শিল্প সাহিত্য

আল মাহমুদ কি নৈসর্গিক কবি? (শেষ পর্ব)

– শোয়েব নাঈম

যে পরিমাণ আনুগত্য একনিষ্ঠতা দরকার ছিল নৈসর্গিক ভাবনাই তারচেয়ে অধিক উদ্বিগ্ন ছিলেন তার নিজস্ব রাজনৈতিক আর বৈষয়িক চিন্তায়, তাই স্খলিত প্রকৃতি-চিন্তন বিচ্যুত কবি হিসাবেই জিজ্ঞাসাচিহ্নের মতই চিহ্নিত আল মাহমুদ তার সমগ্র প্রকৃতি-মনস্কতার লেখনিগুলিতে। অধিকতর পর্যবেক্ষণে তার কবিতায় প্রকৃতি-বর্ণনা যতটা বিকশিত, সেসব পাঠ থেকে মাহমুদ-সৃষ্ট ছত্রে ছত্রে নিসর্গের মায়াবি রহস্যময়তার প্রামাণিক সাক্ষ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রকৃতির উপকরণে ভর করে দেহবাদী চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন বেশি। তার কোনো কাব্যগ্রন্থ কখনোই সেই নিবিড় প্রকৃতি ভাবনার উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। কৌতুহলী চোখে প্রাকৃতিক উপকরণে নৈসর্গিক বর্ণানায় যতটা আত্মগত হতে চেয়েছিলেন প্রকৃতির বর্ণনাসংবলিত পথে, ততটা বিস্তৃতে প্রশস্তে নৈসর্গিক মনস্কতার উম্মেষ ঘটাতে পারেননি তার প্রকৃতি-জগত বিষয়ক লেখনিতে।
” ‘জাগতিক সব সৌন্দর্যবোধই শেষপর্যন্ত ক্লান্তিকর, যেমন নদীর সাথে নারীর তুলনা… এখন আর প্রাণের সাথে প্রকৃতির তুলনা আমাকে তৃপ্তি দেয় না, বরং ছেলেখেলা মনে হয়…”- আল মাহমুদ ।
শৈশবের ভালোবাসায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেখানে সবুজের প্রাণময়তা আকুল, বিস্ফোরিত প্রকৃতি , টলমলে বয়ে যাওয়া তিতাস, আকাশের অনন্ত নীল আর ধরণীর দিগন্তছোঁয়া আস্তীর্ণে নয়নের মগ্নতা- চেতনায় ধারণকরা সেসব উপকরণগুলি আল মাহমুদের স্থানান্তরিত নাগরিক জীবনে বিস্ময়ে বিদীর্ণে বেশিকাল আর প্রজ্জ্বলিত থাকেনি পরিবর্তী জীবনে। তার প্রকৃতি সংলগ্ন কবিতাগুলি পাঠককে গভীর অনুধ্যানে কোন প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করাতে পারেনি, প্রকৃতির কোন রহস্যময়তার ইঙ্গিতও দিতে পারেনি।
-‘বাতাসে পাশব গতি’, ‘কার্তিকেই কেঁপে ওঠে হাড়’ : অরণ্য অসুখী/ লোক-লোকান্তর ।
– ‘ঘোলা স্রোত টানে’, ‘মাটির কলস জল ভরে’,
‘ সেই ঝিকমিক শবরী তিতাস’: তিতাস/ লোক লোকান্তর
-‘ নিসর্গের ফাঁকে ফাঁকে যখন বিষণ্ণ হাওয়ার রোদন’ : পিপাসার মুখ/ লোক লোকান্তর ।
-‘বাতাসের বিলাসী বিরোধে’: জল দেখলে ভয় লাগে / কালের কলস ।
-‘ যেও না জলের কাছে, যে সব নদীতে ঢেউ নেই
কাঁপে না পানির প্রান্ত তেমন তিতাসে যাও যদি
সে যে আরও ভয়াবহ, আর্শি যেন তরল ত্রিশিরা
ফোটাবে কলস কাঁখে অতি মৃদু কম্পিত তোমাকে’ : জলছবি/ কালের কলস ।
-‘নিসর্গও ঝরে যায় বহুদূর অতল আঁধারে’,
‘ বৃষের স্কন্ধের মতো নুয়ে আসে রাত্রির আকাশ’
‘ধোঁয়া অগ্নি মশলার গন্ধ থেকে দূরে’ : কালের কলস/ কালের কলস ।
-‘ তুমি আমার এক থোকা কালো আঙুর’,
‘ আমি ভ্রমর, আমি তোমার কালো মাছি’
: বেহায়া সুর/ কালের কলস ।
প্রাকৃতিক উপকরণ বৈশিষ্ট্যে আল মাহমুদ সৃষ্ট আরো অনেক কাব্যিক লাইন তার কাব্যগ্রন্থগুলিতে যে পরিমাণ খুঁজে পাওয়া যায়, সেসব কথাগুলিকে বিশ্লেষণ করে কখনো আল মাহমুদকে ‘প্রকৃতির কবি’ এমন বিশেষণে আখ্যায়িত করা যায় না, এমন কি তার রচনাকে প্রকৃতির নিবিড়-পাঠও বলা যায় না। বিহারীললাল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবননান্দ এদের মতো স্বতন্ত্রধারায় বাংলা সাহিত্যে আর কেউ ‘প্রকৃতির কবি’ এমন অনন্য উপাধিতে ভূষিত হতে পারেনি।  তাঁদের মতো অন্য কোন কবিসমগ্র জীবনকে বিশাল প্রকৃতির ভিতর দিয়ে গ্রহণ ও এমন আত্মগত হয়ে প্রকাশ করতে পারেনি । আল মাহমুদের কোন কবিতাকেই আত্মোম্মোচিত প্রকৃতি-প্রধান কবিতা হিসেবে অভিহিত করা যায় না। ভ্রমাত্মক বা অপরিশুদ্ধ পাঠে অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আল মাহমুদকে যারা ‘প্রকৃতির কবি’ এই উপনামের মূল্যায়নে বেশ তৎপর, তাদের বিভ্রান্তি বা উদ্দেশ্যের ক্ষিপ্রতাকে প্রতিরোধ করতে এখন অনেক বিস্তৃত সচেতন কবি-লেখক তাদের লেখনির মাধ্যমে আল মাহমুদকে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে এগিয়ে আসছে সাহিত্য জগতে।
-সমাপ্ত-
শোয়েব নাঈমঃ কবি ও প্রান্ধিক