মতামত

রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকাঃ যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে নয়া-অর্থনীতি (৬ষ্ঠ পর্ব)

– অধ্যাপক সুস্নাত দাশ

১৯১৭-র অক্টোবরে রাজনৈতিক ক্ষমতাসমূহের ভরকেন্দ্রের পরিবর্তনেও পাইপস রুশ শ্রমজীবী জনতার ভূমিকা বা সমর্থনের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাননি। বিশেষ করে তাঁর কলমে রুশ-বিপ্লবের মহানায়ক লেনিন চিত্রিত হয়েছেন একজন অর্থনৈতিক ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তিতে- সংকীর্ন মনের সুযোগসন্ধানী যে মানুষটা শুধুমাত্র দুঃসাহস ও পেশাদারি নৈপূণ্যের সাহায্যে রাশিয়ায় নিতান্তই নির্দয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সংখ্যালঘু একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব। ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারি মাসের জারতন্ত্র উচ্ছেদকারী বুর্জোয়া- গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে অক্টোবর মাসে সংগঠিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের গতি-প্রকৃতি ও ধারাবাহিকতা বিচার করলে দেখা যাবে সেসময় ক্রমশ শ্রমিক-কৃষক-সৈনিক-নাবিক এবং সর্বোপরি (প্রধানত এপ্রিল মাসের পর যখন লেনিনের ‘এপ্রিল থিসিস’ বিপ্লবের আশা রুশ শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে সঞ্চার করেছিল) সোভিয়েতগুলিতে ( পেত্রোগ্রাদ ও মস্কো দুটি সোভিয়েতেই বলশেভিকদের নিরংকুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল) বলশেভিক দলের (সে সময় এই দলের সদস্য সংখ্যা আড়াই লক্ষেরও বেশি এবং যার ৯৬ শতাংশই শ্রমজীবী শ্রেণিভুক্ত) প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ‘প্রাভদা’ ও অন্যান্য বলশেভিক পত্র-পত্রিকার প্রচার সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং লক্ষ লক্ষ মানুষের সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগীতা এবং সেই বামপন্থী সোস্যাল রেভ্যুলিউশনারি গোষ্ঠীর সমর্থন বিপ্লবের বাস্তব ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। এটা শুধু ষড়যন্ত্রমূলক একটি মিলিটারি ক্যু মাত্র হলে বলশেভিকরা যে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারত না সে বিষয়ে স্টিফেন কোহেন, ওয়াল্টার ল্যাকিওয়র, মার্ক ফের প্রমুখ পাশ্চাত্য ইতিহাসবিদদেরও কোন সন্দেহ নেই। আফসোসের বিষয় পাইপস নিজের চোখে অক্টোবর বিপ্লব দেখেননি- কিন্তু যারা প্রত্যক্ষদর্শী তারই দেশের জন রিড ( মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ১৯২০ সালে তাঁর অকালে মৃত্যু না ঘটলে রুশ বিপ্লবের ইতিহাস চর্চা আরও সদর্থক রূপ নিতে পারতো বলা বাহুল্য), আলবার্ট রিস উইলিয়ামস, লুই ব্রয়ান্ট প্রভৃতি পাঁচজন আমেরিকান সাংবাদিক ও বদ্ধিজীবী তাঁদের যে অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য-দলিল সংকলিত করেছেন – পাইপসের বক্তব্য মানতে হলে সেসব আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত করতে হয়। কোনো সুস্থবুদ্ধির ইতিহাসপ্রেমীর পক্ষে যা একান্তই অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন আলবার্ট উইলিয়ামসের মন্তব্য, “একটি মাত্র ব্যাক্তির উপর কিংবা কিছু লোকের একটা গ্রুপের উপর ভর করে রুশ বিপ্লব ঘটেছে, ইতিহাসের এমন যে কোনো ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিকর। রুশ বিপ্লব যে উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছে সেখানেই রয়েছে এর ভাগ্য – জনগণের অন্তরে আর বাহুতে।“ [রুশ বিপ্লব প্রবাহ (বঙ্গানুবাদ); প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৭০, পৃঃ ৬৭-৬৮ দ্রষ্টব্য] এই প্রসঙ্গে জন রিড লিখেছেন, “বলশেভিকরা যে ক্ষমতা জয় করল, সেটা সম্পত্তিবান শ্রেণি বা অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আপসের পথে নয়, সাবেকী রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে তোষণ করে নয়। ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর বল প্রয়োগেও নয়। সারা রাশিয়ার জনগণ যদি তৈরি না থাকত, তাহলে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হত। বলশেভিক সাফল্যের একমাত্র কারণ তারা জনগণের গভীরতম স্তরের সহজ-সরল বিপুল আকাঙ্ক্ষাকে রূপায়িত করে, পুরাতনকে ভেঙ্গে বিধ্বস্ত করার জন্য তাদের ডাক দেয়।“ সম্ভবতঃ রিড বা উইলিয়ামসরা তাঁদের দূরদৃষ্টির সাহায্যে বুঝে নিতে দেরি করেননি ভবিষ্যতে বিশ্ব-পুঁজিবাদের পীঠস্থান তাঁদেরই স্বদেশ ভূমি মার্কিনমুলুক থেকে রিচার্ড পাইপসের মতো বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা কী ধরনের আক্রমণ হানতে পারেন মানব সভ্যতার মহত্তম গণবিপ্লবের বিরুদ্ধে- তার জবাবও তাই তৈরী করে গেছেন। দ্বিতীয়ত পাইপসের প্রতিপাদ্য বিষয়ের আর একটি ক্ষেত্র ছিল লেনিনের ভূমিকা। লেনিন কোনও ঈশ্বর প্রেরীত দূত বা স্বয়ং ভগবান ছিলেন না এটা একশো ভাগ যেমন সত্য, তেমনি পাইপস (বা অনুষ্টুপে’র বাঙালি বুদ্ধিজীবী জনৈক পরেশ চট্টোপাধ্যায়) কথিত ‘নীতি-নৈতিকতাহীন’, ফটকাবাজ ভাগ্যান্বেষী বা দস্যু  দলের সর্দারও যে ছিলেন না সেটাও একশো দশভাগ সত্য। কেরেনস্কির সামরিক সরকারের পতন ঘটাবার পর ক্ষুধার্ত, শীতার্ত, হতদরিদ্র সশস্ত্র সর্বহারার একটি উচ্ছৃঙ্খল দল শীতপ্রাসাদে যে লুণ্ঠন চালায় তা কড়া হাতে দমিত হয়েছিল লেনিনের নির্দেশে, এমনকি লুন্ঠিত যৎসামান্য দ্রব্যাদিও যাতে উদ্ধার করা হয় তার জন্য বিপ্লবী সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে জারী করা হয়েছিল প্রশাসনিক নির্দেশ। ক্রেমলিন দখল করার পরেও জার পরিবারের ভূগর্ভস্থ চোরাকুঠুরীর দরজা ছিল অটুট। শুধুমাত্র ব্যাঙ্কগুলির কর্তৃপক্ষ বলশেভিকদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজী না হওয়ায় নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ সেখান থেকে সংগৃহীত হয়েছিল সরকার ও সেনাবাহিনী পরিচালনার জন্য। এর সকল তথ্য দলিলই বর্তমান।

একথা সত্যি অক্টোবর বিজয় সম্পর্কে কোন দ্বিধা লেনিনের ছিলনা। দূরদর্শী  রাষ্ট্র নেতার অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি বুঝেছিলেন যখন রাশিয়ার শ্রমিক-কৃষক ন্যূনতম জীবনযাপনের সর্বপ্রকার উপায় থেকে বঞ্চিত, জার্মানির সঙ্গে যুক্তফ্রন্টে রসদহীন রুশ সৈন্যরা লাখে লাখে মশা-মাছির মতন মরছে তথাকথিত ‘দেশপ্রেমী’ যুদ্ধে (সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে বাঁধানো যে যুদ্ধে সাধারণ মানুষের এতটুকু স্বার্থ নেই), ১৯১৪ সালের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি যখন কম করে ৫০ গুণ- এই অবস্থায় এতটুকু কালক্ষেপ করার অর্থ রাশিয়াকে পুনর্বার জারতন্ত্র ও অভিজাত সামন্ত শাসকদের হাতে নয়তো জার্মানদের সাম্রাজ্যবাদের হাতে তুলে দেওয়া। এই প্রস্তুতি লেনিনের নেতৃত্বে RSDLP-র বশেভিক বা কমিউনিস্টরা একদিনে নেয়নি। সুদীর্ঘ অন্তত ১৫ বছরের দেশে-বিদেশে বিরামহীন রাজনৈতিক প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিই ছিল অক্টোবর বিপ্লব। (পাঠক পড়তে পারে V. E. Bonnel Roots of Rebellion: Workers’ Politics & Organisations in st. Petersburg and Moscow 1900-1914; Berkley, 1983) জিনোভিয়েভ-কামেনভের মতন দোদুল্যমান বলশেভিক কিছু নেতা মনে করতো এই বিপ্লবের বিজয় লাভ অসম্ভব’, অপরদিকে লেনিন মনে করতেন ‘এই বিপ্লবের ব্যর্থতাই অসম্ভব।‘ এটা কোন পাইপস কথিত ‘যুক্তিহীন ভাগ্যপরীক্ষা বা ফাটকা’ বা কলকাতার চাটুজ্জ্যে কথিত ‘ক্ষমতা লাভের জেদ’ নয় – এটা ছিল বিপ্লবী পরিস্থিতি অনুধাবনে সক্ষম পোড়খাওয়া একজন নেতার নিজ শক্তির পরিমাপ সম্পর্কে বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাস- যা কোন দোদুল্যমান বুদ্ধিজীবীর থাকেনা, থাকে শ্রেণিসংগ্রামে স্থির সকল্পবদ্ধ সর্বহারার প্রকৃত নেতৃত্বের। তাই অক্টোবর বিপ্লব ‘মুক্তিমেধ যজ্ঞ’ নয়’মানব সভ্যতার মুক্তিযজ্ঞে’ পরিনত হয় – যে তীর্থ দর্শন না করলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও নিজেকে বঞ্চিত বোধ করতেন।

পড়ুনঃ রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকাঃ যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে নয়া-অর্থনীতি (৫ম পর্ব)

চলবে …

লেখকঃ অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ।