মতামত

আগস্টের দিনগুলি (শেষ পর্ব) – তিরিশ বছর পর

– বিজন সাহা

সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ অতীত। অন্তত তার শারীরিক উপস্থিতি আর নেই। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন রাশিয়া, ইউক্রেইন আর বেলোরুশিয়ার তৎকালীন তিন নেতা। তারা তখন কতটুকু দেশের আর দেশের মানুষের কথা ভেবেছিলেন আর কতটুকু নিজেদের ক্ষমতার কথা সেটা তারাই জানেন। রাশিয়ায় প্রথমেই যেটা শুরু হয় সেটাকে বলা চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিত্তি সমূলে উৎপাটন করা। শত ভুলের পরেও সোভিয়েত ব্যবস্থা যে অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল দেশে আর যার উপর দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক রাশিয়া নতুন সময়ের নতুন চ্যালেঞ্জের উত্তাল সমুদ্রে পাড়ি জমাতে পারত নতুন বিপ্লবের কাণ্ডারিরা সেটাকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লাগে। জলের দামে বিক্রি করে দিতে থাকে কল-কারখানা। ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে কল-কারখানা। প্রথমবারের মত এ দেশে দেখা যাবে বেকার মানুষ। বেকারত্বের সাথে সাথে বাড়বে অপরাধ। না, মানুষ এই গণতন্ত্রের জন্য সেদিন প্রাণ দেয়নি, মানুষ এই গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেনি। এরপর এদেশের মানুষ দেখবে পশ্চিমা দুনিয়ার হাসি আসলে হাসি ছিল না, সেটা ছিল হায়েনার দাঁতের ঝলকানি। বিভিন্ন সময়ে রাশিয়াকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে ন্যাটো কড়া নাড়বে রাশিয়ার দোর গোঁড়ায়, কারণে অকারণে আরোপ করবে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা। একদিন এদেশের অধিকাংশ মানুষ দেখবে স্বপ্ন সেটা শুধুই স্বপ্ন, বাস্তবটা অনেক কঠিন। এ এক কঠিন বাস্তবতা যাকে মেনে নেওয়া আরও কঠিন।
একটা আনেকদত ছিল। এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল
– সুখ কী?
– সুখ? এটা এ দেশে জন্ম নেওয়া।
– আর দুঃখ?
– দুঃখ? এটা এমন সুখ অর্জন করা।

হ্যাঁ, এ দেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য গণতন্ত্রের রঙিন স্বপ্ন একই সাথে তাদের সুখ আর দুঃখ। আমরা যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি কমিউনিস্ট মানেই ছিল সম্মানিত লোক। যদিও পরে বুঝেছি ব্যাপারটা তেমন নয়। সুযোগ সুবিধা আদায়ের জন্য অনেকে পার্টিতে নিজেদের নাম লিখিয়েছে। আজ অনেক দেশেই লোকজন সরকারি দলে নাম লেখায়। দোষ যত না সাধারণ মানুষের তার চেয়ে বেশি সিস্টেমের। যদি সিস্টেম শুধুমাত্র রাজনৈতিক মত পার্থক্য থাকায় বা পার্টি মেম্বার না হওয়ায় যোগ্য লোককে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে তাহলে শুধু যোগ্যরাই যে পার্টি মেম্বার হবে তা নয়, এই সুযোগে অনেক সুবিধাবাদী পার্টিতে নাম লেখাবে। ফলে এতে পার্টি ও দেশ দুটোই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তারপরেও তখনও পর্যন্ত পার্টি মেম্বার কোন গালি ছিল না। কিন্তু গত শতকের নব্বুইয়ের দশকে পার্টি মেম্বার বলতে গেলে গালিতে পরিণত হয়। মানুষ ঝাঁক ধরে পার্টির মেম্বারশিপ ত্যাগ করতে শুরু করে। তখন ফ্যাসন ছিল ডেমোক্র্যাট আর লিবারেলদের। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এরা নিজেদের এমন ভাবে পচায় (আসলে ওদের মূল লক্ষ্যই ছিল দেশ ভাঙ্গা, সোভিয়েত ব্যবস্থা যাতে আর কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা) লিবারেল মানে হয়ে দাঁড়ায় প্রায় বিশ্বাসঘাতক।

মনে পড়ে ১৯৮৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে আসার ঠিক পরের দিনগুলোর  কথা। আমি এসেছি বাংলাদেশের এক ছোট্ট গ্রাম থেকে। অনেক সময় এমনকি মস্কোয়ও এমন সব টুকুটাকি জিনিস পাওয়া যেত না যার অভাব কখনও আমার গ্রামেও অনুভব করিনি। অবাক হতাম। শুনেছি সামান্য জিনসের জন্য মানুষ পুরো মাসের বেতন দিয়ে দিতে রাজী। সেটা ছিল কালো বাজারে। নিজে এ কাজ করিনি, তাই এটা সত্য হলেও একেবারেই শোনা কথা। তখন মনে হত কেন মানুষ সামান্য জিনসের জন্য দেশ, আদর্শ সব বিক্রি করতে রাজি। এখন ভাবি, কেন সরকার জিনস কিনে এদেশের মানুষের কাছে বিক্রি করত না। তাহলে কালো বাজারি বন্ধ হত, মানুষের হাতেও অতিরিক্ত টাকা থাকত না আর মানুষও হয়তো এভাবে নিজেদের আদর্শ ভুলে যেত না। কেন যেন মনে হয় পুঁজিবাদকে ঘৃণা করে সমাজতন্ত্রের কাণ্ডারিরা পুঁজিকেই ঘৃণা করেছে। বিপ্লবের পর  ধনীদের টাকা পয়সা গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে কিছুদিন চলা যায়, তবে নতুন করে পণ্য উৎপাদন না করলে, সেটা থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি না করলে জনগণকে বেতন দেওয়া যায় না আর প্রতিনিয়ত সেই উদ্বৃত্ত মুল্যের পরিমাণ না বাড়লে জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নত করা যায় না। আসল কথা কী পুঁজিবাদী, কী সমাজতান্ত্রিক – উভয় সমাজে পুঁজিই মূল চালিকা শক্তি। পুঁজির বিকল্প পুঁজিই। সব কিছুর মতই পুঁজিও পরিবর্তনশীল। দক্ষ হাতে সে বৃদ্ধি পায়, অদক্ষ হাতে কর্পূরের মত উবে যায়। তবে যেকোনো দেশের  দক্ষ সরকারের কাজ দেশের পুঁজি বৃদ্ধি করা। আর সেই উদ্বৃত্ত মূল্য কীভাবে জনগণের মধ্যে বণ্টন করা হবে তার উপর নির্ভর করে ব্যবস্থা পুঁজিবাদী হবে নাকি সমাজতান্ত্রিক। এই সহজ সত্যটা ঠিক মত অনুধাবন না করার কারণে বিশাল পটেনশিয়াল থাকার পরেও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি।

রাশিয়ার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এখানে মানুষ সব সময়ই শক্তিশালী শাসক পছন্দ করে। সেটা ইভান দ্য টেরিবল হোক, পিটার দ্য গ্রেট হোক, স্ট্যালিন হোক আর পুতিন হোক। হতে পারে এটাই এ দেশের, এ সমাজের বিশেষত্ব। এটা ভালও নয়, মন্দও নয়। এটা বাস্তবতা। মনে রাখতে হবে এসব দেশ হাজার বছর ধরে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও যুগ যুগ ধরে কিছু কিছু ট্র্যাডিশন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেটা আমরা আমাদের দেশেও দেখতে পাব। সাংবিধানিক ভাবে অনেক প্রথা উঠিয়ে দিলেও আমাদের সব দেশে সেসব বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। এখানেও তাই। হয়তো আমেরিকা, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জীল্যান্ড ইত্যাদি হাতে গোনা কয়েকটি দেশ সব নতুন করে শুরু করতে পেরেছে। তবে তার মুল্যটা কী?  স্থানীয় জনগণকে বলতে গেলে নিশ্চিহ্ন করে একেবারে নতুন করে শুরু করেছিল তারা। আর এরা কারা? মুলত নিজ দেশের প্রান্তিক মানুষ যাদের কোন  নৈতিকতা ছিল না। তাদের একটাই লক্ষ্য ছিল যে করেই হোক সম্পদশালী হওয়া। অসীম আকাশ তাদের সীমানা। কিসের? লোভের। সেটাই তাদের স্লোগান। এমনকি আজও। তাই সেখানে ব্যক্তি মানুষ সবার উপরে। তবে সে শুধু নিজেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণকারী। ফলে পশ্চিমের সাথে এদের যে যাবে না সেটা জানা কথা। আসলে যখন থেকে রাশিয়া ক্যাথলিক না হয়ে প্রভস্লাভ হয় তখন থেকেই সমস্যার শুরু। আমরা শুধু ক্রিস্টান আর মুসলিমদের মধ্যে ক্রুসেডের কথা শুনেছি, কিন্তু পশ্চিমা ক্রিস্টানরা এর চেয়েও বেশিবার আক্রমণ করেছে প্রভস্লাভ রাশিয়াকে। তাই এই দুই সভ্যতার দ্বন্দ্বের ইতিহাস সুপ্রাচীন। আর এ কারণেই পশ্চিমারা এদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পরিবর্তে গণতান্ত্রিক রাশিয়া তাদের লক্ষ্য ছিল না, তাদের লক্ষ্য নো রাশিয়া। সেটা এখনও আছে। মানুষ সেটা বোঝে বা বলা যায় বিশ্বাস করে। আর এ কারণেই ঠাণ্ডা যুদ্ধের পর যখন সত্যিকার অর্থেই একটা নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার সুযোগ ছিল পশ্চিম সেটা গ্রহণ করেনি। আজ আমরা যা দেখছি সেটা সেই রাজনীতির ফল।

 

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণ নিয়ে এখনও আলোচনার শেষ নেই। যদিও আমেরিকা সহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপ, আন্তর্জাতিক বাজারে ইচ্ছে করে তেলের দাম হ্রাস করা এসব সোভিয়েত অর্থনীতিকে অচল করে তার পতন ত্বরান্বিত করে, তবে মূল কারণ যে ছিল আভ্যন্তরীণ সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এ নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। অনেকের ধারণা এর পেছনে রয়েছে গরবাচভের অদক্ষতা। তিনি উঠে এসেছিলেন স্তাভ্রপলের মত প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। কৃষি প্রধান এ এলাকায় বড় হয়ে এত বড় পার্টির দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা – কোনটাই তাঁর ছিল না। তিনি মস্কো আসেন আন্দ্রপভের হাত ধরে, কিন্তু বেশি দিন তাঁর ছত্রছায়ায় থেকে মস্কোর রাজনীতি শেখার আগেই আন্দ্রপভের মৃত্যু ঘটে। এছাড়াও তিনি ছিলেন স্ত্রী রাইসা মাক্সিমভনার প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল। এমনকি ক্যুর পরে ফরস থেকে ফেরার পর সরাসরি রুশ পার্লামেন্ট বেলি দমে আসার পরিবর্তে তিনি অসুস্থ স্ত্রীর সাথে নিজ দাচায় ফিরে যান। নিয়তির নির্মম পরিহাস এই যে স্ত্রীর প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্যের ফলে শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাই সাম্রাজ্য হারান। প্রথমে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন আর অক্টোবর বিপ্লবের পর সপরিবারে প্রাণ হারান। একই ভাবে স্ত্রীর প্রতি অতি অনুরক্ততার কারণে গরবাচভ দেশ হারায়। সে সময় এ দেশে একটা জোক চালু ছিল যে গরবাচভ নয়, রাইসা মাক্সিমভনাই দেশ চালান। এছাড়াও অনেকের ধারণা সে সময় যদি পার্টি ও সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কিছু লোক জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করে ২০ আগস্ট বিভিন্ন রিপাবলিকের মধ্যে পূর্ব পরিকল্পিত চুক্তি সই করার সুযোগ দিতেন ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিতে পারত। তবে গরবাচভ আর ইয়েলৎসিনের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যে দেশের মেরুদণ্ড চূড়ান্ত ভাবে ভেঙ্গে দিয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এর উপর ছিল ইতিমধ্যে পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ। তবে এ সবই সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক অব্যবস্থার কারণে। একদলীয় শাসন এক ব্যক্তির হাতে অপরিসীম ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষমতাকে দেশের উন্নতির কাজে লাগানোর জন্য যে মানসিক দৃঢ়তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার সেটা সবার থেকে না। রাজনৈতিক মনোপলি সব দেশেই দুর্নীতির জন্ম দেয়, জন্ম দেয় জবাবদিহিতার অভাবের। অনেকেই বলেন মাল্টিপার্টি সিস্টেম যেহেতু সমাজতন্ত্রের অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করত, তাই এক পার্টি অথবা বহু পার্টির এক কোয়ালিশন, যা ছিল পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, সমাজতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত। কিন্তু কথা হল যদি সমাজতন্ত্রকে সাংবিধানিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের মত যেসব দল এই সংবিধান মেনে চলে তারাই রাজনীতি করার অধিকার পায়, তাহলে সমস্যা কোথায়? গণতন্ত্রের সাথে তো সমাজতন্ত্রের সমস্যা নেই, সমস্যা পুঁজিবাদের সাথে জাতীয় সম্পদ বন্টনের প্রশ্নে। কিন্তু যদি দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকত আর নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনা থাকত, তাহলে সিপিএসইউ এত দুর্নীতিগ্রস্থ হতে পারত না। সে জবাবদিহিতার পথ থেকেও সরতে পারত না। তবে এই সমস্যা শুধু সমাজতন্ত্রের নয়। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশেও ক্ষমতাসীন দল তাদের শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে বিরোধী দলগুলোকে দুর্বল করে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের সাময়িক লাভ হলেও গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলাফল স্বৈরাচারের আবির্ভাব, অরাজনৈতিক পরিবেশের জন্ম। অনেকের ধারণা গরবাচেভ যদি চীনের মত রাজনৈতিক পুনর্গঠনের পরিবর্তে অর্থনৈতিক পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করতেন ফলাফল অন্য রকম হত। এটা ঠিক যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দেবার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তি নড়ে ওঠে, দেখা দেয় রাজনৈতিক শূন্যতা। এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক রিফর্ম মুখ থুবড়ে পড়ে অথবা তাকে সাবোটেজ করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা হয়। তবে আসল কথা হল একদলীয় শাসনই সোভিয়েত ইউনিয়নে বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দিয়েছে আর পার্টিকেও করে তুলেছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র। তাই পরবর্তী পর্যায়ে যদি সোভিয়েত টাইপ কোন সমাজ গড়ার প্রচেষ্টা নেওয়া হয় এক দলীয় শাসনের ব্যাপারটা বিশেষ ভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নকে রুখতে গিয়ে পুঁজিবাদী বিশ্ব নিজেদের আভ্যন্তরীণ অবস্থার পরিবর্তন করতে, সমাজতন্ত্র না হলেও অনেক সামাজিক সংস্কার করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিশ্ব কিছুটা হলেও সমাজতন্ত্রের দিকে এগোয়। অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে রাশিয়াও পুঁজিবাদী পথে চলতে শুরু করেছে যদিও এখনও পর্যন্ত সামাজিক রাষ্ট্রের অনেক কিছুই রয়ে গেছে। যদি নব্বইয়ের দশকে আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার শিল্প ধ্বংস না করে তার অর্থনীতি গড়ে তুলতে সাহায্য করত, আমার বিশ্বাস আজকে আবার নতুন করে ঠাণ্ডা যুদ্ধ শুরু হত না, বিশ্বে বিভিন্ন ধরণের ধর্মীয় মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠত না।

আজ সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, নেই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাশিয়া। কিন্তু এত কিছুর পরেও পুঁজিবাদী রাশিয়া পশ্চিমের বন্ধু হতে পারেনি। এদেশের মানুষ এক সময় ভেবেছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপান আর জার্মানিকে যেভাবে সাহায্য করেছিল, আমেরিকা রাশিয়াকেও সেভাবেই সাহায্য করবে। এমনকি রাশিয়ার যে সংবিধান সেটা আমেরিকান স্টাইলেই লেখা হয়েছিল। তারপরেও শেষ রক্ষা হয়নি। পাকিস্তানের যেমন নিজের অস্তিত্বের জন্য শত্রু হিসেবে ভারত থাকা দরকার, আমেরিকারও তেমনি দরকার শত্রু – সেটা সোভিয়েত ইউনিয়ন হোক, চীন হোক, রাশিয়া হোক। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় রাশিয়াই সবচেয়ে কম্ফারটেবল, অন্তত সেক্ষেত্রে অনেক সহযোগী পাওয়া যায়, বিশেষ করে ইউরোপ, সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দেশগুলো আর কিছু কিছু এক্স সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র, বিশেষ করে যারা রুশ বিরোধিতাই তাদের জাতীয় আদর্শ মনে করে। তবে সে কথা এখন থাক। শত হলেও আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে কথা বলছি।

এই তো সেদিন টোকিও অলিম্পিক শেষ হল। বন্ধু সুমিত অলিম্পিকের পদক তালিকা দিল। এবার রাশিয়া স্বর্ণ পদকে পঞ্চম আর মোট পদক সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় স্থান পেয়েছে। আর সেটাও প্রচুর চাপের মধ্যে থেকে, কোন কোন ক্ষেত্রে বাজে বিচারের শিকার হয়ে। তবে যেটা লক্ষ্য করার মত তা হল, সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোর  মোট পদক সংখ্যা অন্যদের ছাড়িয়ে গেছে। একটা দেশ তিরিশ বছর নেই, তবে তারা যে ইনফ্রাস্ট্রাকচার, বিশেষ করে খেলাধুলার ক্ষেত্রে, গড়ে দিয়ে গিয়েছিল, সেটা আজও কাজ করছে, কাজ করেছে ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রতিবারই। এর সাথে যদি সেসব খেলোয়াড় এই ভূখণ্ড ছেড়ে অন্য দেশের হয়ে লড়াই করছে তাদের পদক যোগ করা হয়, ফারাক আরও বাড়বে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল সমালোচনা ছিল বাক স্বাধীনতার অভাব, ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা। বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা কী দেখি? হ্যাঁ, ভিন্ন মতের প্রতি  অসহিষ্ণুতা। সেটা যেমন নিজেদের দেশে তেমনি অন্য দেশে। যার ফলে মিসাইল ভরা জাহাজ আর ফাইটার বিমান ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। আবার নিজেদের স্বার্থে এরাই বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক দেশকে দিব্যি সার্টিফিকেট দিচ্ছে গণতন্ত্রের। সোভিয়েত সমাজের মতই এখন বিভিন্ন দেশে বিরোধীদের নামে শুধু অভিযোগই আনা হচ্ছে না, তাদের অপরাধী বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। বর্তমানে আমেরিকার পাবলিক ও প্রাইভেট কারাগারে যত বন্দী সোভিয়েত গুলাগেও সেটা ছিল না। বড় বড় মিডিয়া গ্রুপ নিজেদের ইচ্ছেমত সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করছে। খুব ভাল করে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে সোভিয়েত সমাজের সবচেয়ে খারাপ দিকগুলো এখন পশ্চিমা বিশ্বে অনুকুল পরিবেশে বিস্তার লাভ করছে ঠিক যেমন করে রাশিয়ায় ডালপালা মেলছে পশ্চিমের দুর্বৃত্ত পুঁজিবাদ।

সেই দেশ আজ নেই, তবে সে বেঁচে আছে হাজার মানুষের অন্তরে, বিশেষ করে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যারা এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে লেখাপড়া করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যেসব দেশ উপনিবেশিক শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন বেঁচে সেসব দেশের মানুষের হৃদয়ে। সোভিয়েত বিস্তারকে রোধ করার জন্য পুঁজিবাদী বিশ্ব তাদের শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি করতে বাধ্য হয়েছে। সমাজতন্ত্রের আদলে গড়ে উঠেছে ওয়েলফেয়ার স্টেট। এসবও আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা। আর আছে স্পুটনিক, গ্যাগারিন আরও কত কী!

গত শতকের নব্বুইয়ের দশকে মস্কোয় একটা চুটকি চালু ছিল

অক্টোবর বিপ্লবের সময় রাস্তায় শোরগোল শুনে এক অভিজাত বৃদ্ধা তার পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করলেন
– মাশা, দেখ তো বাইরে এত হৈচৈ করে কারা? ওরা কী চায়?
– এরা এ দেশের শ্রমিক কৃষক। ওরা চায় সব মানুষ সমান হোক।
–  আমরাও তো সেটাই চাই। আমরাও চাই ওদেরও আমাদের মত ঘরবাড়ি থাক। আমাদের মতই স্বাচ্ছন্দ্য থাকুক ওদের ঘরে ঘরে। কিন্তু এভাবে ভাংচুর করে সবাইকে গরীব বানিয়ে ওদের কী লাভ?

আমরাও যেন সব ছোট গাছে জল ঢেলে ওদের বড় করে সাম্য আনি, বড় বড় গাছগুলো কেটে নয়। ওয়েলফেয়ার স্টেটগুলো অন্তত সমাজের নীচু তলার মানুষকে উপরে আনার চেষ্টা করছে যদিও সবাইকে সমান করা তাদের এজেন্ডায় নেই। আমরা ওদের কাছ থেকে হয়তো পথ নির্দেশ পেতে পারি।

সমাপ্ত

পড়ুনঃ আগস্টের দিনগুলি (২য় পর্ব) – তিরিশ বছর পর

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া

মস্কো, ১৫ – ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৯১
দুবনা, ১১ – ১৬ আগস্ট ২০২১