মতামত

পাটকৃষি-পাটশিল্প : সম্ভাবনা ও সংকট উত্তরণ

– আসলাম খান

সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলি বন্ধ ঘোষণা করেছে। কালো দিনটি ছিল গত ২৮ জুন ২০২০। ফলে স্থায়ী, বদলিও ক্যাজুয়াল-সব মিলিয়ে প্রায় ৫১ হাজার পাটকল শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। করোনা মহামারিকালে যখন সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, চারদিকে মানুষ চাকরি-কাজ-আয়ের উৎস হারাচ্ছে, অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, তখনই পাটকলগুলোর খট্খট্ শব্দ থেমে গেল। গেটে ঝুললো তালা। পাটকলের স্কুলগুলো বন্ধ হলো। সন্তানেরা ভেজা চোখ নিয়ে স্কুল থেকে বের হলো। এ যেন ছুটির ঘণ্টা। উদ্বাস্তুর মতো শ্রমিকের কলোনি খালি করা হলো। দিগি¦দিক ছুটলো পরিবারগুলো। বদলি শ্রমিকের হাত খালি, স্থায়ী শ্রমিকও আশঙ্কায় ভুগছে, টাকা ঠিকমতো পাবে তো? এ যেন এক দীর্ঘশ্বাস। রাজপথে নেমে আসলো শ্রমিকরা। তাদের ওপর নেমে আসলো নির্যাতন, নিপীড়ন, অত্যাচার, গ্রেফতার, জেল-জুলুম। হায়রে সোনার বাংলাদেশ, হায়রে সোনার আঁশ। তবুও চলছে সংগ্রাম। পাট চাষ ও পাট শিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্য। পাট দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। দেশের প্রায় ৫০ লাখ কৃষক পাট চাষের সাথে যুক্ত। পাট চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পাট ও পাট জাতীয় বিভিন্ন উপকরণ তৈরি ও বাণিজ্যের সাথে প্রায় ৪ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলের মধ্যে একমাত্র পাট খাতই শতভাগ মূল্য সংযোজনকারী। পশ্চাৎ ও সম্মুখ সংযোগ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে পাটের অর্থনীতি আমাদের গোটা অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু বড় প্রশ্ন হচ্ছে কেন পাটকলসমূহ বন্ধ করা হলো? বর্তমানে করণীয় কী? কোন সেই সর্বনাশা সিদ্ধান্ত : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সমন্বয় ও সংসদ অধিশাখা কতৃক সচিব, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় লোকমান হোসেন মিয়া স্বাক্ষরিত ১৮ আগস্ট ২০২০ বেলা ১২:৩০ ঘটিকায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে, তড়ড়স চষধঃভড়ৎস এর মাধ্যমে অনুষ্ঠিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালীন প্রদত্ত নির্দেশনাসমূহের বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আগস্ট ২০২০ মাসে অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিবরণীতে, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) বলেন যে, সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলসমূহের ক্রমাগত লোকসানজনিত বিরাজমান পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে এ মন্ত্রণালয়ের ৩০/০৬/২০২০ তারিখের ২৪.০০.০০০০.১১৮.১৮.০৫৭.২০.১০৪ সংখ্যক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জুট মিলস্ করপোরেশন (বিজেএমসি)-এর নিয়ন্ত্রণাধীন ২৫টি মিলের শ্রমিকদের চাকুরি গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সুবিধার আওতায় অবসানসহ উৎপাদন কার্যক্রম ০১ জুলাই ২০২০তারিখ হতে সম্পূর্ণরুপে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাট পণ্যের চাহিদা আছে কি : করোনা পরবর্তী বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার ফলে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা বাড়বে বিপুলভাবে। সারা ইউরোপে একযোগে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। ধারণা করা যায়, ২০২২ সাল নাগাদ শুধু পাটের ব্যাগের বৈশ্বিক বাজার দাঁড়াবে ২৬০ কোটি ডলারের। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জুট ডিও, টেক্সটাইলের চাহিদা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞানীরা পাটের আঁশ থেকে পলিমার ব্যাগ, পাট থেকে ডেউটিন ‘জুটিন’ উদ্ভাবন করেছেন। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) এরই মধ্যে ২৩৫ ধরনের দৃষ্টিনন্দন বহুমুখি পাটপণ্য উৎপাদন করছে। বিলাসবহুল মোটরগাড়ি নির্মাণ করে এমন পাঁচটি বড় কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে, তারা তাদের গাড়ির অভ্যন্তরীণ ডেকোরেশনের একটা বড় অংশ তৈরি করবে পাটজাত পণ্য দিয়ে। পাট থেকে ভিসকস, উন্নতমানের মিহি সুতা, জুটন (পাট ও তুলার সংমিশ্রণে তৈরি কাপড়) উদ্ভাবন পাটের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু পাটের আঁশ নয়, পাটকাঠিও আন্তর্জাতিক বাজারে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। পাটকাঠি থেকে জ্বালানি হিসেবে চারকোল এবং এর গুঁড়া থেকে ফটোকপিয়ার মেশিনের কালি তৈরি হচ্ছে। পাট থেকে মন্ত ও কাগজ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। চাল-গম-আটা-চিনিসহ ১৮টি পণ্যের মোড়ক ব্যবহারে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আদেশ ম্যানডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট ২০১০ বাস্তবায়ন হলে দেশের বাজারে পাটের বিপুল চাহিদার সৃষ্টি হবে। উপযোগী মাটি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং পরিশ্রমী কৃষক থাকায় বাংলাদেশে পৃথিবীর সেরা জাতের পাট উৎপাদন হয়। গত ৫০-৬০ বছরে গড়ে উঠেছে অভিজ্ঞ ও দক্ষ শ্রমিক। পাটকে কেন্দ্র করে কৃষি ও শিল্পখতে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। করোনায় সব খাতে রপ্তানি কমে গেলেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। পোশাকের পর রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে পাট ও পাটজাত পণ্য। সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে ৪৪ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার লোকসান দেখিয়ে সম্ভাবনাময় এ খাতকে বন্ধ করে দিতে পারে, অথচ কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ৬ বছরে সরকার ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারের আমলেই ভ্রান্তনীতি, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না দেয়া, মাথাভারি প্রশাসন বৃদ্ধি, মুষ্টিমেয় কর্মকর্তার দুনীতি-লুটপাটের কারণে পাটখাতে লোকসান। লোকসানের দায় কার : সম্ভাবনাময় পাটখাতকে লোকসানি প্রতিষ্ঠন হিসেবে টিকিয়ে রেখে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দিয়ে চালনোর পক্ষপাতি কেউ নই। কারণ এটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠনে পরিণত করার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা যদি সঠিক নীতি, পদ্ধতি ও কর্মপন্থা ঠিক করতে পারি তাহলেই কেবল সেটা সম্ভব। এবং সেটা করার আগে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটখাতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি শত বছরের পুরানো। এগুলোকে কেউ কেউ বলেন- “স্কটল্যান্ড টেকনোলজি”, যার উদ্ভাবন ঘটেছিল ১৮৮২ সালে। ব্রিটিশদের হাতেই এর গোড়াপত্তন। সেই একটি যন্ত্রপাতি দিয়ে কারখানা গড়ে উঠলো ভারতে। পাকিস্তান আমলেও ঐ একই টেকনোলজির ব্যবহার হতে থাকলো। স্বাধীন বাংলাদেশেও রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে ঐ একই যন্ত্রপাতির ব্যবহার চলছে। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটখাতে এখন যে ধরনের তাঁত আছে, সেজন্য প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা চালাতে ৫জন শ্রমিক দরকার হয়। বছরে ৩০০ দিন ৫ জন শ্রমিক যদি এই তাঁতটি চালায় তাহলে উৎপাদন হবে সর্বসাকুল্যে ১৬ টন। যদিও বাস্তবে এর চেয়েও কম পাওয়া যাচ্ছে এখন। ফলে পাটের দাম ও শ্রমের মজুরির হিসাব ও উৎপাদিত পণ্যের দাম বিবেচনায় নিলে লোকসান হওয়া ছাড়া কোন পথ নেই। এটাই ঘটছে এখন। ফলে এই টেকনোলজি দিয়ে কোনভাবেই আর পাটশিল্পকে লাভজনক করার সুযোগ নেই। তাছাড়া নতুন প্রযুক্তির তাঁত স্থাপন না করে পুরাতন তাঁতের সংস্কারের (বিএমআর) জন্য টাকা ব্যয় করলে সেটা স্রফে অপচয় ছাড়া আর কিছু হবে না। সরকারি পাটকলগুলো কীভাবে লাভজনক হতে পারে : স্কটল্যান্ড টেকনোলজি থেকে সরে আসতে হবে। বর্তমানে বিজেএমসি পরিচালিত ২২টি কারখানায় হেসিয়ান, সেকিং এবং সিবিসি-এই তিন ধরনের মোট ১০ হাজার ৮৬৫টি তাঁত রয়েছে। আধুনিক স্বয়ংক্রিয় তাঁতের তুলনায় এগুলির উৎপাদন ক্ষমতা ১৬টন, সেকিং তাঁতের ৩৯টন এবং বিসি তাঁতের ১৮টন। অথচ চয়নিজ ঞঁহমফধ ঞউ ৭৮৮ গড়ফবষ এবং ঠরপঃড়ৎ ১১০১ ঔঁঃব জধঢ়রবৎ খড়ড়স স্বয়ংক্রিয় তাঁত ব্যবহার করলে বছরে ৩৬ টন উৎপাদন করা সম্ভব। আর বুদ্ধিমত্তার সাথে সরবরাহ চুক্তি করতে পালে তাঁত সরবরাহকারী কোম্পানিগুলিই শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে পারে। পাটের সরবরাহ ও পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই পাটশিল্প নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। আমাদের হিসাব মতে, নতুন টেকনোলজি ব্যবহারের ফলে গড় উৎপাদন ৬০ ভাগ বেড়ে যাবে। উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয়মূল্য শুধু হেসিয়ন তাঁত থেকেই আসবে ১৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া সেকিং ও সিবিসি থেকে আসবে আরো প্রায় ১ হাজার কেটি টাকা। ফলে বিজেএমসি তখন আত্মনির্ভরশীল একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। কোনো ধরণের সরকারের আনুকূল্য ছাড়াই সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক নিয়মে পরিচালিত হবে। যন্ত্রপাতির আধুনিকীকরণ শুধু রাষ্ট্রায়ত্তপাটকলগুলির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। বেসরকারি পাটকলগুলোকেও এই ধারা চালু করতে হবে। মালিক শ্রমিকের পর্যবেক্ষণ প্রতিক্রিয়া : বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন পৃথিবীতে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে কিন্তু সুসময় চলছে। কোভিড-১৯ মহামারি পরিবেশের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়ায় এ খাতের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে, বিশ্ব বাজারে দামও বাড়ছে। এই সময়ে হঠাৎ করে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে, এটা আমরা চিন্তাই করতে পারিনি। বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আবদুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা লক্ষ্য করি, শুধু ধান, চাল ও গমে পাটের মোড়ক ব্যবহার হচ্ছে, সেটাও স্বল্প আকারে; রাজধানী ঢাকায়। জেলা- উপজেলায় কেউ মানছে না এই আইন। ছয়টি পণ্যে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা গেলেদেশে পাটকলের সংখ্যা আরও বাড়তো এবং কর্মসংস্থানও বাড়তো বলে মন্তব্য করেন তিনি। অন্যদিকে পাট সুতা বস্ত্র কল শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা সহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, পাটের চাহিদা বিপুল সম্ভাবনাময়। পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। বিকল্প প্রস্তাব মতে সরকার কার্যকর উদ্যোগ নিলে পাট শিল্প লাভজনক হবে। পাটকলসমূহ খুলে দিতে হবে। এ দাবি শুধু শ্রমিকের নয়। দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের। এটা জাতীয় ইস্যু। আবার সুদিন ফিরে আসবে আশা করি। রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ধ্বংস সংবিধানের পরিপন্থি : ৬৯-এর গণঅভ্যুথানসহ বাংলাদেশের অভ্যূদয় এবং ‘৭২’র এর সংবিধানে পাট, পাটশিল্পকে জাতীয় সম্পদ, জাতীয় ঐতিহ্য ও গৌরবের ধারক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। সেকারণে এটা শুধু সম্পদই নয়; বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ। পাট এবং পাটশিল্প ধ্বংস হওয়ার অর্থ বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম উপাদানকে ধ্বংস করে দেয়া। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিগত ২০১৮ সালের ২৯জুলাই ২০১৮ সনের ২৫ নং আইন ১। সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও প্রবর্তন। ইধহমষধফবংয ওহফঁংঃৎরধষ ঊহঃবৎঢ়ৎরংবং (ঘধঃরড়হধষরুধঃরড়হ) ঙৎফবৎ, ১৯৭২ রহিতক্রমে পুনঃপ্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রণীত আইন। ২। এই আইন অবিলম্বে কার্যকর হইবে। এই ধরনের গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়ে সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। আমরা কোনোভাবেই এইটা হতে দিতে পারি না। পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছে। টাকার অঙ্কে তা প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। এই অঙ্ক ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি হয়েছে ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে পাটের তৈরি বিভিন্ন বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি হয়েছে ১০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। আয় বেড়েছে ২৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। লক্ষের চেয়ে আয় বেড়েছে ৮৩ শতাংশ। এছাড়া পাটের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৯ কোটি ডলারের। আর এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে চামড়াকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এল পাট। এছাড়া পাটের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৯ কোটি ডলারের। আশু ও জরুরি দাবি : ১. বন্ধকৃত ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল আধুনিকায়ন করে চালু, উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদন ব্যয় কমানো ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলে লাভজনক শিল্পে পরিণত করতে হবে। কর্মহীন ৫১ হাজার শ্রমিককে স্বপদে কাজে ফিরিয়ে আনতে হবে। ২. সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বন্ধকৃত পাট, সুতা ও বস্ত্রকল আধুনিকায়ন করে অবিলম্বে চালু করতে হবে। এই দুর্যোগকালীন সময়ে প্রায় দেড় লক্ষাধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান করতে হবে। ৩. সরকারি, অধিগ্রহণকৃত, হস্তান্তরিত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন পাট, সুতা ও বস্ত্রকলের সকল শ্রমিকের আইনসঙ্গত বকেয়া পাওনা পরিশোধ করতে হবে। ৪. রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি অবিলম্বে ঘোষণা করতে হবে। বস্ত্রকল শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত মজুরি কার্যকর করতে হবে। ৫. সর্বক্ষেত্রে শ্রম আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় শ্রমনীতি এবং আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুসারে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করাসহ শ্রম আইন সংশোধন করতে হবে। পাট সংস্কৃতি ও লুটেরা অর্থনীতির সংস্কৃতি : পাটের সবুজ ক্ষেত নিড়ানোর পর পাট গাছের আগা পাতা ‘পাট শাক’, গরম ভাত, শুকনো মরিচের ভর্তা গরিব মানুষের পাতে শোভা পায়। পাট শাক রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়। পাট ক্ষেতে পানি জমলে ছোট ছোট মাছ আটকা পড়ে। পাট কাটার মৌসুমে দিনমজুর (আঞ্চলিক ভাষায় ‘কামলা’) ক্ষেতে কাজ করে। নদী, পুকুর, ডোবা, বিলে পাট জাগ দিতে হয়। নির্দিষ্ট সময় পর পচে যাওয়া পাট থেকে পাট খড়ি আলাদা করে বাড়ির আঙিনায় শুকানো হয়। বড় বড় বাঁশ পুঁতে পাট শুকানো হয়। পাট এবং ভেজা শোলা গন্ধ ছোটবেলা থেকেই শুকেছি। শুকনো পাট বাড়ির আঙিনায় ঝাড়া দেয়া, হাতে পানি নিয়ে যতেœ আঁটি বাঁধা, হাটে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি যেন গৃহস্থের বাড়ির আঙিনায় উৎসব মনে হয়। অনেক সময় জ্যোৎস্না রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে পাট গোছানোর কাজ চলে। দিনমুজুর দিয়ে নিকটস্থ হাটে বিক্রির জন্য লাইন ধরে ভাড়ে পাট নিয়ে যাওয়া হয়। হাট গমগম করে ক্রেতা বিক্রেতার সমাগমে। কৃষক পাট বিক্রি করে সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনে, বউয়ের জন্য আলতা, পাউডার, চুরি, বৃদ্ধা মায়ের জন্য শাড়ি কেনে, নিজে পেট পুরে জিলেপি খেয়ে বিড়ি ধরিয়ে খানিক স্বস্তিতে বাড়ি ফেরে। পাটের জন্য এত দরদ এত ভালবাসা সেই ভালবাসার পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করছে লুটপাটকারী গোষ্ঠী। একটি ঐতিহাসিক ছবি অনেকের দেখা। আফ্রিকার এক কংকালসার শিশু মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে, পিছনে পিছনে শকুন। শকুন অপেক্ষা করছে কখন মৃত্যু ঘটবে শিশুটির। দেশের লুটেরা শাসকগোষ্ঠীও ইতোমধ্যে খুলনা, চট্টগ্রাম পাটকলের যন্ত্রপাতি জায়গা জমি দেখতে গিয়েছে। গ্রাস করতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভাগ বাটোয়ারা হবে। কিংবা ভোগ দখলের আয়োজন। শকুন ঘুরছে, মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রণালয়ে। আমরা যারা পাটকে ভালবাসি আমাদের কি কিছুই করার নেই, চেয়ে চেয়ে দেখবো?মুক্তিযুদ্ধে পাক সেনা নামক শকুনদের তাড়িয়েছি। আসুন, আমরা দলমত নির্বিশেষে দেশপ্রেমিক মানুষ পাটকে বাঁচানের জন্য উদ্যোগ নেই, নেমে পড়ি। ‘পাট’ তোমার জন্য ভালবাসায় ঋণ শোধ করতে রক্ত দিবো। বুকের গভীরে পাটের প্রতি ভালবাসা জড়িয়ে আছে। এ ভালবাসা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। যারা কেড়ে নিতে চায় তাদের জন্য অভিশাপ ‘দূর হ দুঃশাসন’। লুটেরাদের স্বার্থে সরকার, লুটপাটের ডাকাতির দর্শন সরকারের। দেশ, শিল্প, কৃষি বড় না হয়ে সরকার পাটকলসমূহ বন্ধ করে প্রমাণ করেছে ‘লুটপাটই বড়’। দেশপ্রেমিক মানুষ কি ঘুমিয়ে থাকবে? সরকার লুটপাটকারী আমলাদের ওপর নিছক আস্থা রেখে ঘরে চুপচাপ বসে থাকবে? পাটশিল্পের মালিক, শ্রমিক, রাজনৈতিক দল, শ্রেণিপেশার মানুষকে সামিল করে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়া দেশপ্রেমিকদের দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে- “তুমি যদি রুখে দাঁড়াও, জিতবে বাংলাদেশ”। বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও। পাট কৃষি পাটশিল্প বাঁচাও। আসুন সোনালী আঁশের সোনালী স্বপ্নে বুক বাঁধি।

লেখক : সংগঠক, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি