মতামত

আগস্টের দিনগুলি (২)– তিরিশ বছর পর

– বিজন সাহা

অনেকে শুধু  পেরেস্ত্রোইকার খারাপ দিকগুলোই দেখেন, দেখেন সোভিয়েত সমাজে পশ্চিমা সংস্কৃতির দ্রুত বিকাশ। অনেক বন্ধুকে দেখি এ নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি করতে যেন পশ্চিম থেকে শুধুই পর্ণ পত্রিকা আর গুণ্ডামির আগমন ঘটেছে এদেশে। আগে কি এখানে মাফিয়া ছিল  না? নিশ্চয়ই ছিল। আর তার সাথে যুক্ত ছিল পার্টির এলিট আর আমলারা। এখন সেটাতেই গণতন্ত্র এসেছে। সমাজের সাধারণ মানুষের এক অংশ জড়িয়েছে এই চক্রে। কিছু লোকের প্রকাশ্যে ক্যুর সমর্থন করতে দেখে, অনেককে উৎসবের আমেজে রাস্তায় নেমে ছবি তুলতে দেখে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম মনে মনে। মানুষের প্রতি অবিশ্বাস গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল।  কিন্তু ঘরে ফিরে একটু গভীরভাবে চিন্তা করতেই সেটা কাটল। নিষেধ উপেক্ষা করে এই যে হাজার হাজার মানুষের রাস্তায় নেমে আসা, তা সে ছবি তুলতেই হোক, বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদেই হোক অথবা সমর্থনেই হোক, সেটা কি কিছু নয়? পাঁচ বছর আগে এটা কি ভাবা যেত? বিষয়বস্তু নয় আকার, মানে আইন অমান্য করে মানুষের এই পথে নামাই জানিয়ে দিয়ে গেল এ রাশিয়া সেই রাশিয়া নয়। এখনকার মানুষ শুধু মুখ বন্ধ করে আদেশ মেনেই চলে না, তা অমান্যও করে, কেউ কেউ সেটা রুখেও দাঁড়ায়।

প্রায় অনাহারে কাটিয়ে দিনের শেষে  যখন ঘরে ফিরলাম, ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে শরীর। এমন সময় শুভ, মানে শুভঙ্কর এলো। বলল বেলি দম ঘিরে পাহারা দেবে হাজার হাজার মানুষ। ও যাচ্ছে। আমি যাব কি না জানতে চাইল। রাজি হয়ে গেলাম সাথে সাথেই। কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। এগর ওঘর থেকে কিছু আলু পেঁয়াজ জোগাড় করে রান্না চাপাল শুভ। খাওয়া শেষে রাত এগারোটা প্রায় বাজলো। এর মধ্যে কারফিউ জারী হল মস্কো শহরে। শুভ’র সাংবাদিকের পাস ছিল, কিন্তু আমার ওসব কিছুই ছিল না। একটু ভেবে তাই না যাওয়াটাই ঠিক করলাম। শেষ পর্যন্ত শুভও অবশ্য যেতে পারেনি যানবাহনের অভাবে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গল শুভ’র ডাকে। বলল, রাতে গোলাগুলি হয়েছে। গুলিতে আর ট্যাঙ্কের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে বেশ কয়েকজন (পরে জেনেছি চার জন)। এই প্রথম নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় বোধ করলাম। গতকাল তিল তিল করে যে আশা জাগিয়ে তুলেছিলাম এই ক্যুর ক্ষনস্থায়ীত্ব সম্পর্কে, রক্ত ঝরার ঘটনায় সে আশা, সে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। মনে হল এ দানব সহজে বিদায় নেবে না। আরও রক্ত চাই তার, চাই আরও আরও তাজা প্রাণ। প্রথমেই যে কথাটা মাথায় এলো তা হচ্ছে, আর এ দেশে থাকা নয়, মাথায় থাক পি এইচ ডি ডিগ্রী। এবার বাড়ি ফিরতে হয়। শত উদ্বেগ, শত আশঙ্কার মধ্যেও ঠিক করলাম, বেলি দমে যাবই যাব, তা সে যত কষ্টের, যত ঝুঁকিরই হোক না কেন।

ঘরে বসে চা খাচ্ছি আর অপেক্ষা করছি কখন বারোটা বাজবে। গতকালের অভিজ্ঞতা থেকে ঠিক করেছি না খেয়ে আর নয়। আমাদের ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিন বারোটায় খোলে, তাই এই অপেক্ষা। এমন সময় এলো আমার ক্লাসমেট লেভ।  এক মুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ও আরও বিষণ্ণ, আরও হতাশাগ্রস্ত। গত রাতটা ওরা কাটিয়েছে বেলি দমের চত্বরে। ওর মুখে শুনলাম গত রাতের বর্ণনা। কিছু কথা আছে যা বুঝিয়ে বলা যায় না। সেগুলো হয়তো সম্পূর্ণ বাক্যও নয়, হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা দু’ চারটে শব্দমাত্র।  কিন্তু এই দু’ চারটে শব্দও কখনও কখনও পুরো কাহিনী হয়ে হাজির হয় শ্রোতার সামনে, সমস্ত ইন্দ্রিয়কে গ্রাস করে শ্রোতাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোন সে কল্পলোকে। ধূসর, বিষণ্ণ আকাশ। সে বিষণ্ণতার আড়ালে মুখ লুকিয়েছে চাঁদ। তারারা নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। আর সে জল আকাশের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টি হয়ে। এই হাতাশা, এই বিষণ্ণতা, এই তারাদের চোখের জলের পটভূমিতে বেলি দমকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে একদল মানুষ। হতাশ, বিষণ্ণ, কিংকর্তব্যবিমুঢ় মানুষ। ইঁট, কাঠ, পাথরের তৈরি ব্যারিকেডের ওধারে সারি সারি ট্যাঙ্কের বহর। এ যেন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে একদল  মানুষরূপী পাগল। কি এক নেশার টানে নিরস্ত্র দাঁড়িয়ে ট্যাঙ্কের মুখোমুখি। নতুন দিনের অপেক্ষায় নয়, ভোরের সূর্যের অপেক্ষায় নয়, রাতের অন্ধকারে ভয়ঙ্কর মৃত্যুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে সবাই। কথা শেষ না করেই উঠে গেল লেভ।

ঘরে থাকতেই খবর পেলাম সৈন্যবাহিনীর একাংশের ইয়েলৎসিনের পক্ষাবলম্বনের কথা। কিছুক্ষণ পরে ভয়েজ অফ অ্যামেরিকা খবর দিল ইনায়েভ অ্যান্ড কোং এর পালিয়ে যাবার চেষ্টার কথা। এরই মধ্যে চলে এলো শুভ আর ভ্যালেরা। ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বেলি দমের উদ্দেশ্যে। পথে দেখালাম ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ির বহর সারি বেঁধে ফিরে যাচ্ছে নিজেদের আস্তানায়। বেলি দমের চত্বর লোকে লোকারণ্য। পশ্চিমাকাশে এক খণ্ড কালো মেঘের নীচ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে বিজয়ের সূর্য।  সেই সূর্যের সোনালী আলো ধুয়ে দিচ্ছে বেলি দমের চুড়া আর মস্কো নদীর বুক। বাবাকে মনে পড়লো। মনে পড়লো ছোটবেলায় বাবার এনে দেওয়া সেই গ্লোবের কথা আর তার উপরের দিকে প্রায় পুরোটা জুড়ে লালচে বেগুনী রাশিয়ার মানচিত্র। বাঁধভাঙ্গা জলের মত হু হু করে ছুটে এলো এদেশের স্মৃতি। হায়রে রাশিয়া! হৃদয় যেন তার এক সজারুর দেহ। নানা মত নানা পথ সজারুর কাঁটা  হয়ে খুঁজে ফেরে আলো। কিন্তু সবারই যে মাথায় বসে কালো বাদুড়। কালো ডানা মেলে ঢেকে রাখে আলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাসের বিষে তাতে ধরেছে ফাটল, ঠিক বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তরে গহ্বরের মত, তা দিয়ে আসছে ধেয়ে শক্তি ভীষণ, বুকের উপর চেপে বসা সাম্যবাদী ভূতের পাপিষ্ঠ জীবন নাশ করবে বলে। ঐ আলোটুকুও ওরা বন্ধ করতে চায়, ট্যাঙ্কের গোলা আর মানুষের রক্তে একাকার কালো পর্দায় ঢাকতে চায় ঐ সামান্য পথটুকুও। তা কী হতে দেওয়া যায়? মানুষ কী তা হতে দিতে পারে? তাই বেলি দম ঘিরে গড়ে ওঠে ব্যারিকেড। ইট, কাঠ, গাড়ি ঘোড়ার প্রতীকী খাঁচাকে ঘিরে থাকে লক্ষ মানুষের ভালোবাসা আর ভাললাগা। চীনের প্রাচীর হয়ে সেখানে দাঁড়ায় কোটি কোটি প্রাণ। সাধ্য কি ইনায়েভ, পুগো, ইয়াজব, ক্রুচকভ আর পার্টি এলিটদের এ বাধা অতিক্রম করার? এ বাঁধ ভালবাসার বাঁধ, দানবের হাত থেকে মানুষকে, জীবনকে আর আলোকে রক্ষা করার বাঁধ।

আমি উনসত্তরের গণআন্দোলন দেখিনি। খুব ছোট ছিলাম তখন। মনে আছে সে দিনগুলোতে গতানুগতিক জায়গার পরিবর্তে বাজার লাগত বৈরাগীর ভিটায়। আমরা বন্ধুরা, যাদের বয়স ছিল চার পাঁচ বছরের মত, দল বেঁধে যেতাম সেই নতুন বাজারে। দেখি ৯০ এর এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলন আর বিজয় মিছিল। কিন্তু ১৯৯১ এ মস্কোর বুকে বিজয়ী জনতাকে দেখলাম। মুহুর্মুহু উল্লাস ধ্বনি কাঁপিয়ে দিচ্ছিল ইউক্রাইন হোটেলের পেছনে ঝুলে থাকা কালো মেঘ, তুফান উঠেছিল মস্কো নদীর শান্ত বুকেও। এই প্রথম মানুষ বুঝেছিল কোন কুতুজভ, চাপায়েভ বা ঝুকভ নয়, এ বিজয়ের নায়ক তারা নিজেরা। এতদিন এ দেশের রাজনীতি আর সামাজিক জীবনের সর্বত্র ভিড় করে ছিল পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষেরা। এই প্রথম তাদের সাথে কাঁধ মিলালো, এমন কি তাদের ছাড়িয়েও গেল রাস্তার রকার, হোলিগানসহ সোভিয়েত যুবসমাজ।

অনেকে এ বিজয়ে সোভিয়েত মানুষের চেয়ে আর্মির ভাঙ্গনটাকে বড় করে দেখেন। লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা ঝিরিনভস্কি, যিনি ক্যুর সমর্থক ছিলেন, দাবী করেন, নির্বাচন দিলে ৭০% মানুষ গে কা চে পে সমর্থন করবে। অনেকে বেলি দম রক্ষায় এগিয়ে আসা জনতার ভিড়ে উঠতি পুঁজিপতিদের কালো টাকা আর মদের ফোয়ারা দেখতে পান। কেউ দেখে অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ, জার্মান চ্যান্সেলর কোল বা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মেজরের কালো হাত। সব কিছুর পরেও যেটা সত্য সেটা হল সামরিক জান্তার পতন আর গণতন্ত্রের বিজয়। যে জন্যে ঝরেছে অনেক তাজা প্রাণ। গে কে চে পের বিজয়ে ভবিষ্যতে প্রচণ্ড নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হবে জেনেও মস্কো, লেনিনগ্রাদসহ দেশের অনেক শহরে নেমেছে লাখ লাখ মানুষ, খনি শ্রমিকেরা গেছে ধর্মঘটে। আর্মিতে যে ফাটল ধরেছে সেটাও সাধারণ মানুষের গে কা চে পেকে প্রত্যাখ্যান করার ফলেই। শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ গে কা চে পে সমর্থন করবে বলে যে দাবী উঠেছিল, সেটা হতে পারলেও হয়নি। লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মত জাতীয়তাবাদী সংগঠন আর কমিউনিস্ট পার্টি ঘেঁষা সংগঠন বাদে কেউই গে কা চে পে সমর্থন করেনি, এমন কি কমিউনিস্ট পার্টিও নয়, যদিও তারা ভেতরে ভেতরে জড়িত ছিল ক্ষমতা দখলের এই লড়াইয়ে। বুশ, মেজর, কোল যাই করুন না কেন, করেছে প্রচলিত বিশ্ব রীতিনীতির আওতায় এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই। আর বেলি দম রক্ষায় সবার আগে যে ছুটবে উঠতি পুঁজিপতিরা সেতো স্বাভাবিক। এখন পর্যন্ত দেশের পরিবর্তনে তারাই তো সবচেয়ে লাভবান। তবে বেলি দম রক্ষায় শ্রমিক, বেকার, যুবক, বৃদ্ধ – এদের উপস্থিতিও কম ছিল না।  আর পয়সা বা মদের ব্যাপারে অনেকে যেটা বলেন, তাদের বলা যায়, এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় টোপটা ফেলেছিল ইনায়েভরাই। রাতারাতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম কমানো, বেতন বাড়ানোসহ বিভিন্ন লোভনীয় ঘোষণা এসেছিল তাদের কাছ থেকেই। তারপরেও মানুষ গেছে ইয়েলৎসিনের পেছেনে। বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। আর্মির বিভাজন, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন – এসবই এ বিজয়ের ভাগীদার। তবে এ বিজয়ের মুলে ছিল ইয়েলৎসিন, শেভারনাদজে, ইয়াকভলেভদের সময়োচিত সঠিক নেতৃত্ব আর ইয়েলৎসিন ও গণতন্ত্রের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন।

আবার ফেরা যাক  বেলি দমে। শুভ, ভ্যালেরা আর আমি ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছি। তিন জনের ক্যামেরায় স্থির হয়ে আছে অনেকের মুখের অভিব্যক্তি। থেকে থেকে হৈচৈ করে উঠছে জনতা। এখানে শোনা যায় ইনায়েভদের গ্রেফতার করা হয়েছে, ওদিকে কেউ বলে এক্ষুনি গরবাচেভ আসবেন এখানে। এভাবেই মানুষ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে। তাদের সামনে পেছনে স্টিল আর মুভি ক্যামেরা হাতে ছুটছে দেশ বিদেশের সাংবাদিকদের দল। জনস্রোতে আসে জোয়ার। প্রায় তিন ঘণ্টা এদিক ওদিক ছোটাছুটির পর সত্যিই  হাঁপিয়ে উঠলাম। শুধু চলার ক্লান্তিতেই নয়, ইনফরমেশন গ্যাপেও। মনে পড়লো লেভের কথা। এ যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সারা পৃথিবীর সমস্ত সংবাদের শিরোনামে যে ভূমি, যে উত্তাল জনসমুদ্র, তারাই সব খবর থেকে বিচ্ছিন্ন। শুধু কিছু গুজব আর রুশ সোভিয়েতের সেশনের ধারাবিবরণী থেকে ভেসে আসা কিছু কথা ছাড়া আর কোন খবর নেই। কি হল গরবাচেভের, কি হল ইনায়েভের – এ প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছিল না কেউ। আমি তাই শুভ আর ভ্যালেরাকে বললাম, “এভাবে আর কতক্ষন? আমি বরং ঘরে ফিরে বিবিসি শুনব। তোমরা যাবে?” “আর মিনিট পনের দেখি।” বলল শুভ। এর মধ্যেই সূর্যটা হেলে পড়েছে। অনেকে পা বাড়িয়েছে  বাড়ির দিকে। বিজয়ের আনন্দে উৎফুল্ল কেউ কেউ সরাচ্ছে ব্যারিকেড। এমন সময় বেলি দম থেকে আহ্বান এলো সবাই যেন চলে না যায়। আরও একটা রাত যেন মানুষ কাটিয়ে যায় এ চত্বরে। এখনও আশঙ্কা আছে ইউক্রাইন হোটেলের দিক থেকে স্পেশাল বাহিনী আক্রমন চালাতে পারে বেলি দমে। মানুষের মধ্যে আবার চাঞ্চল্য। বিভিন্ন ব্রিগেডে  নাম লিখিয়ে ফেলল অনেকেই। তারা বিভিন্ন রাস্তা রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়ে চলে গেল নির্দিষ্ট স্থানে। তাদের চোখে মুখে দৃঢ়তার ছাপ, আগামী কালের সূর্যকে স্বাগত জানানোর সংকল্প।

অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলাম টিভির সামনে। শুনাম বিবিসির খবর। শেষ পর্যন্ত অবশ্য গরবাচেভের ফেরা না দেখেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ২২ আগস্ট ঘুম থেকে উঠেই টিভি চালিয়ে বসে রইলাম খবরের অপেক্ষায়। ১২ টার দিকে মিটিং শুরু হবে বেলি দমের সামনে। এদিকে আমাকে আবার দুটোর সময় দেখা করতে হবে সুপারভাইজারের সাথে। তাই মিটিং এ আর যাওয়া হল না। টিভির সামনেই ঠায় বসে রইলাম। সভার শুরুতেই রুশ সোভিয়েতের চূড়ায়  ওড়ানো হল তিনরঙ্গা রাশান পতাকা। ইয়েলৎসিন আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন সবাইকে। বেলি দমের সামনের চত্বরের নামকরণ করা হল “স্বাধীন রাশিয়া চত্বর।” মস্কোর মেয়র পপভ ইয়েলৎসিনকে মিনিন ও পঝারস্কির মতই মস্কোর সম্মানিত নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করলেন। বক্তব্য রাখলেন আলেক্সাদার ইয়াকভলেভ, এদুয়ারদ শেভারনাদজেসহ অনেকেই। প্রায় এক মিলিওন মানুষের বিজয়োল্লাসে মুখরিত হল মস্কোর আকাশ বাতাস।

এরপরই শুরু নতুন নাটকের। ইয়াকভলেভ যেমন বলেছিলেন, “এখন প্রচুর বীর জন্ম নেবে। আমাদের সতর্ক হতে হবে।” ঠিকই তাই। নিত্যদিন বীরেরা জন্মাতে লাগলো। মস্কো, লেনিনগ্রাদসহ বিভিন্ন শহরে ভেঙ্গে পড়তে লাগল কমিউনিস্ট নেতাদের স্ট্যাচু, ভেঙ্গে পড়তে লাগল সোভিয়েত ইউনিয়নও। মানুষ স্বাধীনতা চাইলে দেশ স্বাধীন হবেই, এক্ষেত্রে বলার কিছুই নেই, যদিও মন থেকেই চাইছিলাম শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখতে। তবে স্ট্যাচু ভাঙ্গার ব্যাপারটা অত ভাল চোখে দেখতে পারি না। ভালো হোক, মন্দ হোক এরা সময়ের সাক্ষী, ইতিহাসের অংশ। ইতিহাস তো কাগজের উপর পেন্সিলের লেখা নয় যে রাবার দিয়ে ঘষে তুলে দেওয়া যাবে। তাছাড়া আপাতদৃষ্টিতে বিপ্লবী বলে মনে হলেও এ সবই নাশকতামূলক কাজ। গণতন্ত্রীদের মনে রাখতে হবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অজুহাতেই ক্যু হয়েছিল এবং অনেক মানুষ মনে মনে তাকে সমর্থনও জানিয়েছিল অন্তত আইন শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এই আশায়। স্ট্যাচু ভাঙ্গার মত কাজকে অথবা পার্টি অফিস ভাঙচুর করার মত ক্রিয়াকলাপকে বরদাস্ত করলে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে। যারা সুযোগসন্ধানী তারা এ সুযোগটা নিতেও পারে। মানুষ কিন্তু ধ্বংসের জন্য লড়াই করেনি, লড়াই করেছিল নতুন কিছু সৃষ্টির জন্যে। মানুষের এ লড়াকু মনোভাবকে সৃষ্টির কাজে যত বেশি লাগান যাবে, ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ততই নিষ্কণ্টক হবে।

চলবে . . .

পড়ুনঃ আগস্টের দিনগুলি (১)– তিরিশ বছর পর

পরবর্তী এবং শেষ পর্ব ২৬ আগস্ট ২০২১ প্রকাশ করা হবে

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া