চলমান সংবাদ

সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় হত্যাকাণ্ডে ছয় জনের মৃত্যুদণ্ড

 

জুলহাজ মান্নান
জুলহাজ মান্নান

সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যার পাঁচ বছরের বেশি সময় পর মঙ্গলবার ঢাকার একটি আদালত ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু জানান, দুপুরে এই রায় ঘোষণা করেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান। ওই মামলার দুজন অভিযুক্তকে খালাস দেয়া হয়েছে। সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়কে হত্যা মামলায় ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্ক শেষ হয় গত ২৩শে অগাস্ট। যুক্তিতর্ক শেষে আদালত আদালত মঙ্গলবার রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেছিল।

২০১৬ সালের ২৫শে এপ্রিল ঢাকার কলাবাগান এলাকায় লেক সার্কাস রোডে জুলহাজ মান্নানের বাসায় ঢুকে তাকে এবং তার বন্ধু থিয়েটার কর্মী মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। দেশে ধারাবাহিক জঙ্গি হামলার ঘটনার মধ্যে এই হত্যা ঘটনা তখন ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। পরেরদিন একটি টুইটার বার্তায় ওই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে ঘোষণা দেয় আনসার-আল-ইসলাম, যারা নিজেদের ‘আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট (একিউআইএস) এর বাংলাদেশ শাখা বলে দাবি করে। হত্যা মামলাটিতে দীর্ঘ তদন্তের পর পুলিশ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আর ইসলামের (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) আটজন সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল ঘটনার তিন বছর পর ২০১৯ সালের ১২ই মে।

২০২০ সালে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচারের কার্যক্রম শুরু করা হয়। আসামীরা হলেন, চাকরীচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, আকরাম হোসেন, সাব্বিরুল হক, জুনাইদ আহমদ, মোজাম্মেল হোসাইন ওরফে সায়মন, আরাফাত রাহমান ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, শেখ আব্দুল্লাহ এবং আসাদুল্লাহ। চাকরীচ্যুত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হকসহ চারজন অভিযুক্ত এখনও পলাতক রয়েছে।

বাংলাদেশে সমকামীদের মুখপত্র রূপবানের এই দুটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয়েছিল।

বাংলাদেশে সমকামীদের মুখপত্র রূপবানের এই দুটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয়েছিল।

কে জুলহা মান্নান?

জুলহাজ মান্নান ছিলেন সমকামীদের অধিকার বিষয়ক বাংলা ভাষার প্রথম পত্রিকা রূপবানের সম্পাদক। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন আমেরিকান দাতা সংস্থা ইউএসএইড কর্মকর্তা। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমবারের মতো এমন রূপবান প্রকাশিত হয় যেটির উদ্দেশ্য সমকামীদের পক্ষে কথা বলা। বাংলা ভাষার এই পত্রিকাটির নাম রূপবান। অবশ্য মোটে দুটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয়েছিল রূপবানের। এর আগে বাংলাদেশের সমকামীরা কখনো এমনভাবে প্রকাশ্য হয়নি, নিজেদের অধিকারের কথা তাদেরকে কখনো বলতেও শোনা যায়নি। তখন রূপবানের সম্পাদকীয় বোর্ডের একজন সদস্য ছিলেন জুলহাজ মান্নান। আততায়ীদের হাতে নিহত হবার আগ পর্যন্ত রূপবানের সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল মি. মান্নানের হাতেই। ২০১৫ সালে রূপবানের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিবিসি বাংলাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মি. মান্নান। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “রূপবান সমকাম নয় বরং সমপ্রেমে বিশ্বাসী মানুষের ভালবাসার অধিকারের বিষয়টি তুল ধরতে চায়। সমপ্রেমে বিশ্বাস করে এমন মানুষদের জীবনধারা, ভালোলাগা ও দুঃখ কষ্টের বিষয়টি তুলে ধরে রূপবান।” “বাংলাদেশে সমকামীরা অদৃশ্য জীবনযাপন করে কিন্তু আমরা জানাতে চাই যে এই সমাজেই আমরা আছি এবং আমরা আপনাদের পরিবারেই সদস্য”। বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজে এ ধরণের পত্রিকা প্রকাশ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে পরবর্তী দিনগুলোতে নানা বিতর্ক হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে মি. মান্নান বলেছিলেন, “এদেশের রক্ষণশীল সমাজে সমপ্রেম নিয়ে পত্রিকা বের করতে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে তাদের বেশ কৌশলী হতে হয়। এটা একটা বাড়তি চাপ।” ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ছিলেন মি. মান্নান। সেখানে তার শৈশবের একজন সহপাঠী বলেছেন , ‘জুলহাস ছিল খুব মেধাবী, খুব পড়ুয়া এবং খুবই বন্ধু অন্তঃপ্রাণ। তিনি সবার সাথেই মিশতে পারতেন”। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়াশোনা করেছেন এবং সেখানে তাকে যারা চিনতেন তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলহাস ছিলেন জনপ্রিয়।

মি. মান্নানের সাথে তার যে বন্ধুকে খুন করা হয়েছে, সেই মাহবুব তনয়ের সাথে তার বন্ধুত্ব ছাড়া আর কোন সম্পর্ক ছিল না বলে ওইসময় জানিয়েছিলেন তার একজন বন্ধু। কলাবাগানের ওই বাড়িতে জুলহাজ মান্নানের সঙ্গে থাকতেন তার মা এবং একজন গৃহকর্মী। বহু বছর ধরেই তারা ওই বাড়িটিতে রয়েছেন। চাকরিজীবনেও সফল ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন মি. মান্নান, সেটা বোঝা যায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জন কিরবির বক্তব্যে। মি. কিরবি ২০১৬ সালে জুলহাজ মান্নান হত্যাকাণ্ডের পর বলেছিলেন, “তিনি ছিলেন মার্কিন দূতাবাসের প্রিয় কর্মী”।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা