শিল্প সাহিত্য

মধ্যসত্ত্বভোগী আল মাহমুদ: ৮ম পর্ব

– শোয়েব নাঈম

কবি আল মাহমুদ (ফাইল ছবি)
‘জলে মাছ-ডাঙায় হরিণ’ সাহিত্যে শান্তির সেই অমরতাবাণীর প্রাচীন অন্তর্গত অর্থ আত্মবিধ্বংসী লোভে এবং আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফাঁদে ফেলে ‘জলে কুমীর-ডাঙায় হিংস্র পশু’ এমন ইঙ্গিতে ‘লোক লোকান্তর’এর আল মাহমুদ ব্রতচারীর মতো বর্ণনায় আর অসরল চিন্তার অবয়বে ঘড়ির কাঁটার মতো বার বার ঘুরে আসা কুটিল ভাবনার প্রেক্ষাপটেই এ গ্রন্থে চিত্রিত করেছিলেন-
“কখনো অসৎ থাকা অকস্মাৎ উত্তোলিত হলে
দেখি সেই বিম্বিত পশুর-
দর্পিত হিংস্র চোখ আমাকেই লক্ষ্য করে জ্বলে;
চিবুক লেহন করে, সে অলীক মুহূর্তের ক্রোধ
জয় করে দেখি আমি, কেবলই আমার মধ্যে যেন এক
শিশু আর পশুর বিরোধ।”
 – বিষয়ী দর্পণে আমি/ লোক লোকান্তর ।
ষাটের দশকের আন্দোলনে প্রকম্পিত এই ভূখন্ডের ধুলাভেদী বাঙালি জাতীয়তাবাদ শক্তির উত্থানকে উপেক্ষা করে নিজেকেই ক্রমোৎসারিত বিকল্প শক্তির উদ্বোধক এই ভাবনা থেকে আল মাহমুদ লিখেছিলেন-
“জীবিকাবিজয়ী দেহে কোন ঘরে দাঁড়াবোরে আজ
কাকের ধূর্ততা নিয়ে ফিরছি তো এখানে ওখানে
খুঁজছি জলের কণা থর থর ধুলোর তুফানে
এখন বুঝছি মানে-এও এক নারকী সমাজ;
জলসত্র নেই কারো এই শেষে মেনে নিলো মন,
ধুলোকে এড়িয়ে আর কারো ঘরে যাবো না এখন।”
    – তৃষ্ণার ঋতুতে/ লোক লোকান্তর ।
কালান্তরব্যাপী কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের চেতনায় তীব্রভাবে প্রবাহিত ছিল নিজ ভাষার সাথে একটি স্বাধীন নিজ জন্মভূমি, কোন এক অশুভ রূপের প্রভাবে এমন জাতীয় জাগরণের সাথে ইতিবাচকতায় সাড়াও দিতে পারেনি যৌবনের প্রতীকের মতো ২৭ বছরের আল মাহমুদ যখন প্রকাশিত ‘লোক লোকান্তর’ কাব্যগ্রন্থখানি। সেই উত্তালের মহালগন থেকে নিজেকে ব্যক্তি-আকাঙ্ক্ষার আলখেল্লায় ঢেকে রেখে জাতীয় চেতনাহীন সমান অন্ধকারে লিখেছিলেন-
” একদিন ঘরে এসে হৃদয়ের প্রিয় শয়তান
ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলো টেবিলের মোম
নির্বিকার দেহ ঢেকে অন্ধকার আলখেল্লার নিচে
ম্লান হেসে বিছানায় বসে
মায়াবী কথার ফাঁকে বোঝালো সে: প্রভুর শহরে
আমি নাকি যেতে পারি! অপরুপ নিষিদ্ধ বিতান
পার হয়ে, চোখের পলকে
অলৌকিক ফলবতী বৃক্ষের নিচে।
বললাম, তীক্ষ্মধার আমার কিরিচে
অলৌকিক স্পর্ধা দাও। ঈশ্বরের অপরুপ ফল
আমি যেন বিদ্ধ ক’রে নিতে পারি । যেন
ভাগ করে দিতে পার- আমার সে প্রিয়তমা নারীকে কেবল ।”
   – অন্ধকারে একদিন/ লোক লোকান্তর ।
১৯৬২ সালে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার উপর পাকিস্তানী রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারির বিরুদ্ধে যখন এদেশের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে বাঙালি প্রতিবোধন জাগরণীর বহুমাত্রিক, বহুকৌণিক আন্দোলন অব্যাহত রাখেছিল তখন ‘লোক লোকান্তর’-এর এই কবি বিদ্রুপাত্মক ভাষায় সেই ঐতিহাসিক আলোড়নের প্রতিকূলে অবস্থান নিয়ে তার অভিপ্রায় এভাবে প্রকাশ করেছিলেন-
” মানুষের শিল্প সে তো নির্বোধের নিত্য কারিগর
রুমালের আঁকা দাগে রঙিন সুতোয় ফুল তোলা,
সাপের অলীক চিত্রে নির্বিষ সাজানো কালো দড়ি
কাদার মূর্তিতে কারো সাধ্যমত আঁটা পরচুলা।”
  – আমরা পারি না / লোক লোকান্তর ।
ছলে কৌশলে দুঃখবিলাসী মনে এভাবেই এগোতে চেয়েছিলেন একাকী আল মাহমুদ সময়ের হাত ধরে অন্তহীন ছলনায়-
“দার্শনিকের ছাত্রের মতো আমি তো তখন
নালান্দার সে প্রকোষ্ঠে বসে মৃত দর্শন
হাতড়ে মরেছি, মেধাবী মনের ঢেলে ঢেলে রস
উচ্চাঙ্ক্ষা হৃদয়ে পুষেছি বিত্ত ও যশ
ঝুলি ভরে নেবো।
দু’চোখে রাঙাবো বোকাদের চোখে।
দু’হাত ঘুরিয়ে সময়ের স্রোতে দেবো তাল ঠুকে।”
  – স্বীকারোক্তি / লোক লোকান্তর ।
সেই ‘লোক লোকন্তর’ এর কাল থেকেই স্বরূপধারণ করা এই আল মাহমুদ চিন্তায় ছিলেন এলোমেলো, স্বভাবে তৃষ্ণার্ত বিত্ত বৈভবে, আর আচরণে পূর্বলক্ষণীয় মধ্যসত্ত্বভোগীতে । চিতল হরিণী যখন দ্রুতগামী দৌড়ের ক্লান্তিতে পিপাসায় মুখ নামায় ঝরণার প্রস্রবণে , তখন সেসব নির্বিরোধ অনিন্দনীয় সুন্দরের এক হিংস্র শিকারির প্রতীকী’র মতো ছিলেন আল মাহমুদ সাহিত্যের অঙ্গণে ।
( চলবে….)
শোয়েব নাঈমঃ কবি ও প্রান্ধিক