মতামত

রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকাঃ যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে নয়া-অর্থনীতি (৪র্থ পর্ব)

-যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ (War Communism)

-অধ্যাপক সুস্নাত দাশ

কৃষি  ক্ষেত্রের তুলনায় যুদ্ধকালীন সাম্যবাদের প্রভাব শিল্পের ক্ষেত্রে বেশি পরিমানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল এবং অধিক পরিমানে তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিল। যখন শান্তির লক্ষে নির্দিষ্ট কর্মসূচীতে ফিরে যাবার প্রয়োজন হলো তখন এরফলে পুনর্বার উৎপাদনের ধরন ধারনটাও গেল পাল্টে। যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ সমস্ত বড় শিল্পকেই পরিনত করে ছিল লাল ফৌজের প্রয়োজন মেটাবার ও নিয়মনীতি উপেক্ষা করেই প্রতিটি সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হত জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে।

E H Car –এর মতে “যুদ্ধকালীন সাম্যবাদে সময়কালে আসল ঘটনা শিল্পের জাতীয়করনের নয় – সমাজতান্ত্রিক পথে শিল্পকে চালিত করার প্রচেষ্টাই হল আসল ব্যাপার।“ এই নীতিটি হল নৈতিক দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাদকতাকে সম্পাদন করা। কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বে পরিচালিত একক অছি-ব্যবস্থায় প্রতিটি শিল্পকেই শ্রেণীবদ্ধ করা হয় এবং তা সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থারূপে Vesenekha-এর কাছেই ছিল দায়বদ্ধ। ১৯১৯ সালের শেষ দিকে এই ধরনের প্রায় ৯০ টি সরকারি অছি-ব্যবস্থা গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু জাতীয়করণের কাজ নানা প্রবণতা ও আবেগের দ্বারা এমনভাবে চালিত হল, আর যা ছিল বিরাট আকারের প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য, তাতে দেখা গেলো যে অনেক বিভ্রান্তি ঘটে গিয়েছে, এমনকি সঙ্গীতের প্রকাশনা এবং তা মুদ্রণের শিল্প কিংবা মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক শিল্পকেও রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছে।

লেনিন তাঁর ‘খাঁটি কমিউনিজম’ ( pure Communism) পরীক্ষা সম্পূর্ণ সফল না হওয়ায় এক নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বা নীতি গ্রহণ করেন। এই ব্যবস্থা ১৯২১ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চালু ছিল। এই নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা (New Economic Policy NEP 1921-1928) পরিস্থিতির খাতিরে যতদূর পর্যন্ত কমিউনিজম কার্যকরী রাখা সম্ভব হয় ততটুকুই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এই নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে কৃষি, শিল্প প্রভৃতিতে এক দ্রুত উন্নয়ন শুরু হয়।

লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়ায় নয়া অর্থনৈতিক নীতি (NEP) প্রবর্তন সোভিয়েত ইতিহাসবিদদের মতে, বিপ্লবের পরে গৃহীত ‘নয়া অর্থনৈতিক নীতি’কে (NEP) সর্বহারা শ্রেণির নীতি বলা যায় না। গৃহযুদ্ধের অবস্থাতেই শুধু এটিকে যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকার করে। E H Car এর মতানুসারে NEP এর শুরু থেকেই ছিল কৃষির জন্য গৃহীত নীতি এবং আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। শিল্পের ক্ষেত্রে সরবরাহ ব্যতীত কোন ভূমিকাই ছিলনা। এই সময় শিল্পোৎপাদন পঙ্গু হয়ে যায়, খাদ্য ও কাঁচা মালের অনেক বেশি পরিমান সরবরাহ ব্যতীত বৃহৎ শিল্প সংস্থা সমূহকে চালু করাও সম্ভব ছিলনা।

বিনিময়ের প্রক্রিয়া ছাড়া এই সব দ্রব্যাদি পাওয়া যেতনা। লেনিন এই সময় ঘোষণা করলেন, আন্তরিক ও ধারাবাহিকভাবে বৃহদায়তন কারখানাগুলোকে চালু করতে হলে রাশিয়ার পক্ষে প্রয়োজন ক্ষুদ্রয়াতন শিল্পের পুনরুজ্জীবন। ১৯২১ সালের মে মাসের শেষে অনুষ্ঠিত পার্টি সম্মেলনে এই প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য চার দফা নীতি-ভিত্তিক একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সেই চারটি নীতি হল – ১) বেসরকারী ও সমবায় পরিচালিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থাগুলিকে সমর্থন প্রদান,  ২) সরকারী সংস্থাগুলিকে ব্যাক্তি-মালিক, সমবায় সংস্থা, যৌথ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং সমিতির কাছে ইজারা দেয়ার জন্য অনুমতি প্রদান; ৩) সাধারণ মানুষের উপযোগী এবং প্রতিটি কৃষক ব্যবহার করতে পারে এমন ভোগ্যপন্য উৎপাদনের লক্ষকে শক্তিশালি করার উদ্দেশ্য নিয়ে বৃহদায়তন শিল্পের কর্মসূচীর আংশিক পর্যালোচনা, ৪) আর্থিক এবং বাস্তব সম্পদকে সুবিন্যস্ত করার উদ্দেশ্যে প্রতিটি বৃহদায়তন শিল্প সংস্থার উদ্যোগকে ব্যাপকতর করা। শিল্পের ক্ষেত্রে নতুন অর্থনৈতিক নীতি (NEP)’র প্রথম পদক্ষেপ ঘটে ১৯২১ সালের মে মাসে, Sovnarkhom কর্তৃক দুটি ডিক্রি জারীর মাধ্যমে। পূর্বে জারী করা যে ডিক্রি বলে উৎপাদকদের দ্বারা ঘটিত সমবায়-সংস্থা গুলির কর্মকান্ড ও ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল, সেগুলিকে বাতিল করে দেয়া হয় এবং সমস্ত শিল্প –সংস্থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত করার জন্য ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসে যে ডিক্রি জারী জারী করা হয় তারও প্রয়োগ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ১৯২১ সালের ১৭ই মের আগে যে শিল্প সংস্থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছিল সেগুলির ক্ষেত্রে তা প্রত্যাহার করা হয়না। যা হোক, ১৯২১ সালে সমগ্র গ্রীষ্মকাল জুড়ে পরপর অনেকগুলো ডিক্রি জারীর মাধ্যমে শিল্প সমবায় গুলিকে প্রদান করা হয় দারুণ উৎসাহ। এমন কিছু আইনগত অধিকারও তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় যে, সে অধিকারগুলো তারা সদস্য-সংখ্যার শতকরা ২০ ভাগ পর্যন্ত ভাড়াটে শ্রমিক নিয়োগ করতে পারতো এবং এইসব সংস্থার উপর “শ্রমিক-কৃষকদের অবেক্ষক গণ কমিটিরও” নিয়ন্ত্রণমূলক বা কর্তৃত্ব করার কোন ক্ষমতা ছিলনা। ফলে সরকারী সংগঠনের অপদার্থতার হাতকে এইসব শিল্প সমবায়গুলি এড়াতে সক্ষম হয়েছিল। এরা আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী সমবায় শাখাগুলির কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদী বা স্বল্প মেয়াদী ঋন গ্রহণ করতে পারতো। গ্রামীণ ও ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থাগুলির ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে উৎসাহ বর্ধক নানা সুযোগ- সুবিধা প্রদান করা হতো।

বলশেভিক (কমিউনিস্ট) পার্টির সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে পদক্ষেপ হিসেবে যে ব্যবস্থা অবলম্বন করার কথা ঘোষণা করা হয় তা হল- বেসরকারি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন। অর্থাৎ শিল্প সংস্থাগুলিকে বেসরকারি পরিচালকদের কাছে ইজারা প্রদান। এই সুপারিশ অনুযায়ী ডিক্রি জারির অপেক্ষায় না থেকেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত কাজ করতে শুরু করে দেয়। কিন্তু ১৯২১ সালের ৬ জুলাই Sovnarkhom এক ডিক্রি জারি করে কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে ইজারা দেওয়া বাঞ্ছনীয় বলে গণ্য হবে সেই শর্তগুলি তুলে ধরে। ব্যক্তি-মালিককে ইজারা দেওয়া বাতিল করে না হলেও এ ব্যাপারে সমবায়গুলিকেই দেওয়া হয় অগ্রাধিকার। সাধারণত ইজারার মেয়াদ নির্দিষ্ট করা হয় ২ থেকে ৫ বছর। ইজারা গ্রহণকারীদের ইজারা প্রদত্ত সম্পত্তির জন্য রাষ্ট্রের দেওয়ানী ও ফৌজদারি আইনের বিধিবিধান মান্য করে চলার এবং জবাবদিহি করার দায় বহন করতে হত। ইজারা গ্রহণকারীদের উপরেই ন্যস্ত ছিল সংস্থাগুলির সরবরাহ ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখার এবং শ্রমিকদের দায়-দায়িত্ব বহন করার সম্পূর্ণভার। ডিক্রির ফলে স্থানীয় উদ্যোগ শুরু হয়ে যায় এবং স্থানীয় ছোটো শিল্প-সংস্থার ক্ষেত্রেই তা কার্যকর হয়। একটি পরিসংখ্যান থেকে তা জানা যায় যে, ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইজারা প্রদত্ত সংস্থায় কর্মসংস্থানের হার হয় শতকরা ২০ ভাগেরও কম। ইজারা প্রদত্ত সংস্থাগুলির পুঁজি ছিল খুবই সামান্য এবং সেগুলি প্রধানত স্থানীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারেই মাল সরবরাহ করত।

যা হোক, পার্টির মধ্যে কট্টরপন্থী গোঁড়া সদস্যেরা মনে করতেন ব্যক্তিগত মালিকানার এবং ইজারা প্রদানের নীতি সমাজতন্ত্রবাদের শক্তিভিত্তির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার এক নজির। ব্যক্তিমালিকানাধীন ও ইজারা প্রদত্ত সংস্থার সদস্য যাই হোক না কেন শিল্প শ্রমিকদের ৮৪.৫% কিন্তু নিযুক্ত ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিতে। আর এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিরই উৎপন্ন পণ্যের মূল্য ছিল সমগ্র উৎপাদন মূল্যের ৯২.৪%। সুতরাং বলা যায় অসংখ্য ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থার ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানা ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনার স্বীকৃতিটাই এই নতুন শিল্পনীতির প্রধান গুরত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। এই নতুন শিল্পনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল- রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহদায়তন শিল্প সংস্থাগুলিকে ভোগ্যপন্য উৎপাদনের জন্য শক্তিশালী করতে এবং সেগুলির নিজস্ব উদ্যোগ এবং স্বাধীন বিকাশের পথ উন্মুক্ত করার জন্য এর পরিচালনা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। ১৯২১ সালের ৯ আগস্টে Sovnarkhom ‘নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নীতিগুলিকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ সম্পর্কে’ যে নির্দেশ পাঠায় সেটাকেই বলা যায় প্রথম প্রধান (NEP) ডিক্রি। এই নির্দেশ জারি করা হয়েছিল প্রধানত বৃহদায়তন শিল্প-সংস্থার উদ্দেশে। এই নির্দেশে গ্রামীণ শিল্প এবং ক্ষুদ্রায়তন শিল্পকে বড়ো শিল্পেরই সহায়ক শিল্প রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যে সব শিল্প সংস্থাগুলি ঐ সব শ্রেণীভুক্ত নয়, সেগুলোকেই সমবায়ের কিংবা কোনো ব্যক্তি মালিকের কাছে ইজারা দেওয়া যেত অথবা বন্ধ করে দেওয়া যেত। কিন্তু সরকারি সংগঠনের প্রত্যক্ষ পরিচালনার মধ্যে যেসব সংস্থাগুলিকে আনা হয়, সেগুলিকে যথাযথ আর্থিক হিসাবনিকাশের ভিত্তিতে চালনা করা হত।

সমস্ত ধরনের ক্ষুদ্র শিল্প- তা রাষ্ট্রায়ত্ত না হোক কিংবা ইজারা প্রদত্ত হোক, যেসব উৎসাহবর্ধক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহদায়তন শিল্প-সংস্থার ক্ষেত্রেও তা সম্প্রসারিত করা হয়। বৃহদায়তন শিল্প সংস্থাকে প্রত্যক্ষ সরকারি পরিচালনার আওতা থেকে সরিয়ে আনা হয় এবং সেখানে বাণিজ্যিক নীতির ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে কাজকর্ম পরিচালিত হতে থাকে। এইভাবেই গঠন করা হয়েছিল নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর। Khozrarschet-এর প্রবর্তন হলো নয়া আর্থিক নীতির একটা অপরিহার্য অনুসিদ্ধান্তের ফল। যাহোক, নতুন আর্থিক নীতির (NEP) আওতায় শিল্প-র ক্ষেত্রে সাধারণ গতি ছিল খুবই শ্লথ। এই সাফল্যে সরকারি অনুভূত হয়নি এবং এটা ছিল বিপজ্জনকভাবে একপেশে ধরনের সাফল্য। এই নীতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল কৃষককে তার উৎপাদিত পণ্যের জন্য তাড়াতাড়ি এবং যথেষ্ট পরিমাণে সহায়তা প্রত্যার্পণ করা। এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে যেসব ক্ষুদ্র এবং স্থানীয় শিল্প সংস্থা প্রত্যক্ষভাবে কৃষকদের জন্য পণ্যোৎপাদনে রত এবং কৃষিপণ্যের সঙ্গে যেসব সংস্থার শিল্পপন্য দ্রুত বিনিময় করা যায়, সেইসব শিল্পসংস্থাকে সর্বাগ্রে এবং সর্বতোভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়। শিল্পকারখানার মধ্যে যারা যারা ভোগ্যপন্য উৎপাদন করে এবং যাদের উৎপাদিত দ্রব্য দ্রুত বিনিময়ের জন্য সহজলভ্য, ভারি শিল্পপন্য উৎপাদনের কারখানার চেয়ে তাদেরই বেশি করে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে। শিল্পোৎপাদনের হার সবচেয়ে নিচে নেমে আসে ১৯২০ সালে। ঐ বছর উৎপাদন হয় ১৯১২ সালের মোট শিল্পোৎপাদনের ১৬% মাত্র। NEP-এর আওতায় শিল্পোৎপাদনের অসম হার লক্ষ্য করা যায়। ১৯২০ সালের ক্ষুদ্র শিল্পের উৎপাদন ১৯১২ সালের উৎপাদনের ২৫% তা বৃদ্ধি পেয়ে NEP-এর আমলে ৫৪% মাত্র। বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে শিল্পোৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১৭% এবং ১৯২২ সালে ২০% মাত্র। বৃহদায়তন শিল্পগুলির মধ্যে যেগুলি হাল্কা ধরনের ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের কারখানা এবং কৃষকদের জন্য যেগুলিকে সরাসরি গড়ে তোলা হয় সেই কারখানাগুলিই উৎপাদনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভালো ফল প্রদর্শন করে। সরকারি সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে দৈনন্দিন খরচ চালাবার মতো সঙ্গতির ব্যবস্থা তাদের নিজেদেরই করে নিতে হয়েছিল। আর্থিক সম্পদ শুণ্য হওয়া এবং প্রায়শই কোনো রকম ঋণ না পাওয়ার ফলে ব্যাপকহারে উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যমান লুপ্ত হল। NEP-এর জন্যই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প আর কোন একক কর্তৃপক্ষের পরিচালনাধীন রইল না। অনেকগুলি অর্থনৈতিক সংস্থার মধ্যে এই কর্তৃত্ব ভাগ করে দেওয়া হল। এইসব সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক কোনো যোগাযোগ না থাকায় এবং তাদের মধ্যে অবাধ প্রতি্যোগীতা চলার ফলে মূল্যমানের আবনমন আরও তীব্র রূপ পরিগ্রহ করল।

শিল্প সমবায় বা ‘সিন্ডিকেট’ (Syndicate): ১৯২২ সালের মার্চ মাসে যখন মূল্যমানের আরও অবনমন ঘটল তখন লেনিন ‘সিন্ডিকেট’ গঠনের কথা ঘোষণা করলেন। সিন্ডিকেটের কাজ হলো একটি একক শিল্পের সমগ্র বিক্রয়-ব্যবস্থা সমন্বিত করা এবং একচেটিয়াভাবে সেটি পরিচালনা করা। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে সমগ্র অগ্রণী শিল্পের অছিগুলি যৌথভাবে সিন্ডিকেট গঠন করার জন্য মিলিত হল। এর ফলে সংশ্লিষ্ট শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্যের ৭০% থেকে ১০০% বিক্রয়-ব্যবস্থার দায়িত্ব চলে এলো সিন্ডিকেটের হাতে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দর কষাকষি করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্পজাত পণ্যের ক্রমহ্রাসমান মূল্যের গতি প্রতিহত করা গিয়েছিল। ১৯২২ সালের মে মাসের পর এই গতিকে বিপরীতমুখী করা সম্ভব হয়েছিল। আগস্ট মাসের মধ্যেই ক্ষতিপূরণ হয়ে গিয়েছিল এবং শিল্পজাত পণ্যের অনুকূলে আসে এবং কৃষিজাত পণ্যের বিরুদ্ধে চলে যায়। এর প্রধান কারণ হলো শিল্পের ক্ষেত্রে উন্নততর সাংগঠনিক ব্যবস্থার সম্মিলিত প্রভাব এবং পর্যাপ্ত ফসল উৎপাদন। নয়া আর্থিকনীতির ফলে শিল্পের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যে বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল তা হলো ভারি শিল্পকে অবজ্ঞা করে হাল্কা ভোগ্যপণ্যের শিল্পকে প্রাধান্য দেওয়া হল। এই ঘটনার পরিণাম ছিল গভীরতম ও সুদূরপ্রসারি।

চলবে …

লেখকঃ অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ।