চলমান সংবাদ

তালেবান: আফগানিস্তানে কীভাবে বহু বছর ধরে, তিলে তিলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পরাজয়’ হলো

 

হেরাত শহরে তালেবান যোদ্ধারা
হেরাত শহরে তালেবান যোদ্ধারা

আফগানিস্তানে তালেবানের অগ্রাভিযানের খবর যারা টিভিতে দেখছেন, পত্রিকায় পড়ছেন – তাদের অনেকের কাছে মনে হতে ব্যাপারটা যেন আকস্মিক – কীভাবে যেন চোখের পলকে সবকিছু ঘটে গেল।

এক বিধ্বংসী সামরিক অভিযানে ২০০১ সালে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানের সামরিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেটো মিত্ররা। কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টে গেছে।

জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে রাতের অন্ধকারে – প্রায় চুপিসারে – যখন মার্কিন সৈন্যদের শেষ দলটি কাবুলের নিকটবর্তী বাগরাম বিমানঘাঁটি ত্যাগ করে – তার মাত্র ৬ সপ্তাহ পার হতে না হতেই আফগানিস্তানের দুই তৃতীয়াংশ দখল করে করে নিয়েছে তালেবান।

দশটি প্রাদেশিক রাজধানী ইতোমধ্যেই তালেবানের দখলে চলে গেছে – তার সাথে যোগ হয়েছে হেরাত ও কান্দাহারের মত গুরুত্বপূর্ণ শহর।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, আফগান নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে ভেঙে পড়েছে – তাতে কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কেন্দ্রীয় রাজধানী কাবুলের পতন হতে পারে।

কাবুলের পতনের সম্ভাবনা এখন এত দ্রুত সামনে চলে এসেছে যে সেখান থেকে মার্কিন কূটনীতিক ও নাগরিকদের নিরাপদে তুলে নিয়ে যাবার জন্য ৩,০০০ সৈন্য ‘সাময়িকভাবে’ আফগানিস্তানে পাঠাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন।

শুধু তাই নয়, মার্কিন পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে তাদের দূতাবাসটি বিমানবন্দরের মধ্যে বা কাছে কোথাও সরিয়ে নেয়া যায় কিনা – সে বিকল্পটিও আলোচনা করেছে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসন।

২০০১ সালের ৩১শে অক্টোবার কান্দাহার-হেরাত মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণ করছে তালেবান যোদ্ধারা।
২০০১ সালে কান্দাহার-হেরাত মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণ করছে তালেবান যোদ্ধারা

নিউইয়র্ক টাইমস এক রিপোর্টে জানিয়েছে, তালেবান যেন কাবুলের মার্কিন দূতাবাসে হামলা না চালায় সে জন্য মার্কিন আলোচকরা এর মধ্যেই তালেবানের সাথে যোগাযোগ করেছে।

মার্কিন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা এখন বলছেন যে, ১৯৭৫ সালে যেভাবে ভিয়েতনামের সায়গন থেকে যেভাবে আমেরিকানদেরকে হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল – ২০২১ সালের কাবুলে এখন সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে কিনা, সেটাই অনেকের মনে উঁকি দিচ্ছে।

কাবুলের পতন মানে পরাজয়ের চূড়ান্ত বিন্দু?

আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারকে অনেক বিশ্লেষকই সমর্থন করেছেন। সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলোতে দেখা যায়, মার্কিন জনগণের অধিকাংশের মধ্যেও এর প্রতি সমর্থন আছে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করার পর তালেবানের কিছু নেতা বলেছেন, তারা এ যুদ্ধে জিতেছেন – আমেরিকা হেরে গেছে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ দিনে সায়গনে মার্কিন দূতাবাস ভবনের চত্বর থেকে হেলিকপ্টারে উঠে পালাচ্ছেন দূতাবাস কর্মচারী এবং তদের পরিবারের সদস্যরা, ৩০ এপ্রিল, ১৯৭৫। এসব ছবি এখন সোশ্যালমিডিয়ায় ঘুরছে
ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষ দিনে সায়গনে মার্কিন দূতাবাস ভবনের চত্বর থেকে হেলিকপ্টারে উঠে পালাচ্ছেন দূতাবাস কর্মচারী এবং তদের পরিবারের সদস্যরা, ৩০ এপ্রিল, ১৯৭৫। এসব ছবি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে

অন্য অনেক বিশ্লেষকও একে আমেরিকার ‘পরাজয়’ ও ‘পশ্চাদপসরণ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

তারা বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে এমন এক সময় মার্কিন বাহিনী বিদায় নিচ্ছে যখন তাদের অর্জন হিসেবে দেখানোর কিছুই প্রায় নেই। এটা ঠিক যে আল-কায়েদাকে উৎখাতের কথা বলে এ অভিযান শুরু হয়েছিল – তারা এখন তত শক্তিধর নয়, ওসামা বিন লাদেনও নিহত – কিন্তু তাদের আশ্রয়দাতা তালেবান এখন প্রবলভাবে ফিরে এসেছে।

এখন তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের সম্ভাবনার মুখে মার্কিন রিপাবলিকান সেনেটর মিচ ম্যাককনেল বলেছেন, “বাইডেন প্রশাসনের স্ট্রাটেজি যুক্তরাষ্ট্রকে এক লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলবে। “

তার কথায় – “প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে ১৯৭৫ সালের সায়গনের অপমানজনক পতনের চাইতেও খারাপ অবস্থায় নিযে যাচ্ছে।”

অনেকেই এটাও বলতে শুরু করেছেন যে প্রত্যাহার নয়, বরং কাবুলকে রক্ষা করতে এখন আবার মার্কিন ও নেটো সৈন্যদের আফগানিস্তানে পাঠানো উচিৎ।

মি. ম্যাককনেল তার বিবৃতিতে বলেছেন, “এখন আফগান সৈন্যদের সাহায্য না করলে আল-কায়েদা ও তালেবান মিলে কাবুলে আমাদের দূতাবাস পুড়িয়ে দিয়ে এবার ১১ই সেপ্টেম্বরের বার্ষিকী পালন করবে।”

কাবুলে আমেরিকান দূতাবাস চত্বর। আমেরিকান সরকার এখনও বলছে দূতাবাস বন্ধ হবেনা।
কাবুলে আমেরিকান দূতাবাস চত্বর। আমেরিকান সরকার এখনও বলছে দূতাবাস বন্ধ হবেনা।

দু’দশকব্যাপি এই আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারি হিসেবমতে ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় করেছে, এতে নিহত হয়েছে তাদের ২,৩১২ জন সৈন্য, জখম হয়েছে ২০ হাজারের বেশি, আফগান সৈন্য ও পুলিশ নিহত হয়েছে আনুমানিক ৬৪,০০০ – আর আফগান বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে অন্তত ১১১,০০০।

তাই কাবুলের পতনকে এখন অনেকে দেখতে চাইবেন আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রয়াসের পরাজয়ের চরম মুহূর্ত হিসেবে।

কিন্তু কীভাবে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো?

‘বহু বছর ধরে, একটু একটু করে আফগানিস্তানে হেরেছে যুক্তরাষ্ট্র’

ঘটনাপ্রবাহ দেখে মার্কিন বিশ্লেষকরাও এখন বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ‘পরাজয়’ আসলে আকস্মিক কিছু নয়, এটা ঘটেছে বহু বছর ধরে – একটু একটু করে।

মার্কিন সাংবাদিক ও বিশ্লেষক ফরিদ জাকারিয়া শুক্রবারই সিএনএন-এ এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তালেবানের এই পুনরুত্থান আকস্মিক নয়, বরং গত ১০-১৫ বছর ধরেই তালেবানের ধীরে ধীরে শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছিল।

কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে আফগান সেনা পাহারা। আমেরিকান নাগরিকদের দ্রুত সরিয়ে নিতে সাহায্য করতে এখানে ৩০০০ মার্কিন সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পেন্টাগন
কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে আফগান সেনা পাহারা। আমেরিকান নাগরিকদের দ্রুত সরিয়ে নিতে সাহায্য করতে এখানে ৩০০০ মার্কিন সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পেন্টাগন

আফগানিস্তানে ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হওয়া মার্কিন বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তালেবানের পতনের পর কাবুলে অনেক তরুণের দাড়ি কামিয়ে ফেলার দৃশ্য টিভির পর্দায় দেখানো হয়েছিল।

কিন্তু আসলে তালেবান কখনোই সম্পূর্ণ পরাজিত হয়নি।

আফগানিস্তানে বিপুল পরিমাণ বিদেশি সৈন্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও তালেবান আবারও সংগঠিত হয়ে ক্রমাগত তাদের শক্তি বাড়ায়, আফগানিস্তানের নানা অঞ্চলে আবার তাদের প্রভাব বিস্তার করে।

আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে তারা বিপজ্জনক করে তুলেছিল এবং তাদের চোরাগোপ্তা বা আত্মঘাতী আক্রমণ, ঘরে তৈরি বোমা বিস্ফোরণ ও সহিংসতা বছরের পর বছর ধরে অব্যাহতভাবেই চলছিল।

কাবুল থেকে আমেরিকানদের সরিয়ে নিতে আসা মার্কিন সৈন্যদের একটি দল
কাবুল থেকে আমেরিকানদের সরিয়ে নিতে আসা মার্কিন সৈন্যদের একটি দল

কাবুলে তারা বহু হামলা চালিয়েছে, এবং ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবান এমনকি নেটো জোটের ক্যাম্প বাস্টিয়ন ঘাঁটিতেও এক বিরাট দুঃসাহসিক অভিযান চালায়।

অন্যদিকে তালেবানের ওপর মার্কিন ও নেটো বাহিনীর অনেক বিমান হামলায় নিহত হয় অসংখ্য বেসামরিক আফগান – যা মার্কিন সামরিক প্রয়াস সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দেয়।

বহু এলাকায় তালেবানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে

তালেবানের প্রাধান্য মূলত কেন্দ্রীভূত ছিল আফগানিস্তানের দক্ষিণে এবং দক্ষিণপশ্চিমে তাদের বরাবরের শক্ত ঘাঁটিগুলোর আশপাশের এলাকায়, এবং উত্তরে হেলমান্দ, কান্দাহার, উরুযগান এবং জাবুল প্রদেশে। এছাড়াও উত্তর-পশ্চিমের ফারিয়াব পর্বতমালা ও উত্তর-পূর্বের বাদাখশান পাহাড়ি এলাকাতেও তাদের প্রাধান্য ছিল বেশি।

বিবিসির ২০১৭ সালে করা এক গবেষণায় দেখা যায় – আফগানিস্তানের বেশ কয়েকটি জেলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে তালেবান।

ঐ গবেষণায় আরও দেখা যায়, দেশের আরও বহু এলাকায় তারা বেশ সক্রিয়, যেখানে কিছু কিছু এলাকায় তার প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি মাসে হামলা চালাতো। তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে আগে যা ধারণা করা হতো, তালেবানের শক্তি তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

আফগানিস্তানের কোন এলাকা কার নিয়ন্ত্রণে

আফগানিস্তানে মাদক ব্যবসার জন্য পপি চাষ হয় এমন বহু এলাকাও তালেবান নিয়ন্ত্রণ করে এবং এ থেকে তাদের প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার আয় হয় বলে ধারণা করা হয়।

আর তালেবানের তৎপরতার পেছনে পাকিস্তানের গোপন সহযোগিতা ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ের অভিযোগ বহু পুরোনো – যদিও পাকিস্তান তা স্বীকার করে না।

মার্কিন ও নেটো সেনাবাহিনী ও আফগান সরকারি বাহিনী কখনোই তালেবানের বিদ্রোহী তৎপরতা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।

মার্কিন সামরিক তৎপরতা ব্যর্থ হচ্ছিল

ওয়াশিংটন পোস্ট দৈনিকে সাংবাদিক-বিশ্লেষক ইশান থারুর লিখেছেন, তালেবানের আক্রমণের মুখে আফগানিস্তান যেভাবে এত দ্রুতগতিতে ভেঙে পড়ছে – তা “যুক্তরাষ্ট্রের এক দীর্ঘ ও ধীরগতির পরাজয়।”

তার মতে, ২০০১ সালে তালেবান যখন ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল – তার পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে এখনই তারা সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে আছে।

তিনি বলছেন, পরিস্থিতি যে এমন হতে পারে তার আভাস অনেক আগেই পাওয়া গিয়েছিল। আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক তৎপরতা এবং দেশ-গঠনের প্রক্রিয়া যে ব্যর্থ হচ্ছে – তা অনেক দিন ধরেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

কান্দাহারে একটি চেকপয়েন্টে আফগান নিরাপত্তা রক্ষীর পাহারা
কান্দাহারে একটি চেকপয়েন্টে আফগান নিরাপত্তা রক্ষীর পাহারা

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক এবং আফগান রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. আসিম ইউসুফজাই বিবিসিকে বলেছেন, আমেরিকানদের কৌশল ছিল আফগানিস্তানের প্রধান শহরগুলোকে কব্জায় রাখা। কিন্তু শহরের বাইরে গ্রাম-গঞ্জ তালেবানের নিয়ন্ত্রণে থেকে গিয়েছিল।

কিন্তু মার্কিন রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব তা স্বীকার করতে চাননি।

ক্রেগ হুইটলকের সেই রিপোর্ট

মার্কিন প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ বহু দলিলপত্রের বয়ান প্রকাশ করে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এক সাড়া জাগানো রিপোর্ট করেছিলেন ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক ক্রেগ হুইটলক।

“আফগানিস্তান পেপার্স: এ সিক্রেট হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার – এ্যাট ওয়ার উইথ দ্য ট্রুথ” শিরোনামের ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তিনি দেখিয়েছিলেন যে মার্কিন কর্মকর্তারা মুখে যতই বলুন না কেন যে তারা আফগানিস্তানের পরিস্থিতির অগ্রগতি ঘটাচ্ছেন – তা আসলে সঠিক ছিল না। ওই কর্মকর্তারাও জানতেন যে কোন অগ্রগতি হচ্ছে না।

ক্রিগ হুইটলক লিখেছিলেন, একের পর এক মার্কিন প্রশাসন এটা স্বীকার করে নিয়েছিল যে তালেবানকে হারানো সহজ হবে না, আফগান রাষ্ট্রটি দুর্বল এবং দুর্নীতিতে ভরা, – তাই কোন সমন্বিত নীতি ছাড়া এগিয়ে যাওয়াটাও “পরাজয় স্বীকার করে নেয়ার চাইতে ভাল।”

হুইটলক ব্যাখ্যা করেছিলেন যে বহু অপ্রকাশিত দলিলপত্র ও সাক্ষাৎকার থেকে এটা বোঝা যায় যে তিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনগুলো দুই দশক ধরে এ সত্যকে লুকিয়ে রেখেছিল।

লড়াইয়ে জেতা সামরিক বাহন হামভির সামনে দাঁড়ানো তালেবানের একদল যোদ্ধা।
লড়াইয়ে জেতা সামরিক বাহন হামভির সামনে দাঁড়ানো তালেবানের একদল যোদ্ধা।

“যে যুদ্ধের প্রতি এক সময় আমেরিকানদের বিপুল সমর্থন ছিল -সে যুদ্ধে তারা ধীরে ধীরে হেরে যাচ্ছিলেন” – হুইটলক বলেন, এটা স্বীকার না করে বরং সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা তাদের ভুলগুলো লুকানোর বিকল্পটিই বেছে নেন, এবং যুদ্ধটিকে হাতছাড়া হয়ে যেতে দেন।

কোন প্রেসিডেন্টই আফগানিস্তানে বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করেননি

ক্রেগ হুইটলক তার রিপোর্টে বলেন, প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ প্রাথমিক সতর্কবাণী ধামাচাপা দিয়ে আফগান যুদ্ধকে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন।

আফগানিস্তানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেখানে সৈন্যসংখা ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছিলেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ওবামা।

তার সময় এক পর্যায়ে মার্কিন সৈন্যসংখ্যা ১১০,০০০ তে উঠেছিল । এর ফলে ২০০৯ সাল নাগাদ তালেবানকে অনেকটা পেছনে ঠেলে দেয়া সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু তাও দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি।

বছরের পর বছর ধরে তালেবান আক্রমণ চলতেই থাকে। সবচেয়ে রক্তাক্ত বছর ছিল ২০১৪ সাল।

সেই বছরই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপস্থিতিতে কাবুলে মার্কিন ও নেটো বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জানানো হয় – আফগানিস্তানে তাদের ‘কমব্যাট মিশন’ বা প্রত্যক্ষ সামরিক তৎপরতা শেষ হচ্ছে, এবং আফগান সেনাবাহিনী ও পুলিশই তাদের দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব হাতে নিচ্ছে। মার্কিন ও নেটো বাহিনী শুধু প্রশিক্ষক ও পরামর্শক হিসেবে থাকবে।

কিন্তু আসলে যুদ্ধের আদৌ কোন সমাপ্তি হয়নি। বরং এ সময় তালেবান কিছু ভূখণ্ড পুনর্দখল করে।

হুইটলকের কথায়, বারাক ওবামা আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ শেষ হবার একটি ‘বিভ্রম’ তৈরি করেছিলেন।

তালেবান নেতৃত্বের কাঠামো

এর পরের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জোর গলায় বিদেশে মার্কিন বাহিনীর ব্যয়বহুল সামরিক কর্মকান্ডে জড়িযে পড়ার অবসানের কথা বলেছিলেন।

কিন্তু তিনিও আফগানিস্তানে মার্কিন বিমান হামলা বাড়িয়ে দেন – যাতে এক জরিপ অনুযায়ী বেসামরিক আফগানদের মৃত্যুর পরিমাণ প্রায় ৩৩০ শতাংশ বেড়ে যায়।

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা আফগানিস্তান থেকে সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তা করেননি।

আফগান সৈন্যরা বিনাযুদ্ধে রণে ভঙ্গ দিচ্ছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অবশ্য ক্ষমতাসীন হবার পর ঘোষণা করেন তিনি ২০২১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সব মার্কিন সৈন্য দেশে ফিরিয়ে আনবেন।

মাত্র কিছু দিন আগেই মি. বাইডেনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল – এর ফলে তালেবান আবার আফগানিস্তান পুনর্দখল করবে কিনা।

২০২০ সালের মার্চে আফগানিস্তানের লাঘমান প্রদেশে একদল তালেবান যোদ্ধা।
২০২০ সালের মার্চে আফগানিস্তানের লাঘমান প্রদেশে একদল তালেবান যোদ্ধা

তিনি জবাব দেন, তা হবে না – কারণ আফগান সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ৩ লক্ষ যা তালেবানের চাইতে অনেক বেশি, এবং রাজনৈতিক সমাধান নিয়েও আশাবাদ প্রকাশ করেন তিনি।

স্পষ্টতই ঘটনাপ্রবাহ এখন সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে যাচ্ছে।

বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে আফগান সেনাবাহিনী এবং পুলিশ কতটা দিশেহারা হয়ে পড়েছে – তার খবর প্রতিদিনই এমনকি পশ্চিমা মিডিয়াতেও বেরুচ্ছে।

শত শত সৈনিক লড়াই না করেই তালেবানের হাতে অস্ত্র, যানবাহন, রসদ তুলে দিয়ে ইউনিফর্ম খুলে চলে যাচ্ছে। অনেক সৈন্য তাজিকিস্তান পালিয়ে গেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক মিলিশিয়াদের সহযোগিতা ছাড়া আফগান সরকারি বাহিনী তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকতে পারছিল না।

অবশেষে তালেবানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি চুক্তি

দোহায় ২০১৩ সালে তালেবানের অফিস খোলার মধ্যে দিয়ে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হলেও বছরের পর বছর এতে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবার পর সৈন্য প্রত্যাহারের প্রয়াসে বড় ঘটনা ঘটে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি দোহায় যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে।

আসাদুল্লাহ কুন্দুজে রাস্তায় খাবার বিক্রি করতেন। পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসেছেন কাবুলে
কুন্দুজের আসাদুল্লাহর মত বহু আফগান যুদ্ধের কারণে পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসেছেন কাবুলে

এর শর্ত ছিল – যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করবে এবং তালেবানও আর মার্কিন বাহিনীর ওপর কোন হামলা চালাবে না।

চুক্তির আরও শর্তের মধ্যে ছিল তালেবান আর আল-কায়েদা কিংবা অন্য কোন জঙ্গী সংগঠনকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আশ্রয় দেবে না এবং আফগান শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাবে।

এরপর তালেবান বিদেশি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করলেও আফগান সরকারি বাহিনী, সরকারি স্থাপনা ও দফতরে হামলা, এবং বিভিন্ন লোককে টার্গেট করে হত্যা বন্ধ করেনি তালেবান।

বরং তা আরো তীব্র হতে থাকে, আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশে তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকাও বড় হতে থাকে।

এর মধ্যেই আমেরিকানদের চাপে আফগান সরকার প্রায় ৫ হাজার তালেবান বন্দী মুক্তি দেয়, আর ২০২০-এর সেপ্টেম্বরে শুরু হয় আফগান সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে তালেবানের রাজনৈতিক সমাধানের আলোচনা – যাতে এখন পর্যন্ত কোন ঐকমত্য হয়নি।

এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে ট্রাম্পকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট হন জো বাইডেন – আর এ বছর মার্চ থেকে ক্রমে বিদেশি সৈন্যদের প্রত্যাহার শুরু হয়।

তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা – ২রা জুলাই রাতে বাগরাম ঘাঁটি খালি করে দিয়ে মার্কিন সৈন্যদের বিদায়।

তারপরই তালেবান শুরু করে তাদের ঝটিকা অভিযান – যার ফলে এখন আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রাদেশিক রাজধানীর অর্ধেকেরও বেশি তাদের নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে।

যখন কাবুলের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র বলে বলছেন বিশ্লেষকরা – তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্তত এখন পর্যন্ত প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা বলছে না।

তারা এখন ব্যস্ত কীভাবে কাবুল থেকে আমেরিকানদের নিরাপদে বের করে নিয়ে যাবার চেষ্টায়।

এর মধ্যে দিয়েই দু’দশকব্যাপী আফগান যুদ্ধের শেষ পর্ব সম্পন্ন হয় কি না – তাই এখন দেখার।

শত শত আফগান ঘরবাড়ি ছেড়ে তুরস্কে পালাচ্ছেন কেন?

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা