শিল্প সাহিত্য

“বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলে তার প্রতিচ্ছায়া দেখা যায় না”

– সাবিনা পারভীন লীনা

“আজ আমি
নিজের ঘরের ঠিকানা মুছে দিয়েছি
আর গলির মাথায় ঝুলানো
গলির নামের সাইনবোর্ড ফেলে দিয়েছি
প্রতিটি সড়কের মাথায় লাগানো
নামগুলোও মুছে দিয়েছি
যদি তুমি আমার ঠিকানা পেতে চাও
তাহলে প্রতিটি দেশের, প্রতিটি শহরের
প্রতিটি গলিতে আমাকে খোঁজ করো
এ এক অভিশাপ, আবার বরপ্রাপ্তিও!
আর যেদিকে তোমার মুক্ত হৃদয়ের
ঝলক পড়বে মনে রেখো সেটাই আমার ঘর।
 
#এই কবিতা পাঞ্জাবি সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র,বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ভারতীয় কবি অমৃতা প্রীতমের।অন্যান্য নারীর মতো দুর্বিনীত নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ না করে সারাজীবন নিজের ইচ্ছেনুযায়ী বেঁচেছেন।ভালোবেসেছেন,বিদ্রোহ করেছেন,পুরুষের প্রেমে নিমগ্ন হয়েছেন আবার পুরুষের অধিকারের সীমাটিও সচেতনভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন।প্রেম, প্রগতি আর বিদ্রোহের এক  অনন্য স্বাক্ষর রেখেছেন কবিতায় উপন্যাসে আর প্রবন্ধে।
 
ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতবর্ষের পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালা গ্রামে ১৯১৯ সালের ৩১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন অমৃতা প্রীতম, মূল নাম অমৃতা কৌর।বাবা করতার সিং ও মা রাজবিবির একমাত্র সন্তান অমৃতা লেখালেখির প্রতি ভালোবাসাটা বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন।বাবা ছিলেন শিক্ষক, কবি।প্রচলিত নিয়ম কানুনকে প্রশ্ন করা আর পুরানোকে ভেঙে নতুনকে গড়ার আহ্বান তার মজ্জাগত ছিল।ছোটবেলায় হিন্দু মুসলমানদের আপ্যায়নে আলাদা আলাদা কাপ- পিরিচ,থালা ব্যবহার করতে দেখেছেন দাদীকে।সেই বয়স থেকেই মানুষের প্রতি এমন ব্যবহারকে ঘৃণা করতেন তিনি। 
 
এগারো বছর বয়সে মাকে হারিয়ে বাবার সাথে লাহোর চলে যান।খুব অল্প  বয়সে তার মধ্যে লিখন শৈলীর স্ফুরণ ঘটেছিল। তার প্রথম কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে ‘অমৃত লেহরে’ নামে।ষোলো বছর বয়সে তার বিয়ে হয় বাল্যকালে পরিবারের ঠিক করা বাগদত্তা প্রীতম সিং এর সাথে। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাধারণ মানুষের দূর্গতি ও তাদের অধিকার নিয়ে লিখতে শুরু করেন।কবিতাই ছিল তার প্রতিবাদের অস্ত্র।
 
“রাত বেড়ে চলছে.
কেউ যেন মানুষের বুকে
সিঁধ কাটছে চুরি করবে বলে
সকল চুরির চেয়েও ভয়ানক
কারো স্বপ্নকে চুরি করা…”
 
১৯৩৬ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে অমৃতা প্রীতমের ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
প্রথমদিকে অমৃতা শুধু প্রেমের কবিতা লিখেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি প্রগতিশীল লেখকদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি অমৃতা সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন।৪৭ এর দেশভাগের সময় ভাঙা মন নিয়ে শরণার্থী হয়ে লাহোর থেকে দিল্লিতে চলে আসেন।মৃত্যু আর ঘৃণার পৃথিবীতে পুণরায় প্রেম আর জীবনের জয়গানে নিজেকে সঁপে দিলেন। ১৯৪৮ সালে লিখলেন সেরা কবিতা ‘আজ আখ খা ওয়ারিশ শাহ নু’। আঠারো শতকের বিখ্যাত সুফি কবি ওয়ারিশ শাহ্ কে তিনি কবিতায় পাঞ্জাবের ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখে যেতে বলেছেন।
 
পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া বিয়ে নিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে অমৃতা সুখী ছিলেননা। ১৯৪৪ সালে কবিতা পাঠের আসরে পরিচয় হয় সেই সময়ের বিখ্যাত কবি ও গীতিকার সাহির লুধিয়ানভির সাথে। অমৃতা তখন এক সন্তানের জননী।তবুও সাহিরের মতাদর্শ, সৌন্দর্যবোধ,শব্দশৈলী সবকিছু তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। সাহিরের সাথে পত্রালাপ,মাঝেমধ্যে সাক্ষাতের মাধ্যমে দুজনের মধ্যে এক অনিন্দ্য সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।কিন্তু তাদের এই নৈকট্য বেশিদিন স্থায়ী ছিলনা,সাহির চাননি বলে।
 
‘এক মুলাকাত ‘ কবিতায় অমৃতা লিখেছেন —
“আমি এক শূন্য সমুদ্রতীর
নিজেকে লণ্ডভণ্ড করে যেই
শান্ত হলাম—সমুদ্রের ঝড়
সমুদ্রকে ফিরিয়ে দিয়েছি
এখন অবেলায়—এই
অন্ধকারে ফিরে এসে
তুমি উদাস, নিশ্চুপ
অটল দাঁড়িয়ে আছ
আমিও উদাস, নিশ্চুপ
অটল দাঁড়িয়ে আছি
কেবল দূরের সমুদ্রে
ঝড় দেখা যাচ্ছে।”
 
অমৃতা প্রীতম তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘রশিদী টিকিট ‘ এ সাহির লুধিয়ানভি, সাজ্জাদ হায়দার, ইমরোজ এর মতো বন্ধুদের কথা অকপটে লিখে গেছেন।  বলেছেন,কবিতা শুধু প্রেমের তুফান থেকে বেরিয়ে আসে না,বন্ধুত্বের শান্ত জল থেকেও সাঁতরে আসতে পারে।
 
চিত্রশিল্পী ইমরোজের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় অমৃতার পুরস্কারপ্রাপ্ত বই ‘সুনেহরে’ র প্রচ্ছদ ডিজাইনের সময়।তাদের বন্ধুত্বের শুরুতে অমৃতা লিখেছিলেন ‘শাম কা ফুল ‘, যেখানে কিছুটা দেরীতে হলেও দশ বছরের ছোট ইমরোজ এর আগমনের কথা উল্লেখ আছে।তাদের এই সম্পর্কে কোন প্রতিশ্রুতি ছিলনা,কোন প্রশ্নোত্তর ছিলনা,ছিলনা কোন আনুষ্ঠানিক প্রকাশও। জীবনের শেষ চল্লিশটি বছর তারা একে অপরের প্রতি অব্যক্ত ও নিঃশর্ত ভালোবাসায় একসাথে কাটিয়েছেন, বন্ধু হয়ে,আত্মার সঙ্গী হয়ে। ইমরোজ ছিল সেই সব দূর্লভ উদার মানুষদের একজন যে ভালোবাসার অনুরূপ প্রতিদানে বিশ্বাস করতোনা।অমৃতা নিজের জীবন আর লেখনীর মাধ্যমে দেখিয়েছেন যা বুকের উপর পাথর হয়ে চেপে থাকে তাকে উৎখাত করা বাঞ্ছনীয়। জীবনের শেষদিকে বন্ধু ইমরোজ এর উদ্দেশ্যে লেখা কবিতায় বুকের গভীরতর প্রকোষ্ঠে জমে ওঠা অনুভূতি, ব্যাকুল আকুতির অমৃত স্রোত প্রকাশ পায়।দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর  ঘুমের মধ্যে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।তখন তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।অমৃতার মৃত্যুর পর ইমরোজ পরম বন্ধুর মতোই বলেছিলেন,অমৃতার শরীর পৃথিবী ছেড়ে গেছে কিন্তু তার সঙ্গ ছেড়ে যাননি।
 
তার আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ” মে তুঝে ফের মিলুঙ্গি” কবিতার অংশবিশেষ —
“তোমার সঙ্গে আবারও
দেখা হবে, কিন্তু কখন কিভাবে
কিছুই জানা নেই।
হয়তো তোমার কল্পনার
রঙে স্মৃতির ক্যানভাসে
রহস্যময়ী কোনো রেখা হয়ে
স্তব্দ তাকিয়ে থাকবো
তোমার সঙ্গে আবারও
দেখা হবে, কখন কিভাবে
কিছুই জানা নেই “
 
অমৃতা লিখেছেন কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনীর মতো প্রায় ২০০ টি গ্রন্থ।  ১৯৫৬ সালে পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, এছাড়াও পেয়েছেন পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ উপাধি,দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জবলপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ব ভারতী থেকে ডি, লিট ডিগ্রি। 
 
অমৃতা প্রীতমের সাহিত্যকর্ম এমন এক সময়ের স্মারক আজ অবধি যে সময়ের কোন পরিবর্তন হয়নি। দৃশ্য-অদৃশ্য নানা  লক্ষনরেখার জালে আটকে আছে নারীর জীবন। ধর্মের নামে হানাহানি আর বিভেদের দেয়ালে মানবতার চরম বিপর্যয় ঘটে চলেছে দেশে দেশে।  তাই আমাদের যেতে হবে তার সাহিত্যের কাছে,স্রোতের বিপরীতে গিয়ে জীবনের জয়গান গাইতে।