মতামত

কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী : মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত জীবন

– ডা. জয়দীপ ভট্টাচার্য্য

কমরেড মবিনুল হায়দার চৌধুরী

কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী কিংবা তাঁর দল বাসদ (মার্কসবাদী)’র বিরাট প্রচার ও প্রতিষ্ঠা ছিল না। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে বিভন্ন মহলে যে শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটেছে সেটা নেহাৎ ছোট নয়। বোঝা যায়, যার হৃদয়েই তিনি স্থান নিয়েছেন, সেই স্থান হৃদয়ের অত্যন্ত গভীরেই ছিল। কমরেড মুবিনুল হায়দার কারোর জীবনেই ভাসা ভাসা আবেগের উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন না। এ কারণে দীর্ঘদিনের সংযোগবিহীন অনেকের কাছেও তিনি জীবন্ত। চর্চাবিহীন আবেগও এত তীব্র হতে পারে – এটা হয়তো তাঁর মৃত্যু না হলে বোঝা যেতো না।

কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৫ সালে, ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতের চট্টগ্রাম জেলার বাড়বকুণ্ডে। খুব অল্প বয়সে তিনি তাঁর বাবা ও মা দুজনকেই হারান। স্থানীয় মাহমুদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ফোর পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। বাড়বকুণ্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে নেন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন আবু তোরাব হাই স্কুলে।
কলকাতার খিদিরপুরে থাকতেন তাঁর বড় ভাই নাসিরুল হায়দার চৌধুরী। ১৯৪৫ সালে তিনি তাঁর কাছে যান। ভর্তি হন খিদিরপুরের সেন্ট বার্নাবাস স্কুলে। সেখানে ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৫০ সালে তিনি আবার চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। ভর্তি হন কাজেম আলী স্কুলে। কিন্তু লেখাপড়া কয়েক মাসও এগোয়নি। স্কুলের মাঠে নৌ বাহিনীর সৈন্য সংগ্রহের বাছাই চলছিল। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে যান। সুঠাম দেহ ছিল তাঁর। খেলাধুলা ভীষণ পছন্দ করতেন, বিশেষ করে ফুটবল খেলা। ফলে বাছাইয়ে টিকে যান। বাড়িতে না জানিয়েই চলে যান ট্রেনিংয়ে। প্রথমে কলম্বো, তারপর পশ্চিম পাকিস্তানে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর উদ্দাম, স্বাধীন মন। ফলে সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা তাঁর পায়ে যেন শৃঙ্খল হয়ে জড়িয়ে ধরলো। বেরিয়ে এলেন বাহিনী থেকে। যেভাবে এলেন সেও এক অনন্য গল্প।
দেশে ফিরে এসে আবার পাড়ি দিলেন কলকাতা। ১৯৫০ সালটা তখনও চলছে, কিন্তু শেষ হতে চলেছে। এই বছরটা তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বছর। অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে বলে নয়, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ঘটনা ঘটেছে বলে। ১৯৫০ এর শেষের দিকে খিদিরপুরে তাঁর সাথে পরিচয় হয় ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ‘সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া (এসইউসিআই)’ এর নেতা মনোরঞ্জন ব্যানার্জীর সাথে। তিনি খিদিরপুরে ডক শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতেন। মনোরঞ্জন ব্যানার্জী সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যুবক হায়দারকে নিয়ে যান এ যুগের বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তাবিদ ও নেতা, এসইউসিআই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের কাছে। কমরেড হায়দার শিক্ষা ও দীক্ষা নিলেন যুগ রচনাকারী শিক্ষকের কাছ থেকে, মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর দেখানো পথে তিনি ছিলেন অবিচল।
কমরেড মুবিনুল হায়দার ১৯৫১ সালে প্রথমে খিদিরপুর এলাকায়, পরে বার্ড কোম্পানির লেবার ইউনিয়নে সংগঠন শুরু করেন। এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে তিনি খিদিরপুরে ডক শ্রমিকদের, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত করেছেন, কর্মী সংগ্রহ করেছেন, পার্টি ইউনিট গঠন করেছেন। জেলে যান প্রথম ১৯৫৩ সালে ১ পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনে, দ্বিতীয়বার ১৯৫৪ সালে শিক্ষক আন্দোলনে, তারপর ১৯৫৯ সালের ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনে।
এইভাবে বারবার জেলে যাওয়া ও পুলিশি আক্রমণের মুখে যখন তিনি পড়ছিলেন, তখন সরকারি চাকুরিরত বড় ভাই নাসিরুল হায়দার আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কমরেড মুবিনুল হায়দারকে তাঁর বড় ভাইয়ের আশ্রয় ছাড়তে হল। সময়টা ১৯৫৪ সাল। ওই সময়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ এবং এসইউসিআই-এর কেন্দ্রীয় নেতাদের কোনও স্থায়ী থাকার জায়গা ছিল না, খাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল না। কমরেড মুবিনুল হায়দারকেও আশ্রয়চ্যুত হয়ে অনেক দিন অর্ধাহারে-অনাহারে কলকাতার পার্কে-ফুটপাতে রাত কাটাতে হয়েছে। কিন্তু কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত এই সংগ্রামী মানুষটি শোষিত মানুষের বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্য থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।
১৯৬৪ সাল। ভারতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলো। উদ্বিগ্ন কমরেড শিবদাস ঘোষ সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে দেশের হিন্দু-মুসলমান ছাত্র যুবক ও বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করার জন্য কমরেড মুবিনুল হায়দারকে দায়িত্ব দেন। চ্যালেঞ্জ নিতে কমরেড হায়দার সবসময়েই প্রস্তুত ছিলেন। তিনি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরা শুরু করেন। কলকাতায় তাঁরই উদ্যোগে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এক বিশাল কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই দলের সংগ্রামী যুব সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ অর্গানাইজেশন (এআইডিওয়াইও)’ গড়ে ওঠে, যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন কমরেড মুবিনুল হায়দার। ১৯৬৭ সালে তাঁকে দিল্লিতে পাঠানো হয় এবং তিনি দিল্লি ও হরিয়ানায় এসইউসিআই(সি)-এর সংগঠন গড়ে তোলেন।
তাঁর প্রথাগত শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি, ক্লাস এইট পর্যন্তই। কিন্তু তাঁর জানার ও শেখার স্পৃহা ছিল বিপুল। কমরেড শিবদাস ঘোষের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। কমরেড শিবদাস ঘোষ তাঁর কর্মীদের সামনে জ্ঞানজগতের সর্বদিক ব্যাপ্ত করে তাঁর অনন্যসাধারণ আলোচনাগুলো রাখতেন।  সেসময় যে পাঠচক্রগুলো কলকাতায় হতো সেখানে হয়তো ১৫/২০ জন কমরেড উপস্থিত থাকতেন। সিপিআই-এর মতো প্রভাবশালী ও বিরাট পার্টি থাকার পরও অল্প কিছু সহযোদ্ধা নিয়েই কমরেড শিবদাস ঘোষ যথার্থ বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার এক কঠিন ও কষ্টকর সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। তখন ল্যান্সডাউন রোড ও রাসবিহারি এভিনিউ এর মোড়ে ৫ নং সিদ্ধেশ্বরী রোডের পাশে আরেকটি লেনে কমরেড আশুতোষ মুখার্জীর(পরবর্তীতেএসইউসিআই কেন্দ্রীয় কমিটি-র সদস্য) বাসা ছিল। সেখানে পাঠচক্র হতো। কমরেড মুবিনুল হায়দার খিদিরপুর থেকে হেঁটে সেখানে চলে আসতেন, কোন দিন বাদ পড়তো না। এই পাঠচক্রগুলোই তাঁর মার্কসবাদী চেতনার ভিতটা গড়ে দেয়।
এসকল পাঠচক্রে কমরেড শিবদাস ঘোষ সমাজ বিকাশের ইতিহাস-দর্শন-বিজ্ঞান-সাহিত্য-শিল্প-অর্থনীতি সহ জীবনের সমস্ত কিছুকে দেখার মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, সমসাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিশ^ সাম্যবাদী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক করতেন। তিনি বিপ্লবী জীবন নিয়ে বলতেন, তাঁর মহত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতেন। জ্ঞানচর্চার সাথে অনুশীলনের কোন পার্থক্য যে বিপ্লবীদের থাকতে পারে না সেটা তিনি বলতেন শুধু নয়, তাঁর নিজের জীবন এক্ষেত্রে ছিল সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। পরবর্তীকালে কমরেড হায়দার যখন বাংলাদেশে আসেন, তখন বাংলাদেশের বহু ছাত্র-যুবক ও বুদ্ধিজীবীদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন এ কারণেই। জ্ঞান ও আদর্শের এই সৌন্দর্য, এই তেজ, এই দৃঢ়তা নতুন স্বাধীন হওয়া দেশের তরুণ-যুবকদের ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করেছিল। জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মেজর জলিল একসময় কমরেড শিবদাস ঘোষের ‘কেন এসইউসিআই ভারতবর্ষের মাটিতে একমাত্র  সাম্যবাদী দল’ লেখাটি পড়ে বলেছিলেন, “হায়দার ভাই, এ তো পীর-দরবেশের কথার মতো। আমি তো মনে হয় এই লড়াই করতে পারবো না।”
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কমরেড হায়দার সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবিরগুলি ঘুরে বেড়াতে থাকলেন। সাথে চললো পার্টির পক্ষ থেকে ত্রাণকার্য পরিচালনা। তিনি প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিতে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। তিনি এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশে আসলেন ১৯৭২ সালের মে মাসের দিকে। তাঁর চোখে ছিলো মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে একটি যথার্থ বিপ্লবী দল গঠনের স্বপ্ন। কারণ ইতিমধ্যেই দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে ছাত্রলীগের এক অংশের মধ্য থেকে। তিনি কলকাতায় থেকে সেটা শুনেছেন, গণকন্ঠের মে দিবস সংখ্যা পড়েছেন।
মনে রাখতে হবে, সেইসময়ে তিনি এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলের কোনও প্রতিষ্ঠিত নেতা ছিলেন না, একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন মাত্র। এইসময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবন তথা সামাজিক জীবন এক সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছিল। একদিকে বহু শহীদের আত্মদানে অর্জিত স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্যবহার করে আপসকামী বুর্জোয়া নেতৃত্ব ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। তারা পাকিস্তানি অত্যাচার-শোষণের পরিবর্তে বাংলাদেশী শোষক-লুটেরাদের শাসন কায়েম করেছে। অন্যদিকে ছাত্র-যুব সমাজ ও জনগণের মধ্যে শোষণমুক্ত সামাজিক ব্যবস্থা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকুতি সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু তাঁদের সঠিক পথ দেখাবার মত কোনও যথার্থ বিপ্লবী দল ও নেতৃত্ব ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে কমরেড শিবদাস ঘোষের অমূল্য শিক্ষা ও অসাধারণ সংগ্রামের দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এক কঠিন ও কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হন। সেইসময় তারঁ কোনও পরিচিতি ছিল না, সঙ্গী-সাথী ছিল না, যোগাযোগ ছিল না, থাকা-খাওয়ার সংস্থান ছিল না। অন্যদিকে এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) ও কমরেড শিবদাস ঘোষও বাংলাদেশে অপরিচিত নাম ছিল। এই অবস্থায় কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক চিন্তাসম্বলিত কয়েকটি পুস্তিকা ও পত্রিকা হাতে নিয়ে তিনি নানাস্থানে ঘুরেছেন, বিভিন্ন বামপন্থী দলের নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবী যাকেই পেয়েছেন, তাঁকেই এইসব বই দিয়েছেন, নিজের উপলদ্ধি অনুযায়ী মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে আলোচনা করেছেন।
এই প্রক্রিয়ায় সদ্য সংগঠিত যৌবনোদ্দীপ্ত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল(জাসদ)-এর অনেক নেতৃবৃন্দ ও সংগঠক তাঁর রাজনৈতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি আকৃষ্ট হন। জাসদের কোনো স্তরের সদস্য কিংবা সাংগঠনিক দায়িত্বে না থাকার পরও ওই দলটির নেতৃত্বের একাংশের ওপর তিনি আদর্শগত ছাপ ফেলতে সমর্থ হন। জাসদ—এর অভ্যন্তরে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া ছিল – তাকে পথ দেখানোর ক্ষেত্রে কমরেড মুবিনুল হায়দার এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি জাসদের বিভিন্ন স্তরে যতটুকু মাত্রায় যোগাযোগের সুযোগ পেয়েছেন, ততটুকু বাংলাদেশের সমাজ-রাষ্ট্রের চরিত্র বিশ্লেষণের মার্কসীয় বিচারধারা ও কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার আলোকে সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী দল গঠনের নীতিগত ও পদ্ধতিগত সংগ্রামের শিক্ষা নিয়ে গেছেন। তাঁর সাথে যারা ঘনিষ্ঠ হয়েছেন, তাদের বিপ্লবী কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় বিপ্লবী দল গড়ে তোলার আদর্শগত ও সাংগঠনিক সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর মাধ্যমে শিক্ষিত হয়ে ওঠেন জাসদ-এর একদল নেতা-কমী। পরবর্তীতে জাসদ নেতৃত্বের প্রথমে হঠকারিতা, পরে আপোষকামিতা এবং রাজনৈতিক-সাংগঠনিক ভ্রান্তির বিরুদ্ধে এদেরই একটি অংশ দলের অভ্যন্তরে মতাদর্শগত সংগ্রাম শুরু করেন।
এই নেতাকর্মীদের নিয়ে তিনি ১৯৮০ সালে ‘প্ল্যাটফর্ম অফ অ্যাকশন’ হিসাবে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল(বাসদ) গড়ে তোলেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে নতুন করে বিপ্লবী দল গড়ে তোলার এই সংগ্রামের মূল কেন্দ্র ছিলেন কমরেড মুবিনুল হায়দার। তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হলেও তাঁর নাম তখন প্রকাশ করা হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান নেতৃত্বে না থাকলেও বাসদ-এর অন্য সকল নেতাদের কাছে তিনি শিক্ষক ও নেতা হিসাবেই গণ্য ছিলেন। সঠিক লাইন ও সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের বিপর্যয় ও আধুনিক সংশোধনবাদের বিকাশ সম্পর্কিত যথার্থ মূল্যায়ন, বাংলাদেশের উৎপাদনপদ্ধতি-রাষ্ট্রচরিত্রসহ প্রসঙ্গে নতুন রণনীতি-রণকৌশল তুলে ধরা, রবীন্দ্র-শরৎ-নজরুল সহ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে মার্কসবাদী বিচারধারা, শিক্ষা আন্দোলনে বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা, সর্বহারা নৈতিকতা ও সংস্কৃতির আধারে কর্মীদের গড়ে তোলার প্রচেষ্টা – ইত্যাদি এদেশের বাম রাজনীতিতে বাসদ-এর একটি বিশিষ্ট অবস্থান তৈরি করে। বাসদ কর্তৃক ঘোষিত জীবনের সর্বক্ষেত্রব্যাপী মার্কসবাদ চর্চার লক্ষ্য নির্ধারণ, ‘দলই জীবন, বিপ্লবই জীবন’ – এই ধারণা, নেতা-কর্মীদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতার দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট যৌথজ্ঞানের ভিত্তিতে যৌথ নেতৃত্বের বিশেষীকৃত রূপ গড়ে তোলা, কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও সম্পত্তিজাত মানসিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম, গণচাঁদার ভিত্তিতে দলের আর্থিক ভিত্তি দাঁড় করানো, ব্যক্তিগত পরিবারকেন্দ্রিক জীবনের স্থলে পার্টি মেস-সেন্টার গড়ে তুলে সার্বক্ষণিক বিপ্লবীদের দলকেন্দ্রিক যৌথজীবনের ধারণা, জনগণের ওপর নির্ভরশীল সার্বক্ষণিক কর্মী বা পেশাদার বিপ্লবী গড়ে তোলা, ব্যক্তিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথে যৌথস্বার্থ ও যৌথচেতনাকেন্দ্রিক দলীয় সংস্কৃতি নির্মাণ – এই সকল ধারণা দলে নিয়ে আসা ও চর্চার ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা পালন করেছেন কমরেড মুবিনুল হায়দার।
২০১৩ সালে বাসদ-এর অভ্যন্তরে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা নিয়ে মতাদর্শিক বিতর্কের ফলাফলে গঠিত হয় বাসদ(মার্কসবাদী)। তখন তাঁর বয়স ৮০ বছর। এই বয়সেও আদর্শের প্রশ্নে নিরাপদ জীবন ছেড়ে নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে তিনি দ্বিধা করেননি। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী আমৃত্যু এই দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর জীবন রোমাঞ্চকর উপন্যাসের মতো। তিনি চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে দিল্লী আর হরিয়ানা, সেখান থেকে বাংলাদেশ – বিপ্লবের বাণী নিয়ে চষে বেরিয়েছেন। ইউরোপের অনেকগুলো দেশে বেশ কয়েকবার তিনি গেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য। সেখানে রাজনৈতিক বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে আমেরিকা-নেদারল্যাণ্ড-রাশিয়া—সুইজারল্যাণ্ডসহ বেশ কিছু দেশের বাম নেতৃবৃন্দের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছেন। এদেরকে সংগঠিত করে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ফোরাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম নেতৃত্বকারী ভূমিকা ছিল।
যারা তাঁকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, তাদের প্রায় সকলের বক্তব্যে একটি কথাই ঘুরেফিরে এসেছে যে – কমরেড মুবিনুল হায়দার তাদের জীবনবোধকেই পাল্টে দিয়েছেন। তাঁর সংস্পর্শে ও আলোচনা শুনে পুঁজিবাদী সমাজের প্রচলিত জীবনবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা ঝাঁকুনি লাগতো। অনেকের সাথে তিনি সরাসরি রাজনীতির কথাও বলতেন না। তাদের পছন্দের বিষয় থেকে শুরু করতেন, তারপর আলোচনা করতে করতে পুঁজিবাদে চলে আসতেন। তিনি এই সমাজে জীবনের ব্যর্থতা-গ্লানিকে দেখাতেন, মানুষ কিভাবে অপমানিত-ছোট-সংকীর্ণ হয়ে আছে তা তুলে ধরে উন্নত মানবিক জীবনের আকুতি জাগাতেন। প্রশ্ন তৈরি করে দিতেন, ‘বলো, এর জন্য কে দায়ী?’ পুঁজিবাদী চিন্তায় যাকে সুখ মনে করে আমরা তৃপ্ত হই, যাকে মোক্ষ বলে আমরা প্রাণপণ ছুটতে থাকি – তিনি সেসবের মধ্যে নিহিত আত্মকেন্দ্রিকতা-স্বার্থপরতাকে দেখিয়ে দিতেন। তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলতেন, মানুষের মুক্তি ও বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করার মধ্যে যে আনন্দ-সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব – তাঁর প্রতি আকর্ষণ জাগাতে চাইতেন। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে সৃষ্ট মানুষের সীমাহীন কষ্ট-দুঃখের ছবি তিনি চোখের সামনে আঁকতেন। অর্থনৈতিক সংকট  আঁকতেন , সাংস্কৃতিক সংকটও  আঁকতেন । তিনি দেখাতেন মানুষের সাংস্কৃতিক সংকট কেন অসহ্য হয়, কেন তাঁর পীড়ন কখনও কখনও তাঁর অর্থনৈতিক সংকটকেও ছাড়িয়ে যায়। তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন, ‘তুমি কী করবে বলো? দাসত্ব না মর্যাদা – তুমি কোন্ টা নেবে?’
রাজনৈতিক তত্ত্বের শরীরে এতটা প্রাণসঞ্চার করতে তাঁর মতো অন্য কেউ পারতেন কি না জানি না। তাঁর শরীরের প্রত্যেকটা কোষ যেন বিপ্লবের জন্য হাহাকার করতো। সারা দুনিয়ার বড় চরিত্র – যারা বিভিন্নক্ষেত্রে মানুষকে এগিয়ে দিয়েছেন, ভারতবর্ষের রেনেসাঁ আন্দোলনের মনীষী, বড় বিপ্লবী এবং মার্কসবাদী আন্দোলনের অথরিটিদের শ্রদ্ধা করা ও তাদের গুণ থেকে শেখার ওপর তিনি সবসময় অত্যন্ত জোর দিতেন। গভীর আবেগ দিয়ে বড় মানুষদের সংগ্রাম ও মহত্ত্বের কথা বলতে বলতে অনেকসময় তাঁর নিজের চোখে জল ঝরতো, শ্রোতাদেরও কাঁদাতেন। মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে মার্কসবাদী বিপ্লবী রাজনীতি গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘ সাত দশক ধরে অবিশ্রাম লড়ে যাওয়া কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর শূন্যতা এক বিরাট ক্ষতি। তিনি বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে ল্যাম্পপোস্ট হয়ে অনেক দূরের পথ দেখাবেন।

ডা. জয়দীপ ভট্টাচার্য্যঃ চিকিৎসক, সহ-সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট