মতামত

রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকাঃ যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে নয়া-অর্থনীতি (৩য় পর্ব)

-অধ্যাপক সুস্নাত দাশ

আমরা জানি, কোন কারখানার শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ এবং স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকান্ডের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হলেই উৎপাদনের সমস্যা এবং সমাজের শ্রেণি-সম্পর্কের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে- এই ধ্যান-ধারণার মধ্যে সমাজতন্ত্রবাদের নামগন্ধ নেই। সমাজতন্ত্রবাদ যেমন, দায়িত্বজ্ঞানহীন বেপরোয়া পুঁজিপতি মালিকের অধীনতা কামনা করে না, তেমনি যে বেপরোয়া কারখানা কমিটি প্রকৃত রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে স্বাধীনভাবে চলতে চায় এবং উৎপাদনের কাজে বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে তাকেও বরদাস্ত করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং সকলের স্বার্থে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সতর্কতার সঙ্গে সব কিছুর সমন্বয় সাধন করাই হলো সমাজতন্ত্রবাদের সারবত্তা। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে ডিক্রি জারির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় এই প্রবণতাকে আটকাবার চেষ্টা করা হয় কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয় না। তখন গঠনমূলক শক্তিকে ঠিক পথে পরিচালনার জন্য গ্রহন করা হয় আরও কিছু পন্থা। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই শেষ পর্যন্ত গঠিত হয় Superme Council of National Economy বা ভেসেনেখা (vesenkha)। বুখারিন ‘Supreme Council of National Economy’ গঠনের জন্য যে খসড়া ডিক্রি প্রস্তুত করেন সেই প্রস্তাবিত ডিক্রির স্বপক্ষে লেনিন ১৯১৭ সালের ১/১৪ ডিসেম্বর মাসে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন। ১৯১৭ সালের ৫/১৮ ডিসেম্বরে এই ডিক্রিটি জারি করা হয়। এই ডিক্রিটি জাতির অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এবং সরকারের আর্থিক সম্পদকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে জারি করা হয়েছিল এবং এই দায়িত্ব পালনের ভার অর্পিত হয়েছিল Superme Council of National Economy নামক নব গঠিত সংগঠনটির উপর। এই সময় চালু কেন্দ্রীয় বা আঞ্চলিক সব অর্থনৈতিক সংস্থা এবং কর্তৃপক্ষকে এর আওতায় আনা হয় এবং সেগুলির কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে শ্রমিক কর্তৃক নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটে। এর কয়েক সপ্তাহ পরে তাই লেনিন মন্তব্য করেছিলেন, ‘শ্রমিক কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের পর্যায় পার হয়ে আমরা পৌঁছালাম Superme Council of National Economy গঠনের পর্যায়ে।‘
লেনিন তাঁর “ On ‘Left’ Infantilism and the Petty- bourgeois Spirit” (শিশুসুলভ ‘বামপন্থা’ ও পেটি বুর্জোয়া মানস) নামক রচনায় ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’ কে সমাজতন্ত্রের দিকে যাওয়ার পদক্ষেপ রূপে সমর্থন জানালেন। তিনি ঘোষণা করলেন, রাষ্টীয় পুঁজিবাদের লক্ষ্য হলো, শ্রমের সঠিক ও সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার। এর থেকে বোঝা যায়, বলশেভিকদের কর্মসূচির প্রথম পর্যায়ের অংশ রূপে শিল্পের ব্যাপক জাতীয়করণের ব্যাপারটি গৃহীত হয়নি। Vesenkha কে কারখানাগুলি হুকুম দখল করার, বাজেয়াপ্ত করার বা আলাদা করে রাখার ক্ষমতা দেওয়া হলেও জাতীয়করণের প্রথম ধাপে এ ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয়হীন এক দোনামনা মনোভাব। শিল্পের জাতীয়করণকে গড়ার দিকে বাঞ্ছনীয় শেষ কর্তব্য রূপে গণ্য করা হয়নি, এটাকে সাধারণ মালিকদের কিছু কুকর্মের ফলে উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ধরনের জবাব হিসেবে গণ্য করা হতো। আমরা বলতে পারি, জাতীয়করণের কর্মসূচী সমগ্র শিল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ সম্পূর্নভাবে একক কারখানার উপর। জাতীয়করণ নীতির বর্ণনা প্রসঙ্গে সেই সময় সোভিয়েত সাহিত্যে দুটি উক্তি চালু হয়েছিল। এর একটা হল ‘শাস্তিমূলক’ এবং অন্যটা হলো ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ শব্দ। ‘শাস্তিমূলক’ শব্দের অর্থ ছিল, পুঁজিপতিদের প্রতিরোধ কিংবা অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম প্রতিহত করা বা তার বিরুদ্ধে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগ করা। আর ‘স্বতঃস্ফূর্ত ’ শব্দের অর্থ ছিল- কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা নয়, প্রধানত শ্রমিকদের দ্বারাই হাতেনাতে ব্যবস্থা অবলম্বন। Rykov এর মতে জাতীয়করন চলেছিল –‘সরবরাহের প্রশ্ন বা অর্থনৈতিক প্রশ্ন বিচার বিবেচনা না করেই। এটাই হাজির করা হয়েছিল বুর্জোয়াদের সঙ্গে নিছক সংগ্রাম করার প্রত্যক্ষ প্রয়োজনে। এই প্রসঙ্গে E H Car –এর মত হল –যতদিন শিল্পের চেয়ে কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার উপর শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সহজাত প্রবণতাকে সম্পূর্ণভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়নি।

ব্যাপক জাতিয়করণের পরিবর্তে অন্তবর্তীকালীন সময়ে শিল্পের উপর নিয়ন্ত্রণমুলক ব্যবস্থার মাধ্যমে যে রাষ্ট্রীয় ধনতন্ত্রবাদ প্রবর্তিত হয় তা ছিল  এক অস্থায়ী অবস্থার সূচক। এটা নিছক একটা অস্বস্তিকর সমঝোতা হয়ে দাঁড়ায় এবং ১৯১৮ সালের গ্রীষ্মকালের পর তা আর টিকে ছিল না। মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ  Maurice Dobb-এর মতে ঐ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এই ব্যবস্থার অবসান ও সার্বিক জাতীয়করণের পথে দ্রুতগতি অগ্রগমনের কারণ হল – দ্বিবিধ।

প্রথমত,  ১৯১৮ সালের বসন্তকালে কারখানা-কমিটিগুলির মধ্যে উৎপাদন-ব্যবস্থার উপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণমূলক হস্তক্ষেপের প্রবণতা প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত ডিক্রির মাধ্যমে কারখানা-কমিটিগুলিকে যে বৈধ ক্ষমতা প্রদান করা হয় অনেক কারখানা কমিটি তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেয়। এমনকি পর্যায়ক্রমে তারা কারখানায় পরিচালন ব্যবস্থাকে করায়ত্ত করে। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসের আগে কেন্দ্রের ডিক্রি বলে যেসব একক সংস্থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয় তার সংখ্যা হল ১০০টি, কিন্তু স্থানীয় সংগঠনগুলির উদ্যোগে প্রায় ৪ শতাধিক সংস্থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। এই ধরনের ‘প্রাথমিক প্রবণতা’, ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সরকার অসংখ্য সংস্থাকে অধিগ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং ‘রাষ্ট্রীয়  ধনতন্ত্রবাদ’ এর ভিত্তিটিও তাঁর ফলে ধ্বসে পড়তে থাকে। আর Vesenkha-ও এই কারণেই বাধ্য হয় রাষ্ট্রীয়করণের একটি সমন্বিত পরিকল্পনা অনুসরণ করে চলতে।

দ্বিতীয়ত এবং চুড়ান্ত কারণটি হল ১৯১৮ সালের গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গৃহযুদ্ধের সুচনা এবং সেই সঙ্গে বিদেশি শক্তিবর্গ কর্তৃক সশস্ত্র হস্তক্ষেপের ঘটনা, এই পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের প্রতি বুর্জোয়াদের মনোভাব আরও কঠোর হয়ে উঠল, অতীতে তারা যেটুকু করার সদিচ্ছা প্রকাশ করেছিল রাতারাতি তা যেন উধাও হয়ে গেল। আর সব কিছুর উপরে ছিল সোভিয়েত সরকারের সামরিক প্রয়োজন মিটাবার ব্যবস্থা গ্রহন করার অনিবার্য ব্যাকুলতা। মালিকেরা যখন অন্তর্ঘাতে লিপ্ত, কারখানা কমিটিগুলোর বিচ্ছিন্ন কাজকর্মের ফলে  যখন লন্ডভন্ড অবস্থা বিরাজিত তখন শিল্পসংস্থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে অন্য কোন বিকল্প ছিলনা। সুতরাং শৃংখলা ফিরিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কারখানায় প্রতিনিধি পাঠাতে থাকেন এবং তাদের হাতে তুলে দেন অনেক ক্ষমতা। এই প্রতিনিধিরা শৃঙ্খলা প্রবর্তন করে কেন্দ্রীয় কর্মসূচী অনুযায়ী উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে সচষ্ট হন।
১৯১৮ সালের জুন মাসের শেষে এই ব্যবস্থাটি প্রবর্তিত হয় এবং একটি অধ্যায় শেষে শুরু হয়ে যায় আর এক নতুন অধ্যায়। একে আমরা সার্বিক জাতীয়করণের অধ্যায় রূপে চিহ্নিত করতে পারি। এই জাতীয়করণ নীতিটি কোনো বাছবিচার না করেই সকল বৃহদায়তন শিল্প-সংস্থার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯১৮ সালের শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সংখ্যা হয় ১০০০ টি এবং ১৯১৯ সালের হেমন্তে উক্ত সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০০ থেকে ৪০০০ মধ্যে। শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্ত নিয়ন্ত্রণের দিকে অগ্রসরণ, সরবরাহের কেন্দ্রীভূত বণ্টন এবং  উৎপাদিত দ্রব্যাদির কেন্দ্রীভূত সংগ্রহ ও পরিবেশন ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করার জন্য যে কর্মনীতি চালু করা হয় তা ‘যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ’ নামে পরিচিত। মরিস ডব-এর মতে, যখন সব কিছুর  উর্ধেই যুদ্ধের প্রয়োজন মেটানোকে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং যুদ্ধটা যখন নতুন সরকারের কাছে বাঁচা মরার প্রশ্ন, তখন বাধ্যতামূলক কর্মনীতিরই ফলশ্রুতি হলো ‘যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ’।

বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়া ও যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে নয়া অর্থনীতি

বলশেভিক সোভিয়েত সরকার শাসনভার গ্রহণ করেই সমস্যাগুলি সমাধানে প্রয়াসী হয়। সে সময়কার প্রধান সমস্যাগুলি ছিলঃ (১) বিপ্লবকে স্থায়ী করা এবং বিপ্লবের পশ্চাতে জনসাধারনের সমর্থন লাভ করা। (২) সমাজতন্ত্র স্থাপন, মার্ক্সবাদকে কার্যকরী করা, (৩) বৈদেশিক যুদ্ধের অবসান করা পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে লেনিন শান্তি স্থাপনের পক্ষপাতী ছিলেন। রুশ সরকার রাশিয়ার পরাধীন দেশগুলিকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাহায্য দানে অগ্রসর হন। পারস্য ও আফগানিস্থান থেকে রুশ দূতদের অপসারণ দাবী করে। সোভিয়েত সরকারের অপর সমস্যা ছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যন্ডের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি বা শ্রমিক দল ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। ফলে বৃটিশ সরকারের রুশ বিরোধী নীতি কিছুটা হ্রাস পায়। ঐ বৎসরই মুসোলিনী সোভিয়েত সরকারকে আইনগত স্বীকার করবার  আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার সোভিয়েত সরকারকে আইনগত স্বীকার করলে ইতালি, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, গ্রিস, সুইডেন, ডেনমার্ক, মেক্সিকো, হাঙ্গেরি ও ফ্রান্স সোভিয়েত সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। বলশেভিক শাসন ব্যবস্থার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন লেনিন। তাঁর আমলে রাশিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বহুবিধ মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। সম্পত্তি জাতীয়করণ নীতি কার্যকরী করতে গিয়ে বলশেভিক সরকারকে এক দারুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কৃষকরা জমিদারের সম্পত্তি বলে দখল করতে যথেষ্ট উৎসাহ প্রকাশ করে, কিন্তু সেই জমি নিজ সম্পত্তি করতে ব্যগ্র হয়। শিল্প ক্ষেত্রেও এই দুরাবস্থা লক্ষ করা যায়। বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির জাতীয়করণ করা হয়। শ্রমিক সম্প্রদায়ের ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার অভাবের ফলে শিল্পোৎপাদনে অব্যবস্থা দেখা দিয়েছিল।

চলবে……

লেখকঃ অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ।