মতামত

অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে চীনের সমাজতন্ত্র

-শান্তনু দে

শান্তনু দে (ফাইল ছবি)

আলিবাবা গ্রুপের জ্যাক মা, কিংবা লেনোভো’র প্রতিষ্ঠাতা লিউ চুয়ানঝি, অথবা শেনঝেন-কেন্দ্রিক দাপুটে টেলিকম সরঞ্জাম সংস্থা হুয়াওয়ের কর্ণধার রেন ঝেঙফেই— যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য—একথা প্রায় কারো অজানা নয়।

কিন্তু মিডিয়া কখনও জানায় না, চরম দারিদ্র দূরীকরণে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গত আট-বছরে গ্রামে পাঠিয়েছে তার সবচেয়ে যোগ্য, দক্ষ ৩০ লক্ষ পার্টি ক্যাডারকে। সরকারি, অথবা সরকারি মালিকানাধীন সংস্থায় নিজেদের কাজের জায়গা থেকে সরিয়ে তাঁদের পাঠানো হয়েছে এই অভিযানে।

শুধু তাই নয়, দারিদ্রের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে তাঁদের মধ্যে জীবন দিয়েছেন ১,৮০০ জন।

একথা ঠিক, হুরুন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসেবে চীনে বিলিওনেয়ারের সংখ্যা এবছর হাজার ছাড়িয়েছে। সংখ্যার মাপকাঠিতে কবেই ছাপিয়ে গিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিলিওনেয়ারের বাস এখন বেজিঙয়ে। দু’নম্বরে সাঙহাই। তিনে নিউ ইয়র্ক।

তেমন এও ঠিক, ২০১২-তে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টাদশ কংগ্রেসের পর থেকে এই সময়ে প্রায় ১০ কোটি মানুষকে তারা দারিদ্র থেকে তুলে এনেছে। দারিদ্রের অতল থেকে ৮৩২ টি গ্রামীন অঞ্চলের সবক’টিকেই উদ্ধার করেছে। দেশ থেকে নির্মূল করেছে চরম দারিদ্র।

আজ থেকে একশ বছর আগে এরকমই জুলাইয়ের একদিন। পুলিশের সতর্ক চোখ এড়িয়ে চীনের নানা প্রান্ত থেকে বারোজন গোপনে জড়ো হয়েছেন সাঙহাই শহরে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হুনান প্রদেশ থেকে আসা বছর আঠাশের এক যুবকও। ভবিষ্যত যাঁকে একডাকে চিনবে মাও নামে। তাঁরা সকলে মিলিত হয়েছেন পঞ্চাশজনের বেশি সদস্য ও কিছু কমিউনিস্ট গ্রুপের প্রতিনিধি হিসেবে। আর আজ, শেষ ৫ জুনের হিসেব পার্টির সদস্য সংখ্যা বেড়ে ৯ কোটি ৫১ লক্ষ। জনসংখ্যার প্রতি ১৫ জনে একজন পার্টি সদস্য।

মার্কিন ব্যবসায়ী কার্ল ক্রো গত শতকের তিনের দশকে, চীনে যখন প্রথম কোনও পশ্চিমী বিজ্ঞাপন সংস্থা খোলেন, তখন তাঁর লেখা একটি বইয়ের শিরোনাম ছিল: ‘৪০ কোটি ক্রেতা’!

সেসময় মার্কিন বুর্জোয়ারা কীভাবে চীনকে দেখতেন, এতেই স্পষ্ট। মাঝে ১৯৪৯, চীনের আকাশে লাল তারা।

তারপর, সত্তর বছর বাদে ৪০ কোটি ‘ক্রেতা’ বেড়ে চীন এখন ১৪০ কোটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারগুণ। মার্কিন পুঁজিপতিশ্রেণি দ্বিধায়। তারা চায়, তাদের প্রয়োজন ১৪০ কোটির বাজার। বিশেষত মার্কিন কৃষি ব্যবসা, চীনে বিপুল পরিমান গম, সোয়াবিন, ভুট্টা এবং অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী বিক্রির উপর নির্ভরশীল। আবার চীনেরও তা দরকার। কারণ তাদের ভূখণ্ডের আয়তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমান হলেও, খাবার তুলে দিতে হয় চারগুণের বেশি মানুষের মুখে।

আজকের চীনের জনগণ কেবল ‘ক্রেতা’ নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আজকের চীনে রয়েছে মহাকাশচারী, দ্রুত গতির ট্রেনের ইঞ্জিনিয়ার থেকে নতুন প্রযুক্তির দক্ষ কর্মী। চাঁদে প্রথম চীনের চন্দ্রযান। মহাকাশ বিজ্ঞানে এক উল্লম্ফন। তাক লাগিয়ে দেওয়া সাফল্য। ১৯৭৮, দেঙ জিয়াওপিঙ বলেছিলেন, মহাকাশ দৌড়ে নামেনি চীন। আমাদের মহাকাশ কর্মসূচী হলো চীনের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য।

সাত দশকে বিশ্বের অন্যতম দুর্বল অর্থনীতি থেকে অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি। গত শতকের ছয়ের দশকে, মাথাপিছু জিডিপি-তে শুধু উচ্চ-আয়ের দেশগুলি থেকেই পিছিয়ে ছিল না, এমনকি পিছিয়ে ছিল কাম্বোডিয়া, কেনিয়া, সিরিয়া লিওনের মতো দেশের থেকে। জানাচ্ছে বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য। প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্সের সমীক্ষায় এহেন চীন এখন দু-নম্বরে। দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক পরেই। এবং ২০৩০ সালের মধ্যে উঠে আসবে এক-নম্বরে।

‘২০১৮-র শেষে মাথাপিছু জিডিপি বেড়ে হয়েছে ৯,৭৩২ ডলার, ১৯৫২-র তুলনায় ১৮০ গুণেরও বেশি।’

এক দশক আগেও পুঁজিবাদ চীনকে দেখত সস্তা শ্রমের প্রধান উৎস, বিদেশী বিনিয়োগের ‘স্বর্গ’ এবং ধীর উৎপাদনের ‘বিশ্বের কারখানা’ হিসেবে। এখন সেই দেশেই শিল্প ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। নানা ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই ছাপিয়ে গিয়েছে অধিকাংশ উন্নত দেশকে।

সত্তর বছরে চীন ৮০ কোটি মানুষকে তুলে এনেছে দারিদ্রের অতল গহ্বর থেকে। আশি কোটি মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার আড়াইগুণ। যার নজির আধুনিক ইতিহাসে আর নেই। রাষ্ট্রসঙ্ঘের দরাজ সার্টিফিকেট: বিশ্ব দারিদ্র দূরীকরণের ৭০ শতাংশের বেশি কমিয়েছে একা চীন। গ্রামীন এলাকার দারিদ্রের হার ১৯৭৮ সালে ছিল ৯৭.৫ শতাংশ। আর আজ চরম দারিদ্রের পুরোপুরি অবসান। বিশ্বব্যাঙ্ককে স্বীকার করতে হয়েছে, চীনের দারিদ্র দূরীকরণ মানবতার ইতিহাসে অন্যতম মহান সাফল্য।

কৃষি থেকে চীন এখন নিজেকে সরিয়ে এনেছে শিল্পায়নে, পরিষেবা ক্ষেত্রের বিকাশে। ১৯৫২, জিডিপি-তে কৃষির অংশ ছিল ৮৩.৫ শতাংশ। এখন ২০১৮-তে কমে হয়েছে ২৬.১ শতাংশ। একইসময়ে পরিষেবা ক্ষেত্রের অংশ ৯.১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৬.৩ শতাংশ। শিল্পের অংশ ৭.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৭.৬ শতাংশ।

একটি হতদরিদ্র দেশ বদলে গিয়েছে উচ্চ-মধ্যবিত্ত আয়ের দেশে। চীনই প্রথম দেশ, যারা পূরণ করেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা।

সত্তর বছরে চীনের উন্নয়ন নজিরবিহীন, বিস্ময়কর!

কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে মাত্র কয়েকদশকে চীন যে রাস্তা অতিক্রম করেছে, উন্নত দেশগুলির সেই জায়গায় পৌছতে সময় লেগেছিল কয়েকশ’ বছর। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন এখন স্থিতিশীলতার মূল শক্তি। বিশ্বের অর্থনীতির অন্যতম মূল চালিকাশক্তি। ২০১৩-১৮, বিশ্বের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ২৮ শতাংশের বেশি এসেছে চীন থেকে।

এরপরেও চীন একটি উন্নয়নশীল দেশ। কারণ তার মাথাপিছু আয় ‘উন্নত’ দেশগুলির একটি ভগ্নাংশ মাত্র। মাথাপিছু জিডিপি’র নিরিখে চীন এখনও ৮০-নম্বরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পিছনে। জানিয়েছে প্রাইস ওয়াটারহাউস। তবে ব্যবধান কমছে। ১৯৫২, চীনে মাথাপিছু জিডিপি ছিল সাকুল্যে ৫৪ ডলার। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২,৩৪৯ ডলার। চীনের চেয়ে ৪৪ গুণ বেশি। ২০১৮-তে চীনের মাথাপিছু জিডিপি বেড়ে হয়েছে ৯,৭৩২ ডলার। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬২,৬০৬ ডলার। চীনের চেয়ে ৬.৪ গুণ বেশি।

১৯৪৮, নিরক্ষরতার হার যেখানে ছিল ৮০ শতাংশের বেশি, এখন সেই দেশে নিরক্ষর মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান মিলিয়ে বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যে স্নাতক তৈরি করে, একা চীন তৈরি করে তার চেয়ে বেশি। ১৯৪৯, চীনে গড়আয়ু ছিল মাত্র ৩৫। এখন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স জানাচ্ছে, ২০১৮-তে গড়আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৭। ‘এখন ৬৫-বছরের বেশি বয়স্ক মানুষ প্রতিবছর পান বিনামূল্যে মেডিক্যাল চেকআপ।’

সোভিয়েত বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে চীন। সব কি ঠিক হচ্ছে? না। কোনও ভুলত্রুটি কি নেই? আছে। তবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বোঝাপড়ার মধ্যেই তা আছে। ভুলত্রুটির ক্ষেত্রগুলিকে তারা স্বীকার করছে, সংশোধনের লক্ষ্যে নিচ্ছে পদক্ষেপ। সোভিয়েতে কেন্দ্রীভূত অর্থনীতির যে ধাঁচ ছিল, তার বদলে তারা বিকেন্দ্রীভূত অর্থনীতি নিয়ে এগোচ্ছে।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নিজেই বলেছে, ‘চীন বর্তমানে সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এবং আরও বহুদিন তাই থাকবে। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ চীনের মতো একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক আধুনিকীকরণ— এই ঐতিহাসিক পর্বকে সে কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারে না। এই পরিস্থিতি চলবে আরও একশ বছরের ওপর। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ পরিস্থিতি মাথায় রেখেই অগ্রসর হতে হবে এবং চীনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সমাজতন্ত্রেরই পথ নিতে হবে।’

চীন যেহেতু বিপ্লবের সময় একটি পশ্চাৎপদ আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক দেশ ছিল, সেকারণে তার অর্থনীতির সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর খুবই প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করতে হয়েছিল। এই প্রক্রিয়াকে ওরা বলে, ‘চীনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সমাজতন্ত্র নির্মাণ’।

‘সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ে আছে’ বলে উৎপাদনের উপকরণের রাষ্ট্রীয় মালিকানার সঙ্গে তারা যৌথ মালিকানা, সমবায় এবং ব্যক্তিগত মালিকানার কথাও বলছে। অবশ্যই অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রণটা থাকবে রাষ্ট্রের হাতেই। যদিও, বাজারের যে একটা ভূমিকা আছে, তা তারা স্বীকার করে নিয়েছে। এই কাঠামোকে তারা বলছে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’।

কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ রাখা হলেও, মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য ভোগ্যপণ্যের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বাজারের হাতে। তবে রেল, তেল, ইস্পাত, টেলি যোগাযোগ, ব্যাঙ্ক, বিদ্যুৎ, বন্দর, খনি, পরিবহন প্রভৃতি মৌলিক ক্ষেত্রগুলি সহ শিল্প মালিকানার ৭০ শতাংশ এখনও রাষ্ট্রীয় মালিকানাতেই আছে। ব্যক্তি মালিকানায় উদ্যোগ তৈরি হচ্ছে। বিদেশী পুঁজিকেও ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ফরাসী অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেত্তি ও তাঁর দুই সহকর্মী দেখিয়েছেন: ‘জাতীয় আয়ে জনসংখ্যার শীর্ষ ১০ শতাংশের অংশ ১৯৭৮ সালে যেখানে ছিল ২৭ শতাংশ, ২০১৫-তে তা বেড়ে হয়েছে ৪১ শতাংশ। যেখানে নিচের দিকে থাকা ৫০ শতাংশের ভাগ এই সময়ে ২৭ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১৫ শতাংশ।’

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার দাপট এখনও বেশি থাকলেও, অর্থনীতিতে বাড়ছে বেসরকারি সংস্থার প্রাধান্য। জাতীয় কর-রাজস্বের ৫০ শতাংশ আসে বেসরকারি সংস্থা থেকে। জিডিপি’র ৬০ শতাংশ, শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশের অংশীদার এখন বেসরকারি সংস্থা।

স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠেছে, এর ভবিষ্যৎ কী?
বিদেশী পুঁজি, ব্যক্তি মালিকানার সঙ্গে পুঁজিবাদের খারাপ জিনিসও তো সমাজে ঢুকছে। ব্যক্তি পুঁজি বাড়ছে। কিছু মানুষ ধনী হচ্ছে। মানুষের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে। বাড়ছে বৈষম্য। বেকারী, দুর্নীতি। বাড়ছে গ্রাম-শহরে আয়ের ব্যবধান। বাড়ছে মজুরির ব্যবধান। সমাজতন্ত্রে তো কমার কথা। পুঁজিপতিদের পার্টি সদস্য হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কিছু ব্যবসায়ী, উদ্যোগপতি পার্টিতে এসেছে। এর সমাধান কী?

অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার নিরিখে চীন এখনও সমাজতন্ত্রের ‘প্রাথমিক পর্যায়ে’ আছে বলে মনে করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যে সাফল্য অর্জন করেছে, তাতে তারা প্রবেশ করেছে একটি ‘নতুন যুগে’।

‘আধুনিক সমাজতন্ত্র’ আর উৎপাদিকা শক্তির পশ্চাৎপদতা আর মুখ্য দ্বন্দ্ব নয়। চীন ‘এখন যে দ্বন্দ্বের মুখোমুখি, তা হলো, ভারসাম্যহীন এবং অপর্যাপ্ত উন্নয়নের সঙ্গে উন্নততর জীবনের জন্য জনগণের ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব।’ (শি জিনপিঙ, উনিশতম পার্টি কংগ্রেস)।

পার্টির সাধারণ সম্পাদকই স্বীকার করছেন, আজকের দ্বন্দ্ব ‘ভারসাম্যহীন এবং অপর্যাপ্ত উন্নয়নের সঙ্গে উন্নততর জীবনের জন্য জনগণের ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব।’

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বোঝাপড়া থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে সাম্রাজ্যবাদের ধারণা। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী অভিমুখের অভাবে লঘু হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদে। একথা যেমন ঠিক, তেমনই এও ঠিক, চীনের উত্থান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক উপাদান। মার্কিন আধিপত্যবাদী রাজনীতি, সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবিলায় একটি শক্তির ক্রমবর্ধমান উত্থান। যে শক্তি শান্তি ও সহযোগিতার একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিন্যাসের সওয়াল করে চলেছে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের মুখ্য উদ্যোক্তা চীন, অথবা রয়েছে তার মুখ্য ভূমিকা। যেমন ব্রিকস, সাঙহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন, এশিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক (ইতিমধ্যেই ১০০ সদস্য), কিংবা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রজেক্ট।

এই পরিস্থিতিতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দু’টি শতবার্ষিকী লক্ষ্যপূরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২১, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষের মধ্যে ‘একটি বাহুল্যবর্জিত সুখসমৃদ্ধির সমাজ নির্মাণ’, যেখানে অবশিষ্ট দারিদ্রের অবসান। এবং ২০৪৯, চীন বিপ্লবের শতবর্ষের মধ্যে ‘চীনে একটি আধুনিক, সুখসমৃদ্ধি, গণতান্ত্রিক, সভ্য এবং সম্প্রীতির সমাজতান্ত্রিক দেশে রূপান্তর’। মাঝপথে, ২০৩৫ নাগাদ, চীনকে একটি ‘আধুনিক সমাজতান্ত্রিক সমাজে’ রূপান্তর।

বর্তমান অবস্থায় আন্তর্জাতিক শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য যখন সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে চলে গিয়েছে, তখন আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি নির্দেশিত ও পরিচালিত বিশ্বায়ন মোকাবিলা করতে বর্তমান সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি গ্রহণ করছে অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ।
উদারিকরণের ঘূর্ণাবর্ত সমস্ত দেশকে টেনে নিচ্ছে নিজের আওতায়। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে এই দেশগুলির অর্থনীতিতে সামঞ্জস্য আনতেই এই সংস্কার। এই অন্তর্বর্তী সময়ে এই দেশগুলি কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। চীন থেকে ভিয়েতনাম— সবক’টি দেশেই অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় সামাজিক বৈষম্যের দ্রুত প্রসার, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ প্রভৃতি নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

এটা যেমন ঠিক, তেমনই এও ঠিক— ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিগুলি এই সব প্রবণতাকে শুধু চিহ্ণিতই করেনি, এগুলিকে তারা মোকাবিলা, নিয়ন্ত্রণ ও সংশোধন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

মূল প্রশ্ন হলো: এই সংস্কারগুলি থেকে কি শোষণকারী একটি নতুন পুঁজিপতি শ্রেণির অভ্যুত্থান ঘটছে, যারা ভবিষ্যতে প্রতিবিপ্লব সফল করার মতো শক্তি অর্জন করবে? না কি, এইসব সংস্কারের মধ্যে দিয়ে শক্তিগুলির যে বিন্যাস তৈরি হচ্ছে, তা আজকের বাস্তব পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্রকে আরও সংহত ও শক্তিশালী রূপ দেবে?

সাধারণভাবে বিশ্ববিপ্লবের প্রক্রিয়া নিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌল তত্ত্ব আর নীতি আমরা সবাই কমবেশি জানি। একইসঙ্গে আমরা জানি বিপ্লবের কোনও ‘মডেল’ নেই। সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের জন্য নেই কোনও সাধারণ সূত্র। নির্দিষ্ট দেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তা এগিয়ে চলে। যে অনুশীলন আমরা দেখছি। শোষণহীন সমাজ নির্মাণ আরও জটিল, আরও এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া।

এক অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে চীনের সমাজতন্ত্র।

বিদেশী পুঁজি, ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজি বিপজ্জনক। একে কীভাবে, কতদিন কর্তৃত্বে রাখা যাবে এটা গুরুত্বপূর্ণ। চীনে সমাজতন্ত্রের যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তার উপর শুধু সে দেশেরই নয়, নির্ভর করছে গোটা বিশ্বে একুশ শতকে সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।

শান্তনু দে। সহযোগী সম্পাদক, মার্কসবাদী পথ