বাধ্যতামূলক করে নির্দেশনা চেয়েছিলেন।

জানুয়ারি মাসে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে যা বলেছিলেন কাজী ইব্রাহিম:

বৈজ্ঞানিক বিষয়ে অবৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা সম্বলিত বক্তব্য দেয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলের মি. ইব্রাহিম।

“করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার কারণে নারীর দাঁড়ি গজাচ্ছে, পুরুষের কণ্ঠ পাল্টে নারীকন্ঠ হচ্ছে” এমন এক বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিবিসির কাদির কল্লোলকে তিনি বলেছিলেন, “সম্ভবত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট সাহেব এটা বলেছেন যে টিকা দেয়ায় নারীর দাঁড়ি গজাচ্ছে এবং পুরুষের কণ্ঠ পাল্টে যাচ্ছে। মিডিয়ায় এই তথ্য এসেছে। আমি কথা কিন্তু গভীর থেকে বলি। ভ্যাকসিন নিয়েও বিতর্ক আছে।”

তিনি তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যও টেনে এনেছিলেন সেসময়।

“প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও কিন্তু করোনাভাইরাস নিয়া, মাস্ক নিয়া বা বিভিন্ন বিষয় নিয়া অনেক কথা বলেছেন। এগুলোতো ভাইরাল হয় এবং মিডিয়া থেকে সাধারণত আমরা তথ্য কালেক্ট (সংগ্রহ) করি,” তিনি বলেন।

কাজী ইব্রাহিম এক বক্তৃতায় করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের গাণিতিক ‘সূত্র’ও দিয়েছিলেন। সেটি হচ্ছে “1.q7+6=13” । তার এমন বক্তব্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বহু হাস্যরস হয়েছে।

এ ধরনের বক্তব্যের ভিত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে মুফতি ইব্রাহিম এই সূত্রের বিষয়ে একজন প্রবাসীর স্বপ্ন দেখার কথা তুলে ধরেন।

“ইতালি প্রবাসী একজন বাংলাভাষী তার একটা স্বপ্ন আমাকে বলেছে। স্বপ্নে সে এটা দেখেছে।”

ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী স্বপ্নের কী ব্যাখ্যা আছে-তাও তিনি বিস্তারিত বলেন।

“স্বপ্ন ইসলামে তিন প্রকারের হয়। একটা আল্লাহ’র পক্ষ থেকে হয়, এটা সত্য হয়। একটা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়, এটা মিথ্যা হয়। আরেকটা নিজের জল্পনা কল্পনা থেকে হয়, এটাও মোটামুটি মিথ্যা হয়।”

স্বপ্ন নিয়ে ব্যাখ্যায় তিনি আরও বলেছেন, “যেহেতু আল্লাহ’র পক্ষ থেকে ইনফরমেশন হওয়ার একটা সম্ভাবনা অনেক সময় থাকে। এজন্য স্বপ্ন অনেক সময় সত্যও হয়। তাই একজনের স্বপ্নে দেখা ঐ সূত্র দিয়েছিলাম।”

কিন্তু এ ধরনের বক্তব্যগুলো বিতর্ক বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে কিনা-এমন প্রশ্নে মি. ইব্রাহিম বিতর্কের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

“দেখেন, বিতর্কের উৎসটা কী?”

তিনি নিজেই এর কারণ ব্যাখ্যা করেন গত ২০শে জানুয়ারি বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে । তিনি বলেন, কোন বিষয়ে জানার অভাব থেকে সেই বিষয় নিয়ে বিতর্ক করা হয়।

“আপনি একটা কথা বললে সে সম্পর্কে যদি আমার জ্ঞান না থাকে, তাহলে আমি বলবো এটা কি বললো- আমাদের জানার অভাব থেকেই কিন্তু আমরা যে কোন কথাকে বিদ্রুপ করবো বা উড়িয়ে দেব।”

তিনি আরও বলেছেন, “যখন জানবো যে একথার ভিত্তি আছে, তখন আর আমরা এসব করব না।”

তিনি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবনেও বিদ্রুপের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়কে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেন।

“বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকেও তো অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। ইউরোপের মধ্যযুগে বর্তমান বিজ্ঞানীদের পূর্বসূরীদের সবাই নির্যাতিত হয়েছে কমবেশি। তারা মার খেয়েছে, জেল জরিমানা হয়েছে। বিদ্রুপের দ্বারা তারা চরমভাবে জর্জরিত হয়েছে। কারণ তৎকালীন পৃথিবীর মানুষ তা জানতো না। আমার জ্ঞানহীনতার কারণে আমি বিদ্রুপ করতে পারি। কিন্তু এটাতো আমার দেখার বিষয় না”, বিবিসিকে বলেছিলেন তিনি।

ধর্মীয় বক্তাদের অনেকে মাহফিলে কোরান হাদিসের বাইরে বক্তব্য দিচ্ছেন বলে যে অভিযোগ জোরালোভাবে উঠছে, সে ব্যাপারে কাজী ইব্রাহিম বলেন, কোরান হাদিসের রেফারেন্সের ভিত্তিতেই বক্তব্য দেয়া উচিৎ।

একইসাথে তিনি বলেন, “বক্তারা ইচ্ছা করে কোরান হাদিসের বাইরে গিয়ে তথ্য দেন-বিষয়টা এমন নয়। এখন অনিচ্ছাকৃত কিছু ভুল মানুষ মাত্রই হয়।”

# সূত্রঃ বিবিসি বাংলা #