শিল্প সাহিত্য

স্কটল্যান্ড ডায়েরি-১

এডিনবরাঃ সিটি অফ কন্ট্রাস্ট

-কাউসার রুশো

এডিনবরা শহর

যুক্তরাজ্যে গ্রীষ্ম আসি আসি করছে কিন্তু শীতের প্রকোপ তখনো কমেনি। অন্যান্যবারের চেয়ে এবার শীতটা বেশ ভালোই ভুগিয়েছে। তার উপর কোভিডের কারণে দীর্ঘ লকডাউনে সবার নাভিশ্বাস অবস্থা। তীর্থের কাকের মত সবাই অপেক্ষা করে গ্রীষ্মের জন্য। এক-দুই মাসের জন্য মিস্টার সামার আসেন বৈকি কিন্তু এরই মাঝে বৃষ্টি বাগড়া বাধায়। মে এর মাঝা্মাঝি লকডাউন কিছুটা শিথিল করায় সবাই একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ব্রিটিশরা এক রকম জোর করেই ‘সামার ভাইব’ নিয়ে আসলো জীবনযাত্রায়। বাইরে শর্টস আর টিশার্টের ছড়াছড়ি লেগে গেলেও সুয্যি মামার দেখা নেই তখনো। আমি উইন্টার জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে বের হই আর অবাক হয়ে এই ক্ষ্যাপাটে জাতির কাজকর্ম দেখি।

বিলেতের পাট প্রায় চুকে আসছে কিন্তু তেমন একটা বেড়ানো হয়নি। মূলত করোনার কারণেই। তাছাড়া শীতটাও এখানে এত দীর্ঘ আর কষ্টদায়ক যে বেড়ানোর কোন সুযোগ নেই এই সময়গুলোতে।ব্রিটিশদের দেখে এবার আমিও একটু সাহসী হয়ে উঠার চেষ্টা করলাম। অনেকদিনের ইচ্ছে স্কটল্যান্ডে যাওয়ার। ভাবলাম আরেকটা লকডাউন চলে আসার আগেই একটা ঢুঁ মেরে আসলে মন্দ হয়না। ট্যুরের সহযোগী হিসেবে পেয়ে গেলাম বন্ধু জ্যোতির পরিবারকে। তাই আর দেরি না করেই সব বুকিং দিয়ে ফেললাম। জুনের শুরুটাই হলো আমাদের স্কটল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা দিয়ে। আমি আমার স্ত্রী আর চার বছরের কন্যাকে নিয়ে বাসস্থান কভেন্ট্রি থেকে ট্রেনে চেপে বসলাম। আর বন্ধু পরিবার রওয়ানা দিলো নিজস্ব বাহনে চড়ে। আমাদের গন্তব্য স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা। এডিনবরা থেকেইআমরা স্কটল্যান্ডের আরো কিছু জায়গায় ঘুরে বেড়াবো, তেমনই পরিকল্পনা।

সাড়ে চার ঘন্টা রেল যাত্রা শেষে যখন নামলাম, নিজেদের আবিষ্কার করলাম ছবির চেয়েও সুন্দর একটা শহরে। ‘সিটি অফ কন্ট্রাস্ট’ হিসেবে পরিচিত- এডিনবরা। এ যেন প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মত ব্যাপার। কোন শহরে ঢুকেই এমন অনুভূতি হয়নি আগে। সামনের কটা দিনে এডিনবরা তার আভিজাত্য আর বনেদী সৌন্দর্যঢেলে দিয়েযে আমাদের বরণ করে নিবে আর আমরা আরো বেশি করে তার প্রেমে মজবো সেটা তখনো বুঝিনি।

এডিনবরা হোটেল

হোটেলে মালসামান সব রেখে আমরা আর দেরি করলাম না। বেরিয়ে পড়লাম হেঁটে হেঁটে শহরটাকে আবিষ্কার আর অনুভব করার জন্য। যে কোন নতুন জায়গায় বেড়াতে গেলে, হেঁটেহেঁটে ঘুরে দেখতে আমার বেশ লাগে। কভেন্ট্রি থেকে আসার সময় আবহাওয়া অতটা যুতসুই না দেখালেও, এডিনবরাতে মিষ্টি রোদের স্পর্শ পেলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্নই বটে!

প্রিন্সেস স্ট্রিট থেকে আমরা শুরু করলাম আমাদের পদব্রজে ভ্রমণ। এখানেই আছে প্রিন্সেস স্ট্রিট গার্ডেনস। আর সেখানেই রয়েছে বিখ্যাত সাহিত্যিক ‘আইভ্যান হো’র লেখক স্যার ওয়াল্টার স্কটের স্মৃতিতে বানানো বিশাল সৌধ ‘স্কট মনুমেন্ট’। ছেলেবেলায় সেবা প্রকাশনীর সুবাদে স্কট সাহেবের আইভ্যান হো, তালিসমান বইগুলোর অনুবাদ পড়ার সুযোগ হয়েছে। তাই ভ্রমণের শুরুতেই এই মনুমেন্টটা দেখতে পেয়ে খুব আনন্দ হলো।

স্কট মনুমেন্ট

পুরো শহরটাই নয়নাভিরাম স্থাপত্যশৈলীর প্রাচীন সব ভবনে ঘেরা।শহরের মধ্যেই সমান্তরালে চলছে ট্রাম-ট্যাক্সি-বাস। এডিনবরার ইতিহাস প্রায় ১৩০০ বছরের পুরোনো। শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ এই শহর। স্কটল্যান্ডের রাজধানী শহরটিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। শহরের ভেতরে আছে মধ্যযুগে বানানো ‘ওল্ড টাউন’ বা পুরোনো শহর এবং আঠারো-উনিশ শতকে গড়ে ওঠা ‘নিউ টাউন’ বা নতুন শহর। নিউ টাউনটাও ওল্ড টাউনের আদলেই বানানো। এখনো শহরের অবকাঠামোগত যে প্রকল্পগুলো চলছে সেগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। স্কটিশরা বরং তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই বেশি তৎপর। আমরা হাঁটছি আর স্থাপত্যশৈলী দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। হেঁটে হেঁটে চলে এলাম ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে। বিশ্বনন্দিত হ্যারি পটার সিরিজের জননী জে কে রাওলিং এই রাস্তা থেকেই ‘ডায়াগন এলেই’ এর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। হ্যারি পটার ভক্তরা জেনে থাকবেন, ডায়াগন এলেই হচ্ছে জাদুরাজ্যের কেনাকাটার জন্য নির্ধারিত স্থান যেখানে জাদুকরদের জন্য রয়েছে হরেক রকমের জিনিসের সমারোহ। এই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই গ্রাস মার্কেট। গ্রাস মার্কেট সুপরিচিত খাবারের দোকান আর পাবের জন্য। ট্যুরিস্টদের কলকাকলিতে এই জায়গাটা মুখরিত থাকে সব সময়। এখানে টেলিফোনের আবিষ্কারক দি আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল এর নামে একটি পাব রয়েছে। গ্রাহাম বেলের জন্মস্থান এই পাব থেকে কাছেই। আমরা গ্রাস মার্কেটের একটা রেস্টুরেন্টে বসে পড়লাম কিছু খেয়ে নিবো বলে। খাবার অর্ডার করে এই রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে তাকাতেই অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে গেলো। পাহাড়ের চূড়ায় ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা একটি ক্যাসেল যেন ক্যানভাসে শিল্পীর রং-তুলিতে আঁকা জলজ্যান্ত কোন ছবি। এটিই হচ্ছে এডিনবরার অন্যতম দর্শনীয় স্থান ‘এডিনবরা ক্যাসেল’।

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে আমরা পদব্রজ অব্যাহত রাখলাম। ওল্ড টাউন হয়ে নিউ টাউন চক্কর দিয়ে ফেললাম।বাইরে থেকে দেখলাম এডিনবরার সবচেয়ে পুরোনো গির্জা সেইন্ট জাইলস ক্যাথেড্রাল, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, রাইটার্স মিউজিয়াম আর ন্যাশনাল গ্যালারি। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, রাফায়েল, মোনে, দেগাসহ বহু খ্যাতনামা শিল্পীর কীর্তি সযত্নে রক্ষিত আছে ন্যাশনাল গ্যালারিতে। এডিনবরার রাস্তায় রাস্তায় ঐতিহ্যবাহী স্কটিশজামা ‘কিল্ট’পরিহিত শিল্পীদেরদেখা যায় ‘ব্যাগপাইপ’ বাজিয়ে ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ করতে। আমরাও সেইন্ট জাইলস ক্যাথেড্রালের কাছাকাছি জায়গায় পেয়ে গেলাম এক ব্যাগপাইপওয়ালাকে। দাঁড়িয়ে শুনলাম স্কটিশদের ঐতিহ্যবাহী এই বাদ্যের বাজনা। ব্যাগপাইপের সুরের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। গভীরভাবে উপলব্ধি করলে বিষাদের মূর্ছনাই যেন ধ্বনিত হয়।

আমরা ফিরে আসলাম আমাদের হোটেলে। লিথ নামক জায়গায় অবস্থিত আমাদের সাময়িক এই থাকার জায়গাটি। লিথ হচ্ছে এডিনবরার পোর্ট ডিস্ট্রিক্ট। আমাদের হোটেলটা লিথ ওয়াটারফ্রন্টের পাশেই। রুম থেকেই সীভিউ পাওয়া যায়। হোটেল ঘেঁষেই রক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে একটা চমৎকার লাইটহাউজ।

এডিনবরার পোর্ট ডিস্ট্রিক্ট – লিথ

পরদিন সকালে আমরা হপ অন হপ অফ বাস সার্ভিসের টিকেট কাটলাম। ট্যুরিস্টদের জন্য এই বাসটি সারা দিন ধরে শহরের এক মাথা আরেক মাথায় চলাচল করে। সব বাসে একজন গাইড থাকেন, যিনি পুরো সময়টায় শহরের বিভিন্ন স্থানের ইতিহাস আমাদের জানিয়ে দেন।

হপ অন হপ অফ বাস সার্ভিস

বাসের উপরের অংশটা উন্মুক্ত।ষোল পাউন্ড দিয়ে টিকেট করে নিলে সারাদিন যতবার ইচ্ছে ততবার এই বাসে ওঠানামা করা যায়। আমরা এবার বাসে করেই পুরো শহরটা দেখলাম। শার্লক হোমসের স্রস্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের জন্মস্থান এডিনবরা। তাঁর সম্মানে নির্মাণ করা হয়েছে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল সেন্টার। বাসের ছাদে চড়েই দেখে নিলাম এই সেন্টারটি।এবার এডিনবরা ক্যাসেল আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো। সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যাসেলের ভেতরে ঢুকবো। দুভার্গ্যক্রমে টিকেট না পাওয়ায় ক্যাসেলের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ হলোনা। পরদিন আমাদের গন্তব্য ভিন্ন একটি জায়গায় তাই এ যাত্রায় আর সুযোগ হবেনা ক্যাসেল দেখার। স্কটল্যান্ডের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আর জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট হলো হলিরুড প্যালেস। হলিরুড প্যালেস হচ্ছে স্কটল্যান্ডে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সরকারি বাসভবন। এই প্যালেসটির সৌন্দর্যও চোখ ধাঁধানো। প্যালেসের বাইরেই স্কটল্যান্ড পার্লামেন্ট।

হলিরুড প্যালেস

এডিননবরা ক্যাসেল ও হলিরুড প্রাসাদের মাঝখানের প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে রাস্তাটি ‘রয়্যাল মাইল’ নামে পরিচিত। এই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই ‘আর্থারস সীট’। পাহাড়ের চূড়ায় প্রাচীন এক মৃত আগ্নেয়গিরি মুখ এই আর্থার’স সীট। এই পাহাড় ঘিরেই গড়ে উঠেছে হলিরুড পার্ক। প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক রবার্ট লুই স্টিভেনসন এই জায়গাটিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে ‘এ হিল ফর ম্যাগনিচ্যুড, এ মাউন্টেইন ইন ভার্চু অফ ইটজ বোল্ড ডিজাইন’। আমরা পাহাড়ি পথ ধরে অনেকখানি হাঁটলাম । পাহাড়ের উপর থেকে শহরটাকে মনে লেগো দিয়ে বানানো ছিমছাম শহর। এডিনবরায় পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন স্পট বানিয়ে রাখা আছে যেখান থেকে পুরো শহরটাকে দেখতে পাওয়া যায়। এডিনবরা ক্যাসেলের বাইরে থেকে শহরের টপ ভিউ খুবই দৃষ্টিনন্দন ।

এডিনবরা ক্যাসেল

 

শহরের ভেতরেই প্রচুর স্মারক উপহার কেনার দোকান। স্কটিশ ঐতিহ্যবাহী ভেড়ার লোমের তৈরি মাফলার এখানে বিখ্যাত। ব্যাগপাইপও প্রচুর বিক্রি হয় স্যুভেনির হিসেবে। আর স্কটিশদের জাতীয় পোশাক কিল্ট কেউ কিনুক বা না কিনুক, পড়ে ছবি তুলে নিতে কেউ ভুল করেনা। কুকিজ, ক্যান্ডি আর বিস্কুটের জন্যও এডিনবরা সুপরিচিত। ‘কিংডম অফ সুইটস’ নামের একটি দোকানে ঢুকে তো চক্ষু ছানাবড়া! কতশত রকমের চকোলেট, শর্টব্রেড আর ক্যান্ডি দেখলাম যে বাচ্চাদের কী বলবো আমার নিজেরই মনে হচ্ছিলো দু’হাত ভরে নিয়ে যাই।

স্কটল্যান্ডের হুইস্কির জগত জোড়া খ্যাতির কথা সবাই জানে। প্রচুর স্কচ হুইস্কি শপের পাশাপাশি এখানে হুইস্কি টেস্ট আর এক্সপেরিয়েন্স ট্যুরও বেশ জনপ্রিয়। টিকেট কেটে ট্যুরিস্টরা হুইস্কি বানানোর পদ্ধতি দেখে আসতে পারেন, ওখানে বসেই হুইস্কি চেখে দেখতে পারবেন আর ইচ্ছে হলে কিনে আনারও সুযোগ রয়েছে।

বিকেলের দিকে আমরা গেলাম দি রয়েল ইয়ট ব্রিটানিয়া নামক জাহাজ পরিদর্শনে। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই জাহাজটি ব্রিটিশ রাজপরিবারকে সেবা দিয়ে এসেছে। এরপর জাহাজটিকে মিউজিয়াম বানিয়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আমাদের দলের ক্ষুদে সদস্যরা এই জায়গাটি বিশেষ পছন্দ করলো। আর তাতে আমরাও খুশি হলাম বৈকি!

বাইরে থেকে খেয়ে দেয়ে সন্ধ্যার দিকে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম কারণ পরের দিন খুব সকালে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে স্কটল্যান্ডের আরেক প্রান্তের উদ্দেশ্যে।

(…চলবে)

পড়ুনঃ স্কটল্যান্ড ডায়েরি- শেষ পর্ব

কাউসার রুশো, ভ্রমণপিয়াসী ও চলচ্চিত্রপ্রেমী