শিল্প সাহিত্য

মধ্যসত্ত্বভোগী আল মাহমুদ: ৬ষ্ঠ পর্ব

-শোয়েব নাঈম

কবি আল মাহমুদ (ফাইল ছবি)

“আমার নিষিদ্ধ চোখ জেগে থাকে নিজের কোটরে/ অথচ দেয় না দৃষ্টি”(আমি- আল মাহমুদ)… যৌবন থেকে মৃত্যুকাল অবধি কষ্টসাধ্য প্রত্যক্ষ বাস্তবকে কুটিল কৌশলে এভাবে এড়িয়ে তিনি পণ্যের প্রথায় বিলাসী স্বপ্ন দেখে দেখিয়ে গভীর আবেশে মোহাচ্ছন্ন নিজস্ব চারিতায় উপভোগ করেছেন অবিরলভাবে। তার সকল স্বপ্নোদয়ের পালাগুলি চক্রান্তের মায়াবী পর্দার’ই ইঙ্গিত দেয়। পঁচাত্তরে পনের অগাস্ট পরবর্তী জাতির ঝড়ঝঞ্ঝাকালে যখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে প্রতিরোধের দরকার ছিল তখন আল মাহমুদ তার বিবর্তিত জীবনের প্রথম রহস্যময় স্বপ্ন দেখেছিলেন ১৯৭৬ সালে-

“…পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থটি বুকের ওপর রেখে
আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হয় এ ছিলো সত্যিকার ঘুম/কিংবা দুপুরে খাওয়ার পর ভাতের দুলুনি। আর ঠিক তখুনি/সেই মায়াবী পর্দা দুলে উঠলো, যার ফাঁক দিয়ে/যে দৃশ্যই চোখে পড়ে, তোমরা বলো স্বপ্ন।…”
– মায়াবী পর্দায় দুলে ওঠো ।
কপর্দকশূন্য আল মাহমুদের বাস্তব জগতবিমুখ পরিধি থেকে কালক্ষেপনকারী স্বপ্নঘোরের পরিসীমা ছিল সীমাহীন। তার খোয়াবনামাগুলিতে সবসময় এমনভাবে দুটি পক্ষ তৈরি করেছেন যাতে হানাহানি আর রক্তপাতের মাধ্যমেই বস্তুগত জীবনের ফয়সালা ঘটে। এমন স্বপ্নধারার বয়ান করে তিনি আরো বেশি কতৃত্ববাদী হওয়ার অপচেষ্টা করেছেন সাহিত্যজগতে-
“…না, সবি ছিল স্বপ্ন। আমি তো পৃথিবীর/ দরিদ্রতম দেশের দরিদ্রতম মানুষ। একজন/ ডানাআলা কবি? ডানা?/ হাঁ, পৃথিবীর ক্ষুধার্ত মানচিত্রের প্রায় প্রত্যেকটি/ প্রাণীরই যেমন অদৃশ্য ডানা থাকে, তেমনি। থাকে
স্বপ্নের অলীক পাখনা….” – ডানাআলা মানুষ ।
বাংলাদেশী-আরবীয় এই হাইফেনেটেড পরিচয়টা আল মাহমুদ লেখারক্ষেত্রে বেশ গর্বের সাথে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তার হৃদয় কোনোকালেই ধারণ করতে পারে নাই  রক্তস্নাত মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের গৌরবাম্বিত ইতিহাসের এই বাংলাদেশকে, তার মননশীলতার তাবৎ আরধ্য ছিল আরব্য রজনীর কিচ্ছার প্রতাপীয় স্বাপ্নিক অতিরঞ্জিত কাহিনী বিস্তারে। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশে বসে মধ্যপ্রাচ্যের লোককথার স্বপ্নের জাল বুনেন তার কবিতায় স্বজাতিত্ববোধের নিশানা হারিয়ে-
” মাঝে মাঝে শুনি সেই ডাক। হায় পুত্র শোক। যেন পৃথিবীর গোলককে/ গেঁথে ফেলে আর্ত এক পিতার চিৎকার।/ সাত্ত্বনা, তার জন্য একটি স্বপ্ন আমি রেখে এসেছি। স্বপ্ন, যার অর্থ তাকে/ একই সঙ্গে আশা ও আতঙ্কে মুহ্যমান করে। যত না বয়স তার তারও/ চেয়ে গুরুভার হয়ে ওঠে তার। বার বার লুটান সিজদায়।/ মনে পড়ে সেই স্বপ্ন ….”
 – ইউসুফের উত্তর ।
নিরুদ্দিষ্ট চৈতন্যে স্বপ্নের গোলাম আল মাহমুদ মিথ্যা প্রবোধের পাশ্বপ্রতিক্রিয়ায় আর স্বপ্নে ঘুনে  ধরা মস্তিষ্কে ২০০৪ সালের এক রাত্রিতে বলেন-
” সারা জীবন আমি উদ্ভট স্বপ্নের মধ্যেই পাশ ফিরে শুয়েছি। দুঃস্বপ্নের/ উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে বালিশের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে সাত্ত্বনা খঁজেছি….”
 – স্বপ্নের উৎপাত ।
‘নয়াদিগন্ত’ গোষ্ঠীরা রাতের অন্ধকারে তাদের দিগন্ত বিস্তৃত করার স্বপ্নযাত্রার চাবি আল মাহমুদের হাতে তুলে দিয়ে তাকে অমরতা দেওয়ার যে প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল, সেই পথের বিপরীতমুখী বিশালগোষ্ঠীর নিবিড়তায় আর বলিষ্ঠ প্রতিরোধে একটি গতানুগতিক, নিত্যনৈমিত্যিক এবং বোরিং ঘটনার সমান মৃত্যু নিয়ে স্বপ্নভ্রষ্ট পথভ্রষ্ট আল মাহমুদ এই পৃথিবী থেকে চলে গেলেন এবং মৃত্যুর পূর্বেই অনাগত এই আচরণ অনুধাবন করেই তিনি বলেছিলেন –
” যারা আমাকে এ অদম্য চলার পথে নিয়ে এসেছে
তারা তো সবাই জানে আমার পা পাথর,
দৃষ্টি শক্তি কুয়াশায় আচ্ছন্ন।
তবু মানুষের মন বলে একটা কথা আছে। আছে না কি ?
হ্যাঁ, মন বলছে এখনও আমার দিগন্তে পৌছার
খানিকটা পথ বাকি…. “
  – অদম্য চলার ইতিহাস।
আল মাহমুদের দিগন্তমুখী স্বপ্নযাত্রার  সারথীরা হচ্ছে-
‘ নীল মসজিদের ইমাম’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘জুলেখার আহবান’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘ মিথ্যাবাদী রাখাল’, ‘নূহের প্রার্থনা’, ‘অলৌকিক কুয়াশা’, ‘ অমরতার আক্ষেপ’…..
এরা কেহ উটারোহী, কেহ অশ্বারোহী , আর  মেষপালক, মননে মগজে নৃতাত্ত্বিক গঠনে এরা সকলেই আরবীয় । ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিঃ মিঃ বাংলাদেশের আয়তনের ভূখন্ডে মধ্যসত্ত্বভোগী মস্তিষ্কে ঐসব আরবদের ধারণ করেই আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে অমরতা লাভের স্বপ্নে মশগুল ছিলেন !
( চলবে….)
শোয়েব নাঈমঃ কবি ও প্রান্ধিক