চলমান সংবাদ

ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস: শোষণহীন সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টা

১৮৪৮ সালে তাদের যৌথ প্রচেস্টায় লিখিত একটা ছোট্ট খসড়া পুস্তিকা গোটা পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছিল। সেই থেকে আজও অব্দি ‘কম্যুনিস্ট পার্টির মেনিফেস্টো’ নামক ছোট পুস্তিকাটি বিশ্বের অন্যতম বহুচর্চিত ও আলোচিত একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দর্শন। আধুনিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্হার প্রতিষ্ঠাতা ভ.ই. লেনিন বলেন, মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের বৈজ্ঞানিক রচনায় প্রথম ব্যাখ্যা করেন যে সমাজতন্ত্র স্বপ্নদ্রষ্টার কল্পনা নয়, বর্তমান সমাজের উৎপাদক শক্তিগুলোর বিকাশের চরম লক্ষ্য ও অপরিহার্য্য পরিণাম। আধুনিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কার্ল মার্কসের সঙ্গে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের নাম যুক্তভাবে উচ্চারিত হয়। সংবাদপত্রে বিতর্কিত লেখা দিয়ে এঙ্গেলসের হাতেখড়ি। যে সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলন স্বয়ং মার্কস। যদিও তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল অনেক পরে।এক শিল্পপতি পরিবারে এঙ্গেলসের জন্ম। বাবার ছিল কাপড়কলের ব্যবসা। ১৩ বছর বয়সে এলিমেন্টারি স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সেই পড়ায় মন বসল না। ১৭ বছর বয়সে ছেড়ে দিলেন। বাবা চাইলেন ছেলে তাঁর ব্যবসায় প্রবেশ করুক। ব্যবসায় প্রবেশ করলেও সেখানেও তাঁর মন বসল না। একাগ্র চিত্তে অধ্যয়ন করতে শুরু করেন জার্মান দার্শনিক হেগেল-এর বিভিন্ন রচনা। সেই সঙ্গে নিজস্ব লেখালেখি। এই লেখালেখি করতে-করতেই একদিন প্যারিসে দেখা হল মার্কসের সঙ্গে। হয়ে উঠলেন একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর পড়াশোনার চর্চা তখন বেড়েই চলে। একদিকে মার্কসের ‘পুঁজিবাদী অর্থনীতির চর্চা’ অন্যদিকে এঙ্গেলস চর্চা করেছেন বস্তুবাদের ওপর। লেখেন ছোট-ছোট কয়েকটি বই। তারই একটা ‘পরিবার ব্যক্তিমালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ (১৮৯৫), ল্যুদভিগ ‘ফয়েরবাগ’ (১৮৯২), ‘রাশিয়ার প্রসঙ্গে এঙ্গেলস’ (১৮৯৪)।

তার অনেক আগে ১৮৭৮ সালে লিখে ফেলেছেন ‘অ্যান্টি ডুয়েরিং’। ভিক্টোরিয়ান দর্শন, অর্থনীতি ও সমাজতন্ত্রের উপর লিখলেন ‘ইংলন্ডের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা’ নামক বই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শোষিত শ্রমিকের অবস্থা নিয়ে লেখা এই বইটি আজও সমান জনপ্রিয়। ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ প্রকাশিত হবার সঙ্গে-সঙ্গেই আলোড়ন তোলে গোটা ইউরোপ জুড়ে। মার্কসের সঙ্গে অন্যতম সহযোগী লেখক ছিলেন ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস। সেদিন সঙ্গী ফ্রিডরিখ না থাকলে মার্কস হয়তো তাঁর দুনিয়া কাঁপানো চার খণ্ডের ‘ডাস কাপিটাল’ গ্রন্থটি সমাপ্ত করতে পারতেন না। সে সময় কপর্দকহীন মার্কসকে বন্ধু এঙ্গেলস নিয়মিত জোগান দিতে লাগলেন পর্যাপ্ত অর্থ। কিংবদন্তি কার্ল মার্কস ডাস কাপিটাল শেষ করে যেতে না পারলেও তাঁর মৃত্যুর পর এঙ্গেলস সেই বইয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড-দুটি সম্পাদনা করেন। তাছাড়া তিনি মার্কসের “উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব” বিষয়ের নোটগুলো একত্রিত করেন এবং এগুলো পরে “পুঁজি”র চতুর্থ খণ্ড হিসেবে প্রকাশিত হয়। তিনি পরিবার অর্থনীতি বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এঙ্গেলস ‘কল্পলৌকিক ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ নামে ১৮৮০ সালে রচিত একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটা প্রথম ১৮৮০ সালে ফ্রান্সে প্রকাশিত হয়। ১৮৯২ সালে ইংরেজি প্রকাশনার জন্য কল্পলৌকিক ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র শিরোনামটি গৃহীত হয়। বইটিতে তিনি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করে দেখান।

তাঁর সমস্ত গ্রন্থেই তিনি যে-কোনো যুগ বা ব্যক্তির দর্শনের শ্রেণি চরিত্র প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, স্থুল বস্তুবাদ বা ইতিপূর্বেকার যান্ত্রিক বস্তুবাদের সাথে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পার্থক্য আছে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ মনকে যেমন বস্তুর অতিরিক্ত স্বাধীন কোনো সত্তা বলে স্বীকার করে না, মনকে বস্তুর জটিল বিকাশের বিশেষ পর্যায় বলে বিচেচনা করে, তেমনি মনকে অস্বীকারও করে না। বস্তুর সঙ্গে মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ককে সে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করে। তিনি শ্রমিকদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর রচনায় দেখান, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পুঁজিপতি কারখানা মালিকদের দ্বারা শ্রমিকগণ আবশ্যিকভাবেই শোষিত হন। তবে তিনি মনে করেন, এই ব্যবস্থা বেশিদিন চলতে পারে না, চলা সংগতও নয়। এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্বের কারণে তা ভেঙে পড়তে বাধ্য। শ্রমিক শ্রেণীকে তিনি আত্মজ্ঞান ও আত্মচেতনার শিক্ষা দেন এবং স্বপ্নদর্শনের স্হানে বিজ্ঞানকে স্হলাভিষিক্ত করেন। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের জন্মের দুশো বছর পরেও তাঁকে নিয়ে নানা স্তরে চলছে আলোচনা। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮২০ সালের ২৮ নভেম্বর। ১৮৭০ সালের ৫ অগস্ট তাঁর মৃত্যু হয় ক্যান্সারে। মার্কস ও এঙ্গেলস দুই বন্ধুর মৃত্যু হলেও দুশো বছর পরেও যেন তাঁরা জীবন্ত তাঁদের দর্শন, ভাবনা ও রচিত গ্রন্থের মধ্য দিয়ে। এখনও দুনিয়ায় অর্থনৈতিক সঙ্কটকালে অর্থনীতিবিদদের ‘ডাস কাপিটাল’ এর পাঠ নিতে হয়।

# ৫ আগস্ট ২০২১, প্রগতির যাত্রী ডেস্ক #