শিল্প সাহিত্য

স্কটল্যান্ড ডায়েরি- শেষ পর্ব

স্কটিশ হাইল্যান্ডসঃ গ্লেনকোর পথে পথে

-কাউসার রুশো                    

রবার্ট ব্রুস মন্যুমেন্ট

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক সকাল সাড়ে আটটায় গর্ডন গাড়ি সমেত হোটেলে এসে হাজির। গর্ডন ডেভিডসন, আমাদের ড্রাইভার কাম ট্যুর গাইড। গ্র‍্যান্ড ট্যুরস এর কর্ণধার এই স্কটিশ ভদ্রলোক আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবেন স্কটিশ হাইল্যান্ডস। এর আগে বুকিং ইস্যুতে গর্ডনের সাথে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হলেও সামনাসামনি এই প্রথম দেখা। ভদ্রলোক পুরোদস্তুর স্কটিশ বেশেই এসেছেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। ঐতিহ্যবাহী কিল্ট সাথে ধবধবে সাদা টিশার্ট। গাড়িতে চড়ে বসলাম। এডিনবরা শহর ছেড়ে যেতে হবে অনেকটা পথ। বলা হয়ে থাকে স্কটল্যান্ডের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে হাইল্যান্ডসে যেতে হবে। তাই আজ এই হাইল্যান্ডের পথেই রোড ট্রিপের আনন্দ আয়োজন। স্কটল্যান্ডের রূপ-লাবণ্য চোখে-মুখে মাখতে মাখতেই পরিচিত হবো স্কটল্যান্ডের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সঙ্গে। গর্ডন গাড়িতে স্কটল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী ব্যাগপাইপ মিউজিক ছেড়ে দিলো। লংড্রাইভে বাংলা/ইংরেজি অনেক ধরণের গান শুনে অভ্যস্ত হলেও ব্যাগপাইপ ঠিক যুতসই ঠেকলোনা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে টের পেলাম এই সুরের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছি। ব্যাগপাইপের সুর আরও আকৃষ্ট করলো যখন হাইল্যান্ডের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে দূর থেকে আরো দূরে চলে যাচ্ছিলাম।

‘দ্য কেল্পিস’ ভাস্কর্য

 

প্রথমে আমরা থামলাম ‘দ্য কেল্পিস’ ভাস্কর্য দেখার জন্য। স্টিলের তৈরি জোড়া ঘোড়ার এই অসাধারণ ভাস্কর্যটি স্কটল্যান্ডের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। স্বনামধন্য স্কটিশ ভাস্কর এন্ডি স্কট কেল্পিস ভাস্কর্যটি ডিজাইন করেছেন। এই ভাস্কর্যটি মূলত কৃষি, শিল্পকারখানা সহ স্কটল্যান্ডের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঘোড়ার ভূমিকাকে তুলে ধরেছে। স্কটল্যান্ডের ঐতিহ্যেও ঘোড়ার অবস্থান বেশ উল্লেখযোগ্য। কেল্পিস নামটা নেওয়া হয়েছে মূলত কেলটিক মিথোলজির চরিত্র কেল্পি থেকে। স্কটিশ অঞ্চলগুলোতে এই কেল্পি নামক ‘জল ঘোড়া’ নিয়ে নানারকম মিথ প্রচলিত আছে। বহুল প্রচিলত মিথটি হচ্ছে, এক সময় স্কটল্যান্ডের নিচু জলাভূমিতে খুবই শক্তিশালী এই কেল্পি ঘোড়াগুলো দেখা যেত। সাদা রঙের এই ঘোড়াগুলোর কেশর ছিলো কোঁকড়ানো, শরীরের চামড়া ছিল সীল মাছের মত পুরু এবং কিছুটা তেলতেলে। ঘোড়াগুলো দেখতে সুন্দর, সুঠাম আর নিরীহ মনে হলেও, এরা আসলে ছদ্মবেশে মানুষ শিকারের জন্য জল থেকে মাটিতে উঠে আসতো। ঘোড়াগুলোর রূপে মুগ্ধ হয়ে যারাই এর পিঠে চড়ে বসতো, তখনই কেল্পির শরীর থেকে এক ধরনের আঠা নিঃসৃত হয়ে শিকারকে আটকে ফেলতো। এরপর ঘোড়াগুলো পানির নিচে শিকারের কলিজা এবং হৃদপিন্ড বাদে বাকি সব চিবিয়ে খেত। কেল্পিরা কেন কলিজা আর হৃদপিন্ড খেত না সে রহস্য অবশ্য আজও উদঘাটিত হয়নি। এই কেল্পি ঘোড়াগুলো অনেক সময় লাস্যময়ী নারীর রূপ ধারন করেও শিকার করতো। এরকম আরো অনেক মিথ প্রচলিত আছে কেল্পি নিয়ে।

গ্লেনকোর পথে প্রান্তরে

কেল্পি ছাড়াও স্কটল্যান্ডে মিথের কোন কমতি নেই। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো স্কটল্যান্ডের জাতীয় পশু হচ্ছে ইউনিকর্ন! অথচ ইউনিকর্ন একটি মিথোলজিক্যাল প্রাণী! স্কটিশরা জাতি হিসবে কেন এত সৃজনশীল তা বোঝানোর জন্য মনে হয় এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট। আমি গর্ডনের সাথে আলাপ জুড়ে দিই। গর্ডন পার্ট টাইম সোশ্যাল কেয়ারে কাজ করে। আর বাকি সময় গাইড হিসেবে ট্যুরিস্টদের নিয়ে স্কটল্যান্ডের এ মাথা থেকে ও মাথা চষে বেড়ায়। আমি ওকে এডিনবরার প্রতি মুগ্ধতার কথা জানাই। ও বলে, আজকে তোমার মুগ্ধতা আরো ছাড়িয়ে যাবে। কথা বলে বুঝতে পারি মানুষ হিসেবে নিপাট ভদ্রলোক আমাদের এই গাইড মশাই। সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করি, স্কটল্যান্ডের ইতিহাস হচ্ছে গৌরবোজ্জ্বল বিপ্লবের ইতিহাস, অথচ সুযোগ পেয়েও তোমরা স্বাধীনতা চাওনা কেন? গর্ডনের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেলো এই প্রশ্নে। আমাকে পালটা জিজ্ঞেস করলো কে বললো চাইনা?

আমি বললাম, তোমরাই না ভোট দিয়ে জানালে এভাবেই বেশ আছো! একটু থেমে গর্ডন এবার বলতে শুরু করলো, দেখো, এখনো স্কটল্যান্ডের একটা বৃহৎ অংশ চায় আলাদা হয়ে যেতে। ভোটের হিসেবে পার্থক্যটা উনিশ-বিশ। কিন্তু মনে রেখো সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন আমরা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবো। ইংরেজদের সঙ্গে ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য কোন কিছুতেই আমাদের কোন মিল নেই। পর্যটন আর কৃষি দিয়েই আমরা অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারি। আমাদের নীতিনির্ধারকরা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে টিকে আছে। অথচ স্কটল্যান্ডের উন্নয়নের ব্যাপারে কেন্দ্রের তেমন কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের নেতাদের কন্ঠ তত বলিষ্ঠ নয়। গর্ডন কেমন বিমর্ষ হয়ে পড়ে। আমি আর এ বিষয়ে কথা বাড়াইনা। গর্ডন মিউজিক প্লেয়ারে কেল্টিক লোকগীতির ব্যাগপাইপ ভার্সন ছাড়ে। আমি আবার ব্যাগপাইপের সুরে মনোযোগ দিই। স্টারলিং ক্যাসেলে পৌঁছে এডিনবরা ক্যাসেলের মতই হতাশাগ্রস্ত হই। আগে থেকে বুকিং না থাকায় ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। তাই বাইরে রবার্ট ব্রুসের মনুমেন্টের সঙ্গে ছবি তুলেই তৃপ্ত থাকতেহলো।

লক লমন্ড

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লক লমন্ড। স্কটিশ ভাষায় লক মানে লেক। স্কটিশ লোকগীতিতে এই লক লমন্ডকে তুলে ধরা হয়েছে প্রেমপীঠ হিসেবে যেখানে খোঁজ মেলে সত্যিকারের ভালবাসার। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে দীর্ঘ সুজলা দ্বীপ ইঞ্চমারিন এই লেকের তীরেই অবস্থিত। শহরের কোলাহল থেকে মুক্ত সবুজ পাহাড়ঘেরা এই স্বচ্ছ জলরাশির পাড়ে বসে একটি বিকেল অনায়াসে কাটিয়ে দেয়া যায়। প্রকৃতির এমন উজাড় করা রূপ দেখে, আমার মত বেরসিক মানুষের মাথায়ও ভর করে কবিতা। কি এক আশ্চর্য মায়া আর স্নিগ্ধতায় তলিয়ে যাই যেন! নির্মল এই পরিবেশে, যে যার মত উপভোগ করছে নিভৃতে। কেউ জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, কেউ ছোট একটা নৌকা নিয়ে চলে যাচ্ছে কাছের এক গ্রামে। কেউবা আবার পাড়ে একটা চাদর বিছিয়ে বইয়ের পাতায় ডুব দিয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে গোটা পৃথিবীর মানুষ যখন মোবাইল আর নানা ধরণের গ্যাজেট নিয়ে ব্যস্ত, তখন এ দেশের কিছু অদ্ভুত (!) মানুষ এখনো বইয়ে আনন্দ খুঁজে পায়। পার্ক, বাস, ট্রেন সব জায়গাতেই এমন পড়ুয়া লোকের আনাগোনা দেখা যায়। বেশ ভালো লাগে এই ব্যাপারটা। লক লমন্ড আমাকে মনে করিয়ে দেয় চটগ্রামের অহংকার কাপ্তাই লেকের কথা। রাঙ্গামাটি যাওয়ার পথে পাহাড় ঘেঁষে বয়ে চলা কাপ্তাই লেক আর লক লমন্ড হয়ে গ্লেনকোর পথে এগিয়ে যাওয়া রাস্তাটা কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়। আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের ক্যাম্পাস জীবনের নস্টালজিয়ায় ডুবে যাই। মনের গহীনে কে যেন গেয়ে উঠে, লাল পাহড়ের দেশে যা/ রাঙ্গামাটির দেশে যা/ ইত্থাক তুকে মানাইছে না রে/ ইক্কেবারে মানাইছে না রে। আমরা ধীরে ধীরে স্কটল্যান্ডের অনেক গহীনে চলে যাই। ব্যাগপাইপের সুর আমাদেরকে আরো বেশ মোহিত করে রাখে। গ্লেনকোর পথের যাত্রাটুকু স্বপ্নময়! যেন মর্ত্যে খুলে গেছে স্বর্গের দুয়ার! আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে আছে ঘন সবুজ পাহাড়গুলো। পাহাড়ের গায়ে পেজো তুলার মত জমে থাকে মেঘ । ঐ দূরে দেখা যায় বেন নেভিস, যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। আকাশটাও ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলাচ্ছে। পাহাড়ের নীচে চড়ে বেড়াচ্ছে ভেড়া আর হরিণ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় পটে আঁকা কোন ছবি। আরো খানিকটা এগিয়ে যেতেই শুনতে পেলাম জল পতনের শব্দ। গাড়ি থামিয়ে শব্দের উৎসের খোঁজে ছুট লাগালাম। ছোট্ট কিন্তু প্রশান্তিময় এক ঝর্ণার সন্ধান পেলাম। গর্ডন আমাদের পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা রেললাইন দেখালো।

ফোর্ট উইলিয়াম

গ্লাসগো থেকে ফোর্ট উইলিয়াম যাওয়া যায় এই রেলে চড়ে। যারা এই রেল ভ্রমণে যাবেন, নিঃসন্দেহে ঐন্দ্রজালিক এক অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। গর্ডন আরো জানালো, গ্লেন মানে উপত্যকা আর কো নদীরতীরে এই উপত্যকা অবস্থিত বলে এই জায়গার নাম  গ্লেনকো । গ্লেনকোর প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ক্যাম্পবেল আর ম্যাকডোনাল্ড উপজাতির উপর ঘটে যাওয়া বর্বোরচিত ইতিহাসের কথা। আছে উইলিয়াম ওয়ালেস, রবার্ট ব্রুস সহ স্কটল্যান্ডের নানা ঐতিহাসিক গল্প। যারা মেল গিবসনের অস্কারজয়ী ‘ব্রেভ হার্ট’ চলচ্চিত্রটি দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন বীর উইলিয়াম ওয়ালেস এর কাহিনী। স্কটল্যান্ড শ্যুটিংস্পট হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে হাইল্যান্ডস আর ক্যসেলগুলো । ব্রেভ হার্ট, দি ডা ভিঞ্চি কোড, ট্রেইনস্পটিং, হ্যারি পটার, ম্যাকবেথ, আউটল কিং, দি উইকার ম্যান ইত্যাদি চলচ্চিত্রসহ আউটল্যান্ডার টিভি সিরিজের বেশ কিছু অংশ ধারণ করা হয়েছে এইস্কটল্যান্ডে।

গ্লেনকোর পথে প্রান্তরে

গ্লেনকোর সৌন্দর্যে আমরা এতটাই মোহাবিষ্ট হয়ে গেলাম, সেই রেশ থেকে বের হওয়া মোটেও সহজ ছিলোনা। গর্ডনকে বললাম তোমার দেশ আসলেই ছবির চেয়ে সুন্দর। গর্ডনের চোখে-মুখে তৃপ্তি আর অহংকার ফুটে উঠলো। গ্লেনকো থেকে আমরা চলে এলাম ফোর্ট উইলিয়াম নামক বন্দর নগরে। যারা বেন নেভিসের চূড়ায় উঠতে চান তারা এই ফোর্ট উইলিয়াম থেকেই ট্রে্কিং শুরু করেন। ফোর্ট উইলিয়ামের পোর্টে হিম হিম হাওয়ায় ম্যাকডোনাল্ডসের বার্গার দিয়ে ক্ষিধে মেটালাম। ফিরে যেতে মন নাহি চাইছে। কিন্তু অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, ফিরতে হবেই। গর্ডনকে বললাম আরো লম্বা সময় নিয়ে এখানে ফিরে আসতে হবে। গর্ডনও মিটিমিটি হেসে বলে, আসতেই হবে।

 

পড়ুনঃ স্কটল্যান্ড ডায়েরি – ১

কাউসার রুশো, ভ্রমণপিয়াসী ও চলচ্চিত্রপ্রেমী