মতামত

কমরেড মণি সিংহ আর্দশ রাজনীতির প্রতীক

– আসলাম খান

ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামী, টংক আন্দোলনের মহান নায়ক, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রথম সরকারের উপদেষ্টা, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সাবেক সভাপতি কমরেড মণি সিংহ জন্ম গ্রহণ করেন ১৯০১ সালের ২৮ জুলাই এবং ১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রয়াণ হয়েছেন।

তিনি তাঁর জীবনের দীর্ঘ যাত্রায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের শোষন বৈষম্য জুলুমের বিরুদ্ধে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এমনকি ১৯৭৭ সালে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়েও জেল খেটেছেন। একজন মানুষের পক্ষে সময়ের যাত্রায় দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নিজের অবদান রাখা সৌভাগ্যের বিষয়। কখনও জেল জুলুম, কখন হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপনে থাকা, অন্তরীন থাকা, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে টংক আন্দোলনে সরাসরি নেতৃত্বের দেয়া, ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত এলাকা তৎকালীন ময়মনসিংহের নেত্রকোণার দূর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে ধান কাড়াড়ি (ধানের মাধ্যমে খাজনা দেয়া) বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করা কম দু:সাহসের বিষয় নয়। তার রাজনৈতিক জীবন বর্নাঢ্য ও রোমাঞ্চকর।

কমরেড মণি সিংহের শৈশব কেটেছে  নেত্রকোণা জেলার সুসং দূর্গাপুরে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য কলকাতায় যান। কলকাতায় ১৯১৪ সালে সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠী ”অনুশীলন” দলে যোগ দেন। এক দশক পরে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ত্যাগ করে ১৯২৫ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯২৮ সালে মেটিয়া বুরুজে কেশোবাম কটন মিলে শ্রমিকদের ১৩ দিন ব্যাপী ধর্মঘটে নেতৃত্বে দিয়ে দাবি আদায়ের মাধ্যমে মণিসিংহ রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করেন। ১৯৩০ সালে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে সুসং দুর্গাপুরে আসেন এবং তাকে অন্তরীন করা হয়। তিনি যখন গ্রামের বাড়িতে আসেন স্থানীয় কৃষকদের অনুরোধে টংক আন্দোলনে শুরু করেন। মণি সিংহ তার পারিবারিক টংক চাষীগুল মামুদের ৬০ মন টঙ্কের ধান মওকুফ করে দেন। নিজ পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের প্রতিপক্ষ হয়ে সাধারন কৃষকদের স্বার্থে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন । ১৯৪৫ সালে ঐতিহাসিক নেত্রকোণায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কিষান সভায় মহাসম্মেলনের সংগঠক ও অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন । ১৯৪৬ সালে হাজং সাম্প্রদায় স্বত:স্ফুর্তভাবে টংক বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। টংক আন্দোলনে শতাধিক হাজং নেতা কর্মী শহীদ হয়েছেন। এ আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৫১ সালে মণি সিংহের উপর হুলিয়া জারি করে তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হয়। আদিবাসিদের প্রাণপ্রিয় নেতায় পরিনত হোন। ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন। সংগ্রামের পথ পরিক্রমার ইতিহাসের বাকেঁ বাকেঁ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছেন।

১৯৬৯ সালে গ্রেফতার হন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সাধারন কয়েদিদের সহায়তায় রাজশাহী কারাগার ভেঙ্গে বের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রথম সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। কমরেড মণিসিংহের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবন বর্ণাঢ্য হলেও তার জীবন দর্শন, ব্যক্তি জীবনের সততা, আদর্শ নিষ্ঠা, আপোষহীনতা, দূরদর্শিতা, সৎ ও ত্যাগের জীবন আর্দশ রাজনীতির প্রতিক। শোষিত বঞ্চিত নির্যাতিত মেহনতি মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা এবং গভীর দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতিক। বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার অন্যতম কারন ত্যাগী দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের অভাব।

কমরেড মণিসিংহকে চিনতে হলে তার অন্যন্য দূলর্ভ অসাধারন গুনাবলী। উল্লেখ করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর আমলে সিপিবি পার্টি সমাবেশে কর্মীদের খাওয়াবার ব্যবস্থা করা হয়। তখন খোলাবাজারের তুলনায় রেশনের চাউলের দাম বেশ কম। মণিসিংহ পারমিট জোগাড় করে নিলেন। কিন্তুু সমাবেশ শেষে দেখা গেল বেশ কিছু পরিমান চাল বেচে গেছে। খোলা বাজারে সেই চাল বিক্রি করে প্রচুর লাভ হতে পারত। কমরেড মণিসিংহ চাল বেচে গেছে জানার সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলেন, এ চাল সরকারেকে ফেরৎ দিতে হবে। তৎকালীন মন্ত্রী ফণি ভূষণ মজুমদার এর সাথে সাক্ষাৎ করে চাল ফেরতের কথা বললেন কিন্তু সরকারী বরাদ্ধের চাল দেওয়া হলে ফেরৎ দেয়া কঠিন। তখন তিনি চাল নিয়ে গরিব কর্মীদের মাঝে রেশন দরে বিক্রি করে দেন। ফনি বাবু বললেন ” দেখুন সত্যিকার নেতা কাকে বলে, সততা কাকে বলে, সত্যিকার পার্টি কাকে বলে। এরকম আরও নেতা কর্মী ও পার্টি পেলে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে কোন অসুবিধা হতো না”।

অন্য আর একটি ঘটনা। স্বাধীনতার পর সিপিবি অফিসে যে টেলিফোনটি ছিল সে ফোনের বিল একবার বেশি হওয়ায় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করতে গিয়ে মণিসিংহ বলেছিলেন, সম্ভবত ভুল হয়েছে, আমার কাছে কয়টা টেলিফোন করা হয়েছে তার লিষ্ট রয়েছে। কর্তৃপক্ষ মিলে ঠিক করে নিয়েছিলেন। পরের বার বিল কম হওয়ায় আবার বললেন সম্ভবত কম হয়েছে, সঠিক বিলের অর্থ প্রদান করে এসেছেন। সময় সচেতন মণিসিংহ আত্মগোপন এবং প্রকাশ্য রাজনীতিতে সঠিক সময়ে মিটিং এ উপস্থিত থাকতেন। এজন্য বামপন্থি নেতা কর্মীরা সঠিক সময়কে ”মণিসিংহ টাইম” হিসেবে বলতেন এখনও প্রচারিত আছে।

বর্তমানে অর্থ পাচার, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট ধনী গরীব বৈষম্য, প্রবৃদ্ধি বাড়লেও গরীব আরো গরীব হচ্ছে। কমরেড মণিসিংহ আজীবন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন, মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন। কমরেড মণিসিংহ বলতেন” মার্কসবাদ লেলিনবাদ কোনো আপ্ত বাক্যের সমষ্টি নয়। বাস্তবতা, ঐতিহ্য, জনগনের চেতনার স্তর, প্রস্তুুতি অর্থাৎ প্রতিটি দেশের নিজস্ব বিশিষ্টতা ও অবস্থানকে বিবেচনার মধ্যে নিয়েই তার সার্থক প্রয়োগ সম্ভব। মাটি ও মানুষের নেতা ছিলেন তিনি। মানুষের মন বুঝতেন, মানুষের সাথে থাকতেন, নেতৃত্ব দিতেন এবং মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। সরদার ফজলুল করিম তার বইতে লিখেছেন ” যখন কৃষক সমাবেশে কমরেড মণিসিংহ বক্তব্য রাখতেন সমাবেশ স্থলে হাজংরা বলতো ” চুপ চুপ এখন আমাদের মনি বেটা বলছে। কবি শামসুর রহমান কমরেড মণিসিংহকে নিয়ে লেখা ”ভাস্কর পুরুষ” কবিতায় শেষ চারটি লাইন। প্রগতির প্রসিদ্ধ চার চারন জাগো, জেগে ওঠো, চেয়ে দ্যাখো, করোনি শাসন কোনদিন তবু বাংলাদেশ আজ তোমকেই গার্ড অব অনার জানায়।

মণি সিংহের স্বপ্ন এখনও বাস্তবায়িত হয়নি এ সংগ্রাম চলছে। তিনি শুধু কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নন। সাধারন মানুষের কাছে আর্দশিক নেতা, তার জীবন দর্শন আমাদের কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকুক। কমরেড মণসিংহের ১২০তম জন্ম দিবসে অতল শ্রদ্ধা।

লেখক: আসলাম খান, সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় সংগঠক, কমরেড মণিসিংহ মেলা উদযাপন কমিটি