শিল্প সাহিত্য

লকডাউননামচা

-জয়নারায়ণ সরকার

জীবনটা একেবারে কেঁচে গেল। আর ভাল লাগছে না হরিপদর। লকডাউন ঘোষণার দিন থেকেই ঘরের এই চৌহদ্দিতে আটকে রয়েছে। একই ঘর, একই ব‍্যালকনি, একই ড্রয়িংরুম দেখতে দেখতে চোখে কেমন জ্বালা ধরছে আজকাল।

সন্ধের সময় ছাদটাকে মরুভূমির ওয়েসিস মনে হয়। সেখানেও বিধি বাম! ওই সময় মুখার্জিদার ওয়াইফ হাঁটে আর হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে এক্সারসাইজ করেন। সেটা দেখে গিন্নির কড়া হুকুম, সোশ‍্যাল ডিসট‍্যান্স মেইনটেইন করে ওঁনার সাথে কথা বলবে। এমনিতেই উনি গায়ে পড়া স্বভাবের! তোমাকে দেখলে তো বেশি করে গায়ে পড়েন। পিত্তি জ্বলে যায়।

প্রথম প্রথম একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল হরিপদ। অফিসের চাপ থেকে অন্তত কিছুদিনের জন‍্য মুক্ত থাকা যাবে। বাড়িতে যে এমন প্রেশার আসবে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি সে।

সকালে ঘুম থেকে উঠলেই চায়ের কাপটা গিন্নি মুখের সামনে ধরতো বরাবর। তবে কোনও কোনও ছুটির দিনে একটু সকালে ঘুম ভাঙলে সে নিজেই চা করে নিয়ে আসত। সেটা সে ইচ্ছে করে করতো, একটু ক্রেডিট নেওয়ার জন‍্য। আবার কোনও ছুটির দিনে পাঁঠার মাংস এনে নিজেই রান্না করতো। সেদিন মা, মেয়ে চেটেপুটে খেতো। ওদের তৃপ্তিসহকারে খাওয়া দেখে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াতো।

সেটাই যে ব‍্যুমেরাং হবে হরিপদ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। লকডাউন দু-দিন পার হয়ে গেছে। এখন তো সে রকম কোনও কাজই নেই হরিপদর। শুধুমাত্র সকালে মেয়েকে পড়াতে হয়। আসলে খবরের কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে মেয়ে যা জিজ্ঞেস করে, সে তার উত্তর দেয়। বেশ কয়েক ঘন্টা মেয়ে পড়ে। ফলে সেও পড়তে থাকে প্রথম পাতার একদম উপরে ছাপা সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্র থেকে শুরু করে শেষ পাতার একদম নীচে অমুক প্রেস হইতে মুদ্রিত ও ওমুক ঠিকানা থেকে প্রচারিত অবধি। এমনকি সন্ধান চাই বা শোক সংবাদও বাদ যায় না।

এমনই এক সকালে গিন্নি একটা ডায়েরি আর পেন নিয়ে ওদের মাঝে এসে বসে। ওকে ওভাবে বসতে দেখে হরিপদ বলে, এখন থেকে হরির টিউটোরিয়ালে পড়বে নাকি?

গিন্নি মুখটা আরো গোমড়া করে বলল, আমি কেন পড়তে যাবো। এখন মিটিং হবে। এই ডায়েরিতে মিনিটস্ লেখাথাকবে। আজকের মিটিংয়ে যা যা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সবাইকে তা মেনে চলতে হবে।

হরিপদ ফস করে বলে ওঠে, তা আজকের মিটিংয়ের অ্যাজেন্ডা কী?

গিন্নি এবার বেশ জোরের সাথে বলে, এই লকডাউনে সংসারের কাজের দায়িত্ব বন্টন।

শুনেই হরিপদ চমকে ওঠে! সে ভাবতে থাকে কপালে কী আছে কে জানে! এবার সে ঢোঁক গিলে বলে, আসলে এই লকডাউন তো অনেক দিন চলবে, তাই মিটিংটা সামনের রবিবারে করলে হয় না?

গিন্নি তিরিক্ষি স্বরে বলে, না না, তা হবে না। রবিবার আসতে এখনও তিনদিন বাকি। তাছাড়া তোমার এখন অফিস নেই, সারাদিন বাড়িতে থাকলে বোর ফিল করবে। তাই এই ব্যবস্থা।

নিমপাতা খাওয়ার মতো মুখ করে হরিপদ বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে।

মিটিংয়ে মোট সদস্য সংখ্যা তিন। অ্যাজেন্ডাগুলো আগে থেকেই লেখা ছিল ওর ডায়েরিতে। সেখানে একটা ক্লজ আছে, যার কাজ পছন্দ হবে না। সেক্ষেত্রে ভোটাভুটি হবে। তিনজনের মধ‍্যে দুজনের ভোট মিললেই তার মতামত প্রাধান‍্য পাবে।

এই ক্লজটা শোনার পর হরিপদ মেয়ের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন সে তার দলে। যেহেতু অতিরিক্ত আবদার মেটায়, তাই সে তাকেই সাপোর্ট করবে। কিন্তু দেখে মেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। ওর ওই হাসি দেখে আরও নার্ভাস বোধ হয় হরিপদের।

এবার গিন্নি বেশ গম্ভীর গলায় ক্রম অনুসারে অ্যাজেন্ডাগুলো পড়তে শুরু করে।

এক. সকালের চা করবে হরিপদ। দুই. ঘর ঝাড় দেওয়া ও মোছা সপ্তাহে পাঁচদিন গিন্নি আর দু-দিন হরিপদ।

এটা পড়ার পর হরিপদ তীব্র প্রতিবাদ জানায়। গিন্নি সাথে সাথে বলে, ঠিক আছে এবার তাহলে ভোট হবে। যারা এটা সমর্থন করছে তারা হাত তোলো। গিন্নি তো একটা হাত তুলেই রইল। এবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে হরিপদ দ‍্যাখে কিছুক্ষণ উশখুশ করে বাঁ-হাতটা তুলে দেয় মেয়ে। ওটা দেখে হরিপদর মুখে পরাজিত রাজনৈতিক নেতার মতো কৃত্রিম হাসি। তারপর আবার শুরু হয় নিয়মাবলি পড়া।

তিন. সপ্তাহে দু-দিন বাজার ও দোকান করবে হরিপদ। চার. প্রতিদিনের কাপড় কাচা গিন্নির আর ছাদে মেলবে হরিপদ।

এটা শুনে মেনে নিতে না পারলেও প্রতিবাদ জানায় না হরিপদ। সে হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে তার দল বড় দুর্বল। আবার মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে হরিপদ।

পাঁচ. প্রতিদিনের রান্না করবে গিন্নি। তবে প্রয়োজন পড়লে তরকারি কেটে দিতে হবে হরিপদকে। ছয়. বাসন মাজবে গিন্নি। সাত. মোবাইল ব‍্যবহার করতে পারবে দিন প্রতি আধ ঘন্টা। কথা বলা, ফেসবুক, হোয়‍্যাটসঅ্যাপ, টুইটার, মেইল সমেত।

এইটুকু বলে গিন্নি হুট করে উঠে যায় রান্নাঘরের দিকে। এবার হরিপদ মেয়েকে বলে, ঠিক আছে, তুমি আমাকে সাপোর্ট করলে না। দেখবে আমিও…

কথা শেষ করতে না দিয়ে পাশের সোফা থেকে এক দৌড়ে এসে হরিপদর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, আসলে আমি হাত তুলতে চাইনি, মা এমন গোল গোল চোখে তাকাল যে আমি হাত তুলে দিয়েছি। বলেই কোলের মধ‍্যে সেঁধিয়ে গেল।

হরিপদর চোখ তখন কপালে উঠেছে। এটা তো সাংবিধানিক রীতিতে ক্রাইম। ভয় দেখিয়ে ভোট কেনা! এসব ভাবনার মাঝেই গিন্নি চা আর চানাচুর নিয়ে হাজির। টেবিলে রেখে তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসে আবার ডায়েরি খুলে বলে, এবার শুরু করি।

আট. সন্ধের আগে ছাদ থেকে শুকনো জামা-কাপড় আনবে হরিপদ। নয়. মেয়ের রেওয়াজে বসার সময় ও ওঠার পর হারমোনিয়ায় রাখার দায়িত্ব হরিপদর। দশ. সন্ধে ছ’টা থেকে রাত আটটা অবধি ছাদে হাঁটা ও যোগাসন। সতরঞ্চি পাতা, ইউটিউবে যোগ ব্যায়াম চালানো, জলের বোতল এবং সব গুছিয়ে তুলে আনার দায়িত্ব হরিপদের। এগারো. টিভি চলবে রাত নটা থেকে এগারোটা। তাও শুধুমাত্র নিউজ চ‍্যানেল। পরিস্থিতির আপ-টু-ডেট খবরের জন‍্য। বারো. রাতের বিছানা পাতা ও সকালে ওঠাতে সপ্তাহে চারদিন গিন্নি আর তিনদিন হরিপদ। তেরো. রাতে ঘুমানোর আগে এক দান লুডু খেলা, লুডোর গুটি ও বোর্ড পেতে রাখা ও তুলে রাখার দায়িত্ব গিন্নির।

এই বলে থামল গিন্নি। পাশ থেকে মেয়ে বলল, আর কিছু বাকি আছে মা?

গিন্নি মাথা নেড়ে বলে, না, তবে এই নিয়ম এখন থেকেই চালু হল।

হরিপদ কিছু একটা বলে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় মেয়ে বলে উঠল, এবার আমি রেওয়াজে বসব।

হরিপদ সাথে সাথে বলে, তুই তো সন্ধেবেলায় রেওয়াজ করিস! তা এখন কেন?

মেয়ে হেসে বলে, বা রে, ওই সময় ছাদে ব‍্যায়াম ক‍রতে হবে না?

গিন্নি সাথে সাথে ডায়েরি থেকে নয় নম্বর ক্লজটা দেখায় হরিপদকে। সে মুখটা বেজার করে খাটের নীচ থেকে হারমোনিয়ামের বাক্সটা বের করতে উঠে যায়।

***

হরিপদর সকালে ঘুম ভাঙতেই মনে পড়ে আজ থেকে তো তাকে চা করতে হবে। হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দৌড়ে ঢুকে পড়ে রান্নাঘরে। কিছুক্ষণ বাদে চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। দ‍্যাখে গিন্নি পাশবালিশটা জড়িয়ে তখনও ঘুমে। একটা ঠেলা দিতেই বিরক্তি ভরা মুখে উঠে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। চা-পর্ব শেষ করে চাপ সামলাতে না পেরে বাথরুমে ঢুকে যায় হরিপদ।

আধ ঘন্টা পরে বেরিয়ে হরিপদ হাতে ঝাঁটাটা নিয়ে ঘরের মধ‍্যে এদিক-ওদিক করতে থাকে। বিছানায় বসে গিন্নি কিছুক্ষণ দেখার পর বলে, কী হল? ঝাঁটা নিয়ে সারা ঘর ঘুরছো কেন? যেন মনে হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে তলোয়ার নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছ?

হরিপদ মনে মনে ভাবে, এটা তো আমার কাছে যুদ্ধক্ষেত্রই বটে! তারপর বলে, না, আসলে কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছিলাম না।

গিন্নি এবার হুঙ্কার দিয়ে বলে ঘরের ওই কোণা থেকে শুরু করে বাইরের বারান্দায় নিয়ে গিয়ে ওখানে একটা ডাস্টবিন আছে, তাতে ময়লাগুলো ফেলে দেবে।

হরিপদ এবার হকি স্টিকের মতো ধরে ধনরাজ পিল্লাইয়ের মতো ঝড়ের বেগে এ ঘর থেকে ও ঘরে চলে যায়। গিন্নি খাটে বসেই চিৎকার করতে থাকে, খাটের তলা-সোফার তলাটা ঠিকমতো হল না।

সে এখন আর কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। রীতিমতো দম লেগে যাচ্ছে। ঝাঁটা রেখে এবার ঘর মোছার ডান্ডিটা হাতে নেয়। যার মাথায় একটা কাপড়ের দলা। সেটা ফিনাইল দেওয়া জলে চুবিয়ে তুলে নিয়ে মেঝেতে ঘষতে থাকে। মাঝে মাঝে ডান্ডি ধরে থাকা অংশটা এসে ভুঁড়িতে লাগছে।

গিন্নি এবারও তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, ঘর মোছা হচ্ছে না। তুমি এক জায়গায় ঢলেই যাচ্ছো। আরে, নিচু হয়ে সোফার তলাটা মুছতে হবে।

এদিকে হরিপদের সারা শরীর ঘামে জবজব করছে। সে আর কোনও কথায় কান না দিয়ে নৌকার বৈঠা বাওয়ার মতো এগিয়ে চলে।

এর মধ‍্যে মোবাইলটা বেজে ওঠে। ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে এসে গিন্নি বলে, তোমার অফিসের সুমিতার ফোন।

হরিপদ ভ‍্যাবাচ‍্যাকা খায়। স্থবির হয়ে কিছুক্ষণ ভাবে, কথা বলতে গিয়ে মুখ ফসকে যদি বেরিয়ে যায় ঘর মোছার কথা! ও যা ধুরন্ধর, কথার প্যাঁচে ফলে ঠিক বার করবে। তারপর সারা অফিসে খবরটা রটিয়ে দেবে সুমিতা। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে ফোনের স্ক্রিনের দিকে। মোবাইলটা রিং হয়ে কেটে যায়। হরিপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফ‍্যালে। ওদিকে গিন্নি হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, কী হল? স্ট‍্যাচু হয়ে গেলে কেন? ব‍্যালকনিটা এখনও বাকি।

গিন্নির কর্কশ গলার আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ব‍্যালকনির দিকে যায় হরিপদ।

ব‍্যালকনি থেকে পাশের ফ্ল‍্যাটের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে যায়। ভাল করে চোখ কচলে দ্যাখে, দত্তদাও ব্যালকনিতে ঘর মোছার ডান্ডিটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় লাল কাপড়ের পট্টি বাঁধায় রঘু ডাকাতের মতো দেখতে লাগছে দত্তদাকে।

একপলক দেখে হরিপদ ডান্ডিটাকে দু-পায়ের ফাঁকে নিয়ে খানিকটা হ‍্যারিপটারের মতো উড়ে ঘরের মধ‍্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারপর মাথা তুলে তাকাতে দেখে বাবার কাণ্ড দেখে সোফায় বসে হেসেই চলেছে মেয়ে।

 

( জয় নারায়ন সরকার -গল্পকার,পশ্চিমবংগ )